বিপন্নকেই দুষতে হবে কেন?

চুড়িহাট্টার গলিগুলো এমনই সরু। এতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশে ঘটেছে বিপত্তি। প্রথম আলো ফাইল ছবি
চুড়িহাট্টার গলিগুলো এমনই সরু। এতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশে ঘটেছে বিপত্তি। প্রথম আলো ফাইল ছবি

চকবাজার অগ্নিকাণ্ড বিদেশি সংবাদমাধ্যমে আশাতীত কভারেজ পেয়েছে। এর মধ্যে নিউইয়র্ক টাইমসের শিরোনামটি আলাদাভাবে বিদেশি পাঠকদের চোখে পড়বে দুটি কারণে। এক. স্থপতি নিজামুদ্দিনের উক্তি ‘This isn’t about poverty, it’s about greed’কে শিরোনাম করা হয়েছে (পত্রিকাটি সচরাচর এ রকম মন্তব্য-শিরোনাম করে না)। দুই. শিরোনামেই মৃতের সংখ্যা ১১০-এর উল্লেখ (যা অন্য পত্রিকাগুলোর ৬৭-৭০ সংখ্যার চেয়ে বেশি)।

বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক, ‘চিন্তিত’ পরিচয়ে জনপ্রিয় চিন্তক নিজামুদ্দিন আহমেদের মতামতটি অনেকটা গান্ধীর ‘The world has enough for everyone's need, but not enough for everyone's greed’-দার্শনিকতার মতো শোনালেও তিনি বাস্তব-অবাস্তব দুই রকম কথা বলেছেন। বাস্তব কথা, ‘কেমিক্যালের গোডাউনগুলোর মালিকেরা ধনী, দামি গাড়ি-বাড়ির মালিক, সন্তানেরা বিদেশে পড়াশোনা করে।’ অবাস্তব কথা, ‘সরকারি অফিসারদের উচিত দরজায় দরজায় বাড়ি দিয়ে ব্যবসাগুলোকে চিরতরে দূর হ বলে খেদিয়ে দেওয়া’ (‘knock on doors and tell these businesses to get out and get lost’)। তাৎক্ষণিক আবেগের বশে বলে থাকলেও ওনার দুই বাক্যের মন্তব্যটি অনেকগুলো জরুরি ভাবনায় আলোকপাত করার সুযোগ করে দিয়েছে।

জনাব নিজামুদ্দিন আহমেদ পুরান ঢাকার জন্য দুর্ঘটনা-নিরোধবান্ধব বিশেষ নগর-উন্নয়ন পরিকল্পনা বিষয়ে কিছু না বলে একটি বিমূর্ত ধারণা (দারিদ্র্য নয় লোভ) কেন দিলেন বোধগম্য হলো না। একজন স্থপতি নগর-পরিকল্পনার খুঁটিনাটি জানেন, বোঝেন এবং আমজনতা তাঁদের পরামর্শকে গুরুত্ব দেন বলে কাজের কথা শুনতে চায়। ঢাকা শহরে যেখানে প্রতি ১০০ মিটার ব্যবধানে ফায়ার হাইড্র্যান্ট থাকা দরকার, সেখানে বাংলাদেশের অনেক মানুষ ফায়ার হাইড্র্যান্ট কী বা কী কাজে ব্যবহার হয়, সেটিই জানে না। গলির অতি সরু রাস্তায় ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢুকতে পারেনি শুনলে মনে হতে পারে পানিভর্তি গাড়ি ঢুকতে পারাই সম্ভবত আগুন নেভানোর একমাত্র কৌশল। গলির রাস্তার সরুত্ব নতুন কিছু তো নয়। অর্থাৎ, নিমতলীর দুর্ঘটনার পরপরই অগম্য এলাকার জন্য বিকল্প পদ্ধতি নির্ধারণ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার বিশেষ প্রস্তুতি-প্রশিক্ষণ দরকার ছিল। কেন হয়নি?

