কে নেভাবে আগুন?

সরকারি–বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে অগ্নিনির্বাপণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই
সরকারি–বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে অগ্নিনির্বাপণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা আর অর্জন নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ নেই। আত্মতৃপ্তির ভেদ ঢেকুর তুলতে তুলতে আমরা কখন যে গাছের মরা পটকা মগডালে উঠে গেছি, জানি না। তাই বুঝি এই পতন। আত্মপ্রসাদের ঢেউয়ে ভাসতে থাকা আমাদের দুর্যোগ চ্যাম্পিয়নদের গালে কশিয়ে এক চড় দিয়ে গেল চুড়িহাট্টার ভয়ংকর ঘটনা। এই চড়টি আমাদের অনেক দিন ধরে পাওনা ছিল। তবে কানে তুলো আর পিঠে কুলো বেঁধে চলাদের দু-একটা চড়-থাপ্পড়ে তেমন কিছু হওয়ার আশঙ্কা বড়ই কম। দুর্যোগে, বিশেষ করে নগর দুর্যোগে আমাদের প্রস্তুতি নিয়ে কোনো প্রশ্ন বা দ্বিমত অথবা অন্যমত প্রকাশ করলে কিংবা একটু বিস্তারিত জানতে চাইলে কর্তারা নাখোশ হন। প্রকাশ্য আনুষ্ঠানিক সভার সব নর্ম, ভদ্রতা বা আচরণবিধির তোয়াক্কা না করে হাতের আস্তিন গুটিয়ে দাঁতভাঙা জবাব দেওয়ার ঔদ্ধত্য এখন নিয়মিত কালচারে পরিণত হয়েছে। কোনো স্তরেই জবাবদিহির কোনো জানালা খোলা নেই।

তারপরেও আমরা ভাগ্যবান

কেউ কি ভেবে দেখেছেন যদি ফেