চোখ এত পোড়ায় ক্যান!

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাখা লাশের সারি। ছবি: দীপু মালাকার
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাখা লাশের সারি। ছবি: দীপু মালাকার

কাল থেকে শুধু টুকরো টুকরো গল্প এসে জড়ো হচ্ছে। গল্পের সংখ্যা গুণিতক হারে বেড়ে চলেছে। ২০...৪০...৬০...। প্রতিটি সংখ্যা ঘিরে একটি নয়, হাজারো গল্প। গল্পের চরিত্রগুলো মনের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করছে।

এই যে রোহানের মা সেই যে কবে ছোট্ট রোহানকে কোলে নিয়ে টিকা দিতে গিয়েছিলেন। সুইয়ের ডগা রোহানের শরীর স্পর্শ করার আগে কঁকিয়ে উঠেছিলেন তিনি। আহা রে ব্যথা যে তাঁর শরীরে আগে লাগল! ওই যে একদিন চুলা থেকে নামানো তরকারির গরম হাঁড়ি কোন ফাঁকে ছোট্ট রোহান ছুটে গিয়ে হাত দিয়ে ধরে ফেলেছিল। হাতে ফোসকা পড়ে গিয়েছিল ছেলেটার। ছোট্ট হাত ঠান্ডা পানিতে ডুবিয়ে দিয়ে মায়ের আফসোস হচ্ছিল, আহা! কেন তিনি খেয়াল করলেন না। ছেলেটি গরম হাঁড়ি ধরার আগেই যদি তাকে তিনি থামাতে পারতেন, তাহলে ছেলেটি কষ্ট পেত না! বারবার ভাবছেন,পরশু রাতেও যদি থামাতে পারতেন, রোহানকে কয়লা হতে হতো না। অথবা যদি ভিন্ন কিছু ঘটত! যেমন রোহান বাইরে বেরোতে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময় বন্ধুরা তাঁর বাড়িতেই এসে হাজির। আজ বাইরে নয়, মত পাল্টে ঘরে বসেই আড্ডা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। অথবা রোহান যদি পরশু রাতে ঢাকায় না থাকত! সারাক্ষণ এই সব ভাবনা ভাবতে ভাবতেই ছেলের পুড়ে অঙ্গার দেহাবশেষ জড়িয়ে ধরতে রোহানের মা কাল দিনরাত হাসপাতালে ছোটাছুটি করেছেন। যাকে সামনে পেয়েছেন তাকেই বলেছেন, ছেলের ‘মাংস’ একটু একটু করে হলেও যেন কেউ তাঁকে খুঁজে দেন। গায়ের ওড়না সামনে মেলে ধরে বলেছেন, ‘এইখানে দিয়া দ্যান, চইলা যামু, কোনো গ্যাঞ্জাম করুম না।’ রোহানের মা কোনো ‘গ্যাঞ্জাম’ না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আসুন, সবাই মিলে রোহানের দেহাবশেষ খুঁজি। আর কোনো কূলকিনারা করতে না পারলে চলুন, গল্পটাকে অন্যভাবে সাজাই। যেমন পরশু রাতের ঘটনাটি আসলে ঘটেইনি। মার্চে রোহানের বোনের বিয়ে, তা নিয়েই নানা ব্যস্ততায় দিন কাটছে ওই তরুণের। অতিথির তালিকায় আরও কিছু নাম সংযোজন করা দরকার। মা-ছেলে সেই কাজেই ব্যস্ত ছিলেন পরশু রাতে। গল্পটা পাল্টাতে না পারলে আসুন, এই মায়ের জন্য সান্ত্বনা বাক্য তৈরি করি। তাঁকে বোঝাই, তাঁর ছেলেকে পোড়া যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়নি। আগুনের লেলিহান শিখা এত দ্রুত গ্রাস করেছে যে তাঁর ছেলে কিছু টের পায়নি। অথবা তাঁকে এই বলে সান্ত্বনা দিই, মস্তিষ্ক কঠোর মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করতে দেয় না। আগুনের শিখা তাঁর ছেলের দিকে এগোনোর আগেই রোহানের মস্তিষ্ক তাকে অচেতন করে যন্ত্রণা ভোগ থেকে মুক্তি দিয়েছে।

এনামুলের পুড়ে মারা যাওয়ার খবর বাবাকে জানাচ্ছেন ভাই। ছবি: আহমেদ জায়িফ
এনামুলের পুড়ে মারা যাওয়ার খবর বাবাকে জানাচ্ছেন ভাই। ছবি: আহমেদ জায়িফ

অন্য গল্পের চরিত্রগুলোও এসে হাজির হচ্ছে। কাওসার পাড়ায় গড়ে তোলা তাঁর ক্লিনিকটি পরশু রাতে একটু আগেভাগেই বন্ধ করতে চাইছিলেন। বেশি দেরি হলে বাসায় তাঁর যমজ সন্তানেরা ঘুমিয়ে যেতে পারে। পিচ্চিগুলোর মুখে শুধু ধ্বনি ফুটেছে। অর্থপূর্ণ দু-একটি শব্দ এমন বিচিত্রভাবে উচ্চারণ করে যে কাওসার হাসতে হাসতেই গড়িয়ে যান। ওরা যত বড় হচ্ছে, জীবনটা ততই আনন্দে ভরে উঠছে কাওসারের। সেই সঙ্গে তাঁর স্বপ্নেরও বিস্তৃতি ঘটছে। প্রায়ই স্ত্রীর সঙ্গে আগামীর নানা পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেন। আজ অন্য দিনের চেয়ে ক্লিনিকে রোগীর সংখ্যা বেশি। বারবার ঘড়ি দেখছেন, বাড়ি যেতে হবে। ইশ্‌, বাচ্চাগুলো কি ঘুমিয়ে গেল! ওদেরকে না দেখার আফসোস নিয়েই ঘুমাতে যেতে হবে। এই গল্পের চরিত্র কাওসারকে ঠিকঠাক বাড়িতে পৌঁছে দিতে পারলে গতকাল তাঁর যমজ সন্তানদের মা বা চাচা-মামার কোলে চড়ে বাবার লাশ খুঁজতে যেতে হতো না। আহা রে, গল্পগুলো কেন এভাবে পাল্টানো যায় না।

এই যে এনামুলকে কি সেদিনই দাঁত দেখাতে কাওসারের ক্লিনিকে যেতে হলো। কদিন ধরেই তো ‘দাঁতে ব্যথা, দাঁতে ব্যথা’ বলে যাচ্ছিল। দাঁতের ব্যথায় তো কেউ মরে যায় না রে ভাই, কেন পরশু রাতেই গেলি—এনামুলের ভাই বারবার একই কথা ভেবে যাচ্ছেন। বাবাকে ফোন করে বলেছেন, ‘আব্বা,এনামুল পু্ইড়া মইরা গ্যাছে।’ এনামুলের ভাইয়ের মাথা কাজ করছে না, কীভাবে সবকিছু সামাল দেবেন। চোখের জলে সামনের সবকিছু ঝাপসা দেখছেন তিনি।

ছেলের ছবি হাতে রোহানের মা ডিএনএর নমুনা দিতে আজ শুক্রবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেছেন। ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ
ছেলের ছবি হাতে রোহানের মা ডিএনএর নমুনা দিতে আজ শুক্রবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এসেছেন। ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

মুঠোফোন সার্ভিসিং ও রিচার্জের ব্যবসা করতেন মাহবুবুর রহমান। মাত্র ২৬ দিন আগে বিয়ে করেছিলেন। তাঁর গল্পেরও তো এমন সমাপ্তি টানতে পারি না আমরা। আমাদের গল্পটি হবে অন্যদিনের মতো। তিনি পরশু রাতে বাড়ি ফিরে নতুন বউয়ের সঙ্গে রাতের খাবার খেতে বসেছেন।

গল্পটা পাল্টানো গেলে ঘরের দরজার চৌকাঠের ওপর বসে বাবা আলী হোসেনের জন্য আছড়ে–পিছড়ে বিলাপ করতে হতো না দুই মেয়ে সামছুন্নাহার ও তাজনেহারকে। সংসারের ঘানি টানতে চকবাজারে একটি ব্যাগের কারখানায় ৬৫ বছর বয়সেও চাকরি করতে হয়েছে তাঁকে। এই বয়সে লোকজন সন্তানের ওপর সব ভাবনা–চিন্তা ছেড়ে দিয়ে নির্ভার হয়। আর সংসার চলে না বলে তাঁর বাবাকে কিনা এই বয়সেও কাজে যেতে হতো। আফসোস কান্না হয়ে বেরিয়ে আসে দুই বোনের গাল বেয়ে।

ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে পুড়ে অঙ্গার পিকআপ। ছবি: আসাদুজ্জামান
ওয়াহেদ ম্যানশনের সামনে পুড়ে অঙ্গার পিকআপ। ছবি: আসাদুজ্জামান

চকবাজারের চুড়িহাট্টার গল্পগুলো পরিবর্তন করতে না পারার অক্ষমতায় প্রচণ্ড রাগ হয়। অসহায় লাগে। যেমন লেগেছিল নয় বছর আগে। ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীতে রাসায়নিকের আগুনে অঙ্গার হয়ে গিয়েছিল ১২৪ জন। ওই সময়ে কারও কারও দাবি ছিল, পুড়ে মারা যাওয়া অনেকের দেহ শনাক্ত হয়নি। তাই তারা ওই ১২৪ জনের সংখ্যাভুক্ত হয়নি। চুড়িহাট্টায় প্রকৃত মৃতের সংখ্যা নিয়েও যেমন অবিশ্বাস তৈরি হয়েছে। সেই অবিশ্বাস তখনো দেখা দিয়েছিল। চুড়িহাট্টা আর নিমতলীর আগুনের সময়ের ছোট ছোট গল্পগুলো আমার কাছে মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছে। আপনাদের মতো আমারও দীর্ঘশ্বাস বাড়তে বাড়তে ঘূর্ণির আকার ধারণ করছে। চোখটা শুধু পোড়ায়। অথচ নিমতলীর ঘটনার তো পুনরাবৃত্তির কথা ছিল না।

নিমতলীতে আগুন নিভে যাওয়ার পরও এলাকাটি বেশ কয়েক দিন ঘিরে রেখেছিলেন পুলিশ ও দমকল বাহিনীর উদ্ধারকর্মীরা। তবে সাংবাদিক আর মৃত ব্যক্তিদের স্বজনদের সেখানে প্রবেশে বাধা দেওয়া হতো না। ঘিঞ্জি যে রাস্তা দিয়ে গা বাঁচিয়ে হাঁটাই মুশকিল হতো, ঘটনার দুদিন পর সেখানে গিয়ে খালি রাস্তা ধরে হাঁটতে গিয়ে বুকের ভেতর হু হু করছিল। আগুনে চারপাশ ধ্বংসস্তূপ। বিয়েবাড়ি থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটেছিল। নিচতলায় ভাড়া দেওয়া রাসায়নিক গুদামে বিয়ের বাড়ির রান্না থেকে আগুন ধরে যায়। বাড়িটির সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময় একজন উদ্ধারকর্মী জানালেন, বেশির ভাগ লাশ পড়েছিল সিঁড়িতে। তারা আগুনে পুড়ে নয়, আগুনের তাপ আর ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে মারা গেছে। একবুক হাহাকার নিয়ে ওই দিন বাড়িটি থেকে বের হয়েছিলাম।

কাওসারের যমজ দুই শিশুসন্তান। ছবি: দীপু মালাকার
কাওসারের যমজ দুই শিশুসন্তান। ছবি: দীপু মালাকার

চুড়িহাট্টা খুব বেশি নিমতলীর ঘটনা মনে করিয়ে দিচ্ছে। ঘটে যাওয়া সবকিছু পাল্টে দিতে ইচ্ছে করছে। নিমতলীর ট্র্যাজেডির পর সরকার তালিকা করে ৮০০ রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা পুরান ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। চুড়িহাট্টার ঘটনায়ও গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পাশাপাশি রাসায়নিকের নাম এসেছে। কালের সাক্ষী পুরান ঢাকাকে কি প্রাইমারি বা সেকেন্ডারি সব ধরনের রাসায়নিক মুক্ত করা সম্ভব নয়! দাহ্য পদার্থ কম থাকলে আগুন এত বিধ্বংসী হতে পারত না। কর্মস্থলের কাছে বাড়ি থাকার সুবিধা অনেক, সেই সুবিধার কথা ভেবে পুরান ঢাকাবাসীরা কি বাড়ির সঙ্গে বা বাড়ির ভেতর কারখানা গড়ে নিজেকে এভাবে নিরাপত্তাহীন করেই রাখবেন! দোহাই দেবেন বংশপরম্পরা ব্যবসার! একবার নিজের জীবন বাঁচানোর তাগিদ থেকেও কি তাঁরা জেগে উঠবেন না! সবকিছু ভাগ্যের ওপর ছেড়ে না দিয়ে তাঁরা কি একবারও গর্জে উঠে বলবেন না, পুরান ঢাকা হবে শুধু আমার আবাসস্থল। পুরান ঢাকাবাসী একবার জেগে উঠুন, তা না হলে এভাবে আগুনে পুড়তেই থাকবেন। আর পোড়া চোখের জলে ভিজতেই থাকবেন। পুরোপুরি ধ্বংস হওয়ার আগে অন্তত একবার জেগে উঠুন।

নাজনীন আখতার: সাংবাদিক