যেসব এলাকার গলি ঘিঞ্জি, সেসব এলাকার জন্য আকাশপথ ব্যবহারের মাধ্যমে উদ্ধার ও আগুন নেভানোর কোনো চিন্তা কি কখনো করা হয়েছে, আমাদের জানা নেই। বর্তমানে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অনেক সহজসাধ্য। শক্তিশালী ড্রোন ব্যবহারের মাধ্যমে দুর্ঘটনাকেন্দ্র, সর্বাধিক বিপজ্জনক বা ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা, জটিল এলাকায় আটকা পড়া মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে চিহ্নিত করে কর্মকৌশলও নির্ধারণ করা যায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাযুক্ত সফটওয়্যার এসব কাজ করে দেয়। ব্যবহার করা যায় অগ্নিনির্বাপক এয়ার-ট্রাক, এয়ার অ্যাম্বুলেন্স, এয়ার ট্যাংকার, ওয়াটারবোম্বার। পানির বদলে নির্বাপক কেমিক্যাল, ফোম, জেল ইত্যাদি।

প্রশ্ন আসবে আমাদের সেই সক্ষমতা কি আছে? খোঁজখবর নিয়ে যা বুঝেছি এসব ব্যবস্থা বাংলাদেশের সাধ্যের ভেতরেই থাকবে। সক্ষমতার প্রশ্নের আগে প্রশ্ন হোক—জীবনহানি ও সম্পদহানির অপূরণীয় ক্ষতি কোটি থেকে শত কোটি টাকায় পৌঁছানো ভালো, নাকি সম্ভাব্য ক্ষতির অঙ্কের অংশবিশেষ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগ করা ভালো। আগুন ছাড়াও ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। একটি বড় ভূ-কম্পন হলে প্রাণক্ষয় ও সম্পদের অকল্পনীয় ক্ষতি হবে। ‘বিনিয়োগ’ বলছি এই অর্থে যে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বিশেষ দক্ষতা অর্জন করা গেলে নেপাল, ভারতসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতেও বাণিজ্যিকভাবে এই সেবা বিক্রি করা সম্ভব। উচ্চাকাঙ্ক্ষী মনে হলেও ভাবনাটি প্রয়োজন। যা আমরা ‘অসম্ভব’ বলে উড়িয়ে দিই, সেগুলোই দেখা যায় বাংলাদেশের সমান সক্ষমতার অনেক দেশ ইতিমধ্যেই সম্ভব করে রেখেছে।

নিজামুদ্দিন আহমেদের ভাষ্যমতে, গোডাউনের মালিকেরা ধনী, এলাকার বাইরে গাড়ি–বাড়ি, সন্তানেরা বিদেশে—তাহলে ‘get out and get lost’ কারা হবে? নিশ্চিত ছা–পোষা গরিব কর্মচারী, শ্রমিক, জোগালি, কামলা, পাহারাদারেরা জীবিকা হারাবে। তাদের জীবনযাত্রা আরও বিপন্ন করার পরামর্শটিকে সংবেদনশীল বলা যায় কি? [আক্ষরিকভাবে না হলেও] সরকারি অফিসারদের এভাবে বলার বুকের পাটা বা এখতিয়ার আছে নাকি? ধনীরা রাজনীতি ও ক্ষমতাসংশ্লিষ্ট, ক্ষমতাধর। তা ছাড়া অফিসাররা ‘get out and get lost’ বলবেন কোন নীতিমালা, আইন বা রাষ্ট্রীয় অনুমোদনের ভিত্তিতে? নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনের বাংলাদেশি প্রতিবেদকদ্বয় কিন্তু দুর্নীতির সমস্যা প্রসঙ্গটি টেনেছেন।

আমাদের অজানা নয় যে এই মরণফাঁদটি ‘ম্যানেজ’, ঘুষ, চাঁদা, দুর্নীতি ইত্যাদির দ্বারা নগর–শাসকমহল এবং নগরভবনেরই সৃষ্টি। উদ্যোক্তাদেরই দোষ—এই ‘ভিকটিম ব্লেইমিং’য়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের ওপরে নতুন খড়্গ জায়েজ হয়; প্রাতিষ্ঠানিকীকৃত দুর্নীতি, অনিয়ম ও অস্বচ্ছতা আড়াল হয়, দায়মুক্তি পায়। এই যে ‘it’s about greed’ বলা হলো—কার লোভ? উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীদের? নাকি ব্যবসা-অনুমোদন এবং তত্ত্বাবধানের সঙ্গে জড়িত রাষ্ট্রীয় ও নগর প্রশাসনের প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থা ও ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিতদের লোভ? লোভ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। এটিকে বিবেচনায় নিয়ে যথার্থ নগর–পরিকল্পনা সম্ভব কি?

কষ্ট করে নিজ শ্রমে ধনী হওয়া, বাড়ি-গাড়ির মালিক হওয়া, সন্তানদের বিদেশে পড়ানো কি দোষের কিছু? ব্যবসায়ীদের অনেকেই চার-পাঁচ পুরুষ উদয়াস্ত প্রাণান্ত পরিশ্রম করে তবেই ধনী হয়েছেন। অনেকেই অত্যন্ত ক্ষুদ্র পুঁজির সঙ্গে রক্ত-ঘাম মিশিয়ে ব্যবসা করছেন। সবকিছু ছাড়িয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সত্য এই যে, পুরান ঢাকা শুধুই ঘন-জঞ্জালের অগম্য কংক্রিট জঙ্গল নয়। এখানকার বর্তমান জীবনব্যবস্থাটিতে কয়েক শ বছরের পুরোনো সাংস্কৃতিক বিশেষত্ব ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। বিশেষ জীবনাচারের বৈশিষ্ট্যই এ রকম যে চাইলেই রাতারাতি তার পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলা অসম্ভব। ‘মরলেও এখানেই মরব, এভাবেই মরব’—স্থানীয় অধিবাসীদের এ রকম আবেগী বাস্তবতাকে আমলে না নিয়ে গায়ের জোরে ব্যবসা বা মানুষ বা স্থাপনা সরিয়ে ফেলা সম্ভব কি?

উত্তর—না।

এখনই দায়ত্বশীল ব্যক্তিদের কথাবার্তার মধ্যে কোনোই সমন্বয় নেই, দূরদৃষ্টিতা নেই। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত জানানো হচ্ছে ফ্যাক্টরি সরানো হবে, এই করা হবে, সেই করা হবে। আগেও এসবই বলা হয়েছিল, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে—এমন আশায় বুক বাঁধা বোকামি। ধরা যাক, অনেকেই বেঁকে বসলেন আমাদের ব্যবসার সঙ্গে কেমিক্যালের সম্পর্কই নেই, অন্যের দোষে আমরা সরব কেন? মোদ্দাকথা, একবার অপরিকল্পিত নগরব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে তার সংস্কার ও পরিবর্তনে কয়েক দশক সময় যেমন লাগবে, অস্বাভাবিক ব্যয়ও লাগবে। সে ক্ষেত্রে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকেই তাৎক্ষণিক প্রাধান্য দিতে হবে। পাশাপাশি চালিয়ে যেতে হবে নগর-পরিকল্পনা ও দীর্ঘসূত্রে নগর-সংস্কারের কার্যক্রম। তা না হলে আরও ভয়াবহ দুর্ঘটনায় সম্পদহানি ও প্রাণহানির মিছিল দীর্ঘায়িত হতেই থাকবে।

নগর–পরিকল্পনা বিষয় নিয়ে যাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা আছে, অথবা গবেষণা বা সরাসরি কর্মসংযোগ আছে, সবার বিভিন্নমুখী ভাবনা এবং ভাবনার ভালো-মন্দ ঠিক-বেঠিক নিয়ে আলোচনা চলুক। এভাবেই নিষ্কৃতির কোনো ন কোনো পথ বেরিয়ে আসুক।

ড. হেলাল মহিউদ্দীন: রিসার্চ ফেলো, সেন্ট পল’স কলেজ, ম্যানিটোবা বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা