দায় এড়ানোর রাজনীতি

আগুনের উৎস জানা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি আগুন এত দ্রুত ছড়ানোর কারণগুলো চিহ্নিত করা
আগুনের উৎস জানা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি আগুন এত দ্রুত ছড়ানোর কারণগুলো চিহ্নিত করা

একজন মন্ত্রীর ভাষায় যে শহরকে আকাশ থেকে লস অ্যাঞ্জেলেস বা প্যারিসের মতো দেখা যায়, সেই ঢাকার আদি বসতির একটি অংশে রাসায়নিক আগুনে ৬৭ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর দুর্ঘটনার দায় কার, তা নিয়ে জোর বিতর্ক চলছে। টিভি, রেডিও, পত্রিকার মতো প্রতিষ্ঠিত প্রথাগত গণমাধ্যমে যতটা বিচার-বিশ্লেষণ চলছে, তার চেয়ে অনেক বেশি এবং তীক্ষ্ণ বিতর্ক চলছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোয়। এসব বিতর্কে স্পষ্টতই একধরনের হতাশার দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়, যার মূল কথা হচ্ছে এই কান্না-কষ্ট-ক্রোধ অচিরেই সংবাদ শিরোনাম থেকে হারিয়ে যাবে এবং রাসায়নিক বোমার ওপর বসবাসও আগের মতোই চলতে থাকবে।

২২ ফেব্রুয়ারি সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের যে বক্তব্যটি শিরোনাম হয়েছে, তা হচ্ছে ‘পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম সরানো হবে’। ২০১০ সালের জুন মাসের ৩ তারিখে নিমতলীর দুর্ঘটনার পরও ওই একই শিরোনাম পত্রিকাগুলোয় ছাপা হয়েছিল। সে সময়ের কাগজ ঘেঁটে দেখা গেল, তখনো ‘সব আহতের চিকিৎসার দায়িত্ব নেবে সরকার’ এবং ‘নিহতদের প্রত্যেকের জন্য ১ লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ’ দেওয়ার খবর ছেপেছিল পত্রিকাগুলো। তখনো আগুন নেভাতে পানির সংকট এবং দমকল বাহিনীর প্রয়োজনীয় সব ধরনের সরঞ্জাম না থাকার কথা বলা হয়েছিল। নগরবিদদের বিশ্লেষণ এবং ভবিষ্যতের করণীয় সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ও অতীব প্রয়োজনীয় যেসব সুপারিশ তাঁরা করেছিলেন, সেগুলোরই অনেক পুনরাবৃত্তি এবারও দেখা যাচ্ছে। তবে যার অভাব স্পষ্টতই অনুভূত হচ্ছে, তা হচ্ছে জবাবদিহির অভাব।

একুশে ফেব্রুয়ারির ভোররাতে যখন আগুনের ভয়াবহতা সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া গেল, তখনই আমার মনে পড়েছিল বামপন্থী রাজনীতিক দিলীপ বড়ুয়ার কথা। মনে হচ্ছিল তাঁকে জিজ্ঞেস করি যে রাসায়নিক গুদামগুলো সরাতে না পারার কারণে তাঁর কোনো ধরনের আত্মপীড়ন হচ্ছে কি না। টেলিফোনটি আর করতে হয়নি। মাত্র এক দিন পরই (২৩ ফেব্রুয়ারি), তিনি ১৪ দলের প্রতিনিধিদলের হয়ে দুর্ঘটনাস্থল দেখতে গিয়ে দায়টা চাপিয়েছেন শিল্প মন্ত্রণালয়ে তাঁর উত্তরসূরি আমির হোসেন আমুর ওপরে। দিলীপ বড়ুয়া বলেছেন, ‘কেমিক্যাল বিজনেস রিলোকেট করার জন্য আমি মন্ত্রী থাকাকালে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, কেমিক্যাল মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন ও বিসিক মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তারা ঢাকার বাইরে একটি জমিতে স্থানান্তরিত হবে। এটা আমাদের প্রতিজ্ঞা ছিল। কিছু ডিসক্রিট ব্যাপারের কারণে পুরো ব্যাপারটি এগোয়নি।’

দিলীপ বড়ুয়া তাঁর উত্তরসূরির ওপর যে দায় চাপিয়েছেন, তাতে জোটের ভেতরের কোনো রাজনীতি আছে কি না, জানি না। তবে আমির হোসেন আমুর চেয়ে তাঁর নিজের দায় যে একটুও কম নয়, সেটা স্বীকার করার মতো সততা যে রাজনীতিতে নেই, তা (বোঝা যায়) কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ২০১০ সালের জুন মাসের দুর্ঘটনার পর সিদ্ধান্ত হয়, ৩০ আগস্টের মধ্যে পুরান ঢাকার সব রাসায়নিক গুদাম সরিয়ে নিতে হবে। কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাস দুয়েকের মধ্যেই ব্যবসায়ীদের চাপে তাঁর অবস্থান নমনীয় হতে শুরু করে এবং আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে তিনি সময় বাড়িয়ে ৩০ সেপ্টেম্বর নির্ধারণ করেন। তখনই তিনি আমাকে বলেছিলেন, রোজা ও ঈদের কারণে ব্যবসায়ীদের অনুরোধে সময় বাড়ানো হয়েছে, তবে নতুন সময়সীমার মধ্যে ব্যবসায়ীরা স্বেচ্ছায় এগুলো না সরিয়ে নিলে সরকারের গঠিত টাস্কফোর্স আইনগত ব্যবস্থা নেবে (দাহ্য পদার্থ সরানোর সময়সীমা বাড়ল, ১৭ আগস্ট ২০১০, বিবিসি বাংলা)। সেই টাস্কফোর্স তাঁর মন্ত্রিত্বকালে আর কখনোই কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। নিমতলীর দুর্ঘটনার ঠিক দুবছর পরে তিনি স্বীকার করে নেন যে এসব কারখানা সরানো সম্ভব হয়নি। তখন তিনি কারণ হিসেবে বলেন যে দাপ্তরিক কিছু কাজের জন্য সময় লাগছে (দুই বছরেও সরেনি রাসায়নিক কারখানা, ৩ জুন ২০১২, বিবিসি বাংলা)।

ব্যবসায়ীদের চাপের কারণে ২০১৭ সালেও এসব গুদাম ও কারখানা সরানোর চেষ্টা যে মুখ থুবড়ে পড়েছিল, সে কথা বলেছেন ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন (নিমতলী থেকে শিক্ষা নেয়নি কেউ, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, প্রথম আলো)। সে বছরের মার্চে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে কাজ শুরু করলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ও রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবসায়ীদের অনুরোধে তা বন্ধ রাখা হয়। বোঝাই যাচ্ছে আবাসন আইন ও নগর ব্যবস্থাপনাবিষয়ক বিভিন্ন নীতিমালা লঙ্ঘন করে ‘৫২ বাজার ৫৩ গলির আদি ঢাকা’র আবাসিক চরিত্রের বিনাশসাধনের ধারা অব্যাহত থেকেছে বাণিজ্যের প্রয়োজনে। ছোট এবং মাঝারি আকারের ব্যবসায়ীদের ব্যক্তিগত চেষ্টা, ঘুষ, তদবির ছাড়াও ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে প্রভাবশালী বণিক সভা এ ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে।

আমাদের সংসদে ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্বের হার বৃদ্ধির সঙ্গে তাঁদের কারও কারও অন্যায় প্রভাব বিস্তারের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তার কোনো সম্পর্ক নেই—এমনটি তাই বলা চলে না। প্রবৃদ্ধির রাজনীতিতে রাজনীতিকদের চেয়ে ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য অনেক বেশি। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের হিসাবে দশম সংসদে ব্যবসায়ী ছিলেন ৫৯ শতাংশ। সুজনের হিসাবে একাদশ সংসদে তা বেড়ে হয়েছে প্রায় ৬২ শতাংশ। সোনারগাঁও হোটেলের পেছনে হাতিরঝিলে সরকারি জমিতে আইন ভেঙে তৈরি করা বিজিএমইএ ভবনটি যেমন এ রকম অবৈধ প্রভাব বিস্তারের প্রমাণ, চকবাজারের ঘটনাকেও সে রকম আরেকটি স্মারক বললে সম্ভবত ভুল হবে না। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় অভিনব এক তদন্তের ভিত্তিতে নতুন শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন চকবাজারে কোনো রাসায়নিক মজুত ছিল না বলে যে মন্তব্য করেছেন, তা কিসের ইঙ্গিত বহন করে—এই প্রশ্ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষজ্ঞদের তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই কোথা থেকে ও কীভাবে আগুন লেগেছে, সে ব্যাপারে একটা যুক্তি দাঁড় করানোর বেশ জোরালো উদ্যোগও এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয়।

আগুনের সূত্রপাত সিলিন্ডার, বিশেষত যানবাহনের গ্যাস সিলিন্ডার থেকে ঘটে থাকলেই কি আবাসিক ভবনে রাসায়নিক দ্রব্যের মজুতের ঝুঁকি হাওয়া হয়ে যাবে? নাকি ওই সব রাসায়নিক সামগ্রীর উপস্থিতির কারণে সেখানকার বাসিন্দারা আরও বিপন্ন ও সম্পদ ধ্বংসের ঝুঁকি আরও বাড়বে? আগুনের উৎস জানা যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি আগুন এত দ্রুত ছড়ানোর কারণগুলো চিহ্নিত করা, আগুন নিয়ন্ত্রণ ও নেভানোয় যেসব বাধা বা সমস্যা তৈরি হয়েছিল, সেগুলো অনুধাবন করা। আর শুধু গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডার নয়, গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার্য কিংবা রেস্তোরাঁর সিলিন্ডারেও সমস্যা থাকতে পারে। গাড়ির জ্বালানি তেল বা পেট্রল ও ডিজেলের ট্যাংকও আগুনের কারণ হতে পারে। প্রশ্নটি হচ্ছে যেসব দাহ্য পদার্থ জ্বালানি হিসেবে নাগরিকেরা ব্যবহার করছেন, সেগুলোর নিরাপত্তা মান নিশ্চিত করার কাজটি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে করছে কি না। সুতরাং, আবাসিক এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিক সামগ্রীর মজুত গড়ে তোলা, বিপজ্জনক ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠা, সেখানকার স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তামূলক বিধিবিধানগুলো প্রয়োগ ও তদারকির দায়িত্ব যাঁদের, তাঁদের জবাবদিহির বিষয়টিই হচ্ছে মূল প্রশ্ন।

আইনের শাসন এবং জবাবদিহি দুটো পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত এবং একটি ছাড়া অন্যটি অসম্ভব। আর কার্যকর গণতন্ত্র ছাড়া কোথাও এগুলোর অনুশীলন আশা করা যায় না। আমাদের গণতন্ত্র তার কার্যকারিতা হারিয়েছে অনেক আগেই। ২০০৯ সালে যে সংসদ গঠিত হয়েছিল, সেখানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের একচেটিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিপরীতে বিরোধী দল বিএনপির প্রতিনিধিত্ব ছিল ১০ ভাগের ১ ভাগ। ফলে ২০১০ নিমতলীর দুর্ঘটনার বিষয়ে সংসদে তাঁদের তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকা দেখা যায়নি। এরপর বিশেষত ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের পর থেকেই সরকারের সামনে আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। প্রতিদ্বন্দ্বীর অনুপস্থিতিতে জবাবদিহির প্রয়োজন হয় না। সুতরাং, আট বছর আগের সংবাদপত্রের শিরোনামগুলোর পুনরাবৃত্তিই যে স্বাভাবিক হয়ে উঠবে, তাতে আর বিস্ময়ের অবকাশ কই?

পুরান ঢাকার আদি বাসিন্দা হিসেবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এক নম্বর নাগরিক হলেও সাঈদ খোকন তাঁর নিবাসটি নিয়ে গেছেন ঢাকার সমৃদ্ধ উত্তরের বসতি গুলশানে। ঘিঞ্জি ঢাকার সঙ্গে ‘প্যারিসীয় ঢাকা’র দূরত্ব তাঁর একার পক্ষে যে ঘোচানো সম্ভব নয়, সেটা ঠিক। তবে ব্যক্তিজীবনের দূরত্ব যে নগরটির নাগরিকদের দৈনন্দিন কষ্ট-দুর্ভোগ-ঝুঁকির অংশীদারত্বে ঘাটতির জন্ম দেয়, সে কথা কি অস্বীকার করা চলে?

কামাল আহমেদ সাংবাদিক