নিমতলী থেকে চকবাজার

বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো রোমহর্ষক এক অগ্নিকাণ্ডে ৭০টি তাজা প্রাণ অকালে ঝরে গেল। বাংলাদেশ তাই শোকে মুহ্যমান। এই গভীর ও দুর্বহ শোকের মুহূর্তে আমাদের মনে পড়ে যাচ্ছে ২০১০ সালের ৩ জুনের কথা, সেদিনও এমনই এক অগ্নিকাণ্ডে জীবন থেমে গেছে ১২৪ জন মানুষের। দুটি বিভীষিকাই ঘটেছে আমাদের প্রিয় রাজধানীর পুরোনো অংশে। সেদিনের নিমতলী অগ্নিকাণ্ডেরই পুনরাবৃত্তি যেন গত বুধবারের চকবাজার অগ্নিকাণ্ড।

চকবাজার অগ্নিকাণ্ডের পর সবাই উপলব্ধি করছেন, নিমতলী অগ্নিকাণ্ড থেকে কেউ কোনো শিক্ষা নেয়নি। কারণ, নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পর পুরান ঢাকায় জীবনধারায় কোনো পরিবর্তন আসেনি। একই রকমের ভৌত পরিস্থিতিতে নিমতলীর পুনরাবৃত্তি ঘটেছে চকবাজারে। কিন্তু এই পুনরাবৃত্তি কি অনিবার্য ছিল? এবং আমরা কি ভবিষ্যতেও এমন অগ্নি-বিভীষিকার পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি নিয়েই পুরান ঢাকার জীবনধারা একইভাবে চালিয়ে যাব?

এই প্রশ্ন উঠছে এ কারণে যে নিমতলী ট্র্যাজেডির পর আমাদের টনক নড়ে গিয়েছিল বলে প্রতীয়মান হয়েছিল এবং অতিশয় ঘনবসতিপূর্ণ পুরান ঢাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি কমানোর জন্য কিছু করণীয় আছে বলে আমরা স্থির করেছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল, সেই কমিটি তদন্ত শেষে ১৭টি সুপারিশসহ একটি তদন্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছে পেশ করেছিল। সেই সব সুপারিশ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হলে চকবাজারে নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি হয়তো-বা এড়ানো যেত। আর আগুন লাগলেও এত দ্রুত তা হয়তো ছড়িয়ে পড়তে পারত না, দ্রুত আগুন নেভানো সম্ভব হতো, এত বেশিসংখ্যক প্রাণহানি এড়ানো যেত।

প্রথমত, লক্ষ করা প্রয়োজন, পুরান ঢাকার অধিকাংশ মহল্লা অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ। ঘনবদ্ধ ঘরবাড়ি, দোকানপাট, কুটিরশিল্পের আদলে অজস্র ছোট ছোট কারখানা ও বিপুল জনগোষ্ঠী-অধ্যুষিত এলাকা এমনিতেই অগ্নিকাণ্ডের উচ্চ ঝুঁকির মুখে থাকে। উপরন্তু পুরান ঢাকার নিমতলী ও চকবাজারে অত্যন্ত দাহ্য নানা রকমের রাসায়নিক পদার্থের মজুত, ব্যবহার, কেনাবেচা ও পরিবহন চলে। উভয় স্থানের অগ্নিকাণ্ডের ব্যাপকতার পেছনের প্রধান কারণ রাসায়নিক পদার্থগুলোর গুদাম ও কারখানা। তাই নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পর গঠিত তদন্ত কমিটির বিশেষজ্ঞরা যে ১৭টি সুপারিশ পেশ করেছিলেন, সেগুলোর প্রথমেই ছিল বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের গুদাম ও কারখানাগুলো সরিয়ে নেওয়া।

সুপারিশে বলা হয়েছিল, এগুলো সরিয়ে নিতে হবে জরুরি ভিত্তিতে, অর্থাৎ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কিন্তু তারপর দীর্ঘ আট বছর চলে গেছে, এই সুপারিশ বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। আট বছর পর মাত্র গত মাসে শিল্প মন্ত্রণালয় ‘বিসিক কেমিক্যাল পল্লি’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এখন প্রশ্ন হলো, এই প্রকল্প গ্রহণ করতে কেন এত দেরি হলো, এর জন্য দায়ী কে? তাই তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নে ব্যর্থতার জন্য যাঁরা দায়ী, তাঁদের শাস্তির পদক্ষেপ অবশ্যই নেওয়া প্রয়োজন।

শুধু রাসায়নিক পদার্থের গুদাম ও কারখানাগুলো সরিয়ে নেওয়া নয়, আরও ১৬টি সুপারিশ পেশ করা হয়। সেসব সুপারিশ বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছিল শিল্প মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের। তারা সবাই সুপারিশ বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে, সুতরাং প্রতিটি ব্যর্থ কর্তৃপক্ষের জবাবদিহির উদ্যোগ নিতে হবে, যদি ব্যক্তি পর্যায়ে কারও গাফিলতির কারণে তা হয়ে থাকে, তবে সেই কর্মকর্তাদের শনাক্ত করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। নইলে চকবাজার অগ্নিকাণ্ডের পর যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, তাদের তদন্ত, সুপারিশ ইত্যাদি কোনো কিছুরই কোনো সুফল মিলবে না। শিল্পমন্ত্রী ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়রের কণ্ঠে রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে যেসব আশ্বাসবাণী শোনা যাচ্ছে, সেগুলোও আশ্বাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে।