বাদল অথবা 'বাদলদের' গল্প

বাদল ফরাজী
বাদল ফরাজী

ভুল বিচারের ভয়াবহ ঘটনা ঘটে পৃথিবীতে। আজ থেকে প্রায় ৭০ বছর আগে এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল ব্রিটেনে। স্ত্রী ও কন্যাকে খুন করার দায়ে মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল টিমোথি ইভান্সের। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার পর জানা যায়, খুন আসলে করেছিল অন্য একজন। এই ঘটনার কয়েক বছরের মধ্যে প্রবল জনমতের চাপে ব্রিটেনে মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্ত করা হয়। পৃথিবীতে এখন যে বহু দেশে মৃত্যুদণ্ড নেই, তার অন্যতম কারণ হচ্ছে ভুল বিচারের আশঙ্কা। ভুল বিচারে এমনকি সামান্য দণ্ডলাভও গ্রহণযোগ্য নয় কোথাও। ব্ল্যাকস্টোনের এই নীতি সর্বজনীন যে: ১ জন নিরপরাধ ব্যক্তির সাজাভোগের চেয়ে ১০ জন দোষী ব্যক্তিকে ছেড়ে দেওয়া ভালো।

তবে ভুল বিচার এখনো হয় পৃথিবীর অনুন্নত আইন ব্যবস্থাগুলোতে। টিমোথির ক্ষেত্রে ভুল বিচার ঘটেছিল অনিচ্ছাকৃতভাবে। কিন্তু এসব দেশে অনেক সময় ভুল বিচার বা মিথ্যে মামলায় ফাঁসানো হয় ইচ্ছে করে বা গাফিলতি করে। এমন ঘটনা প্রকাশিত হয় কম; কিন্তু ঘটে হয়তো অনেক বেশি। বাংলাদেশে এমন ঘটনা বহু ঘটেছে। এ দেশে এমনকি ঘটে এক আসামির নামে অন্য নামের নিরপরাধ ব্যক্তিকে কারাবন্দী রাখার আশ্চর্য ঘটনাও। সম্প্রতি জাহালমের ক্ষেত্রে এই অমানবিক ঘটনা প্রথম আলোয় প্রকাশিত হওয়ার পর আমাদের অনেকে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। অন্যজনের নামে বিচারাধীন অবস্থায় তিন বছর কারাবন্দী থেকে তিনি মুক্তি পেয়েছেন উচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপে।

জাহালম তবু ভাগ্যবান বাদল ফরাজীর তুলনায়। বাদল ফরাজী ১৮ বছর বয়সে বাদল সিং নামে ভারতে গ্রেপ্তার হয়ে খুনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন। ভুল নামেই ভারতে জেল খাটেন দশ–দশটি বছর। তিনি যে নিরপরাধ, এটি তথ্যপ্রমাণসহ দাবি করে ভারতের বাংলাদেশি দূতাবাস তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছে। গত বছরের জুলাই মাসে তাঁকে ফেরত দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশে। শোচনীয় বিষয় হচ্ছে, এরপরও তাঁর মুক্তি মেলেনি। ভুল বিচারে দোষী সাব্যস্ত বাদল ফরাজীকে তাঁর নিজের দেশ বাংলাদেশই জেলে আটকে রেখেছে প্রায় আট মাস ধরে।

বাদল ফরাজীর ঘটনার গভীর অনুসন্ধান প্রয়োজন তাঁকে মুক্ত করার জন্য শুধু নয়, প্রয়োজন ভুল বিচারে তাঁর দোষী হওয়ার পেছনের রহস্য বোঝার জন্য। এভাবে বন্দী হয়ে আরও বহু ‘বাদল’ জেলে ধুঁকছেন কি না, তা বোঝার জন্য।

২.

বাদল ফরাজী ভারতে একটি খুনের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে জেলে ঢোকেন ২০০৮ সালে। অথচ প্রাপ্ত সব রেকর্ডে দেখা যায়, তিনি ভারতে প্রবেশই করেছিলেন খুনটি সংঘটিত হওয়ার দুই মাস পরে। ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর ভারতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের চিঠিতে তাই বলা হয়, ‘বাস্তবিকভাবে সে অপরাধটি ঘটার পর ভারতে পদার্পণ করেছে, অথচ অবৈধভাবে একটি ফৌজদারি অভিযোগের দায় তার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার কারণে সে করুণ দুর্দশা ভোগ করছে। ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশন তাকে ভিসা দেওয়ার তারিখ, বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন তার ভারতে ঢোকার তারিখ এবং বাদলের স্কুল কর্তৃপক্ষ তার ঘটনা সংঘটনকালে স্কুলে থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। সবকিছু প্রমাণ করে যে কথিত অপরাধের সঙ্গে তার কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা ছিল না।’ বাংলাদেশ হাইকমিশনের চিঠিতে ৭ পৃষ্ঠার সংযুক্তিতে সব প্রমাণ এবং আগে পাঠানো নোট ভার্বালের কপিও পাঠানো হয়।

বাংলাদেশ হাইকমিশন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিনিধি। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ রাষ্ট্র যদি বাদলের নির্দোষ হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত থাকে, তাহলে তাঁকে ফিরিয়ে এনে সে নিজেই আটকে রাখে কেন? এটি ঠিক যে ভারত-বাংলাদেশ বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তিতে দোষী সাব্যস্ত কিছু বন্দীর মুক্তির বিষয়ে আইনগত বাধা থাকতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমার একটি সাংবিধানিক প্রাধিকার রয়েছে, যা তিনি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে প্রয়োগ করে থাকেন। এটি প্রয়োগ করে দোষী সাব্যস্ত কুখ্যাত খুনিদের ক্ষমার ঘটনাও অতীতে ঘটেছে। বাদল ফরাজীর মুক্তির ক্ষেত্রে তাহলে বাধা কোথায়? ভারত-বাংলাদেশ চুক্তিতে এমন কোনো কিছু থাকতে পারে না, যা রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক ক্ষমতাকে নাকচ করতে পারে। তাহলে?

বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আগে বলেছিলেন যে বাদলকে দেশে এনেই মুক্তির ব্যবস্থা করা হবে। বাদলকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয় গত বছরের ৬ জুলাই। ১৫ অক্টোবরও তিনি যখন বন্দী, তখন প্রথম আলোকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান যে কীভাবে বাদলকে মুক্ত করা যায়, তার উপায় আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলে বের করা হবে।

বাদলের মুক্তির বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় কী বলেছে, তা আমরা জানি না। তবে আমরা রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তাদের এই মুক্তির বিরোধিতা করতে দেখি এই মাসের শুরুতে হাইকোর্টে একটি রিটের শুনানিকালে। রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত বাদলকে যে বেআইনিভাবে আটক রাখা হয়নি, সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতি রুল জারি করেছেন। এই রুলের জবাব দেওয়ার জন্য ৭ দিন সময় বেঁধে দেওয়া হলেও এখনো কোনো অগ্রগতি হয়নি।

৩.

বাদল হয়তো শেষ পর্যন্ত আদালতের হস্তক্ষেপ বা রাষ্ট্রপতির দয়ায় মুক্তি পাবেন। কিন্তু আমার কাছে সবচেয়ে বিস্ময়কর লেগেছে বাদলের ভুল বিচারের ঘটনা নিয়ে অস্পষ্টতায়। ভারত ও বাংলাদেশের পত্রপত্রিকার বিবরণ অনুসারে বাদলকে ভারতের পুলিশ ধরার পর ভাষাগত কারণে নিজের পরিচয় দিতে পারেননি বলে বাদল সিং হিসেবে তাঁর বিচার হয় এবং তিনি শাস্তি পান। এই অবিশ্বাস্য কাণ্ড আদৌ কি ঘটতে পারে ভারতের বিচারিক এমনকি পরে উচ্চ আদালতে? ক্লাস টেনে পড়া বাদল ইংরেজি বা হিন্দিতে শুধু এটুকু বলতে পারেননি যে তিনি বাদল সিং নন? তঁার পাসপোর্টও কি তাঁকে শুধু এটুকু বিভ্রান্তি থেকে মুক্তি দিতে পারেনি?

তাহলে আসলে কী হয়েছিল বাদলের ক্ষেত্রে?

এই রহস্যের সমাধান রয়েছে হয়তো বাদলের কাছেই। তিহার জেলখানা থেকে লিখিত বাদলের একটি চিঠি প্রকাশ করা হয় ভারতের ললজিক্যাল. কম-এ (https://lolgical. com/crime-happened-entry-india-bangladeshi-badol-farazi-facing-jail/)। সেখানে বাদল বিস্তারিতভাবে জানান, কীভাবে তিনি তাজমহল দেখার উদ্দেশ্যে ভারতে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি ভয়ংকর অপরাধী চক্রের খপ্পরে পড়েন, কীভাবে তাঁর পাসপোর্ট এবং অন্য সবকিছু কেড়ে নেওয়া হয়, পাশবিক অত্যাচারের পর তাঁকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয় এবং নির্যাতনের মাধ্যমে পুলিশ সাদা কাগজে বাদল সিংহ নামে তাঁর স্বাক্ষর নিয়ে তাঁকে মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়।

এই উপমহাদেশের অপরাধী ও পুলিশ চক্রের সিন্ডিকেট সম্পর্কে যাদের বিন্দুমাত্র ধারণা আছে, তাদের এই বিবরণ বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে। বাদল নিজের নামই বলতে পারেননি বলে খুনের মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছেন, এই বিবরণ সে তুলনায় অনেক অগ্রহণযোগ্য মনে হবে।

পত্রিকায় দেখেছি, বাদলের সঙ্গে নাকি বাংলাদেশের মানবাধিকার কমিশন দেখা করেছে। বাদলের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য তারা নাকি ভারতে যাওয়ার পরিকল্পনাও করছে। আমি তাদের অনুরোধ করব প্রথমে বাদলের বিষয়ে ইন্টারনেটে প্রাপ্ত সব তথ্য সংগ্রহ এবং যাচাই করার। সত্য
ঘটনাটি জানার চেষ্টা করুন এবং তা আদালত, প্রধানমন্ত্রীর অফিস ও বাংলাদেশের মানুষকে জানান।

বাদল আসলে কীভাবে ভুল বিচারের বলি হলেন, তা আমাদের জানা প্রয়োজন ভারতে বন্দী অন্য বাংলাদেশিদের স্বার্থেও। টাইমস অব ইন্ডিয়ায় গত বছরের ১৯ মার্চের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতে ৬ হাজারের ওপর ভিনদেশি বন্দীর অধিকাংশই বাংলাদেশি। ২০১৫ সালে শুধু পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলে অন্তরীণ এমন বাংলাদেশি বন্দীর সংখ্যা ৪ হাজারের মতো বলে সেখানে উল্লেখ করা হয়। বাদলের মতো অবিচারের শিকার তঁাদের কেউ কি হচ্ছেন না? বাংলাদেশের অসহায় কোনো মানুষ সেখানে গিয়ে কি অপরাধী চক্রের খপ্পরে পড়ছেন না?

এ দেশে ভারতের মানুষের চাকরি, ব্যবসা ও বিভিন্ন সুবিধা সরকার অবাধ করেছে। ভারতে নিজ দেশের মানুষদের অন্তত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা সরকার নিয়েছে কি? দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে বিষয়টি সরকারের ভেবে দেখা প্রয়োজন।


আসিফ নজরুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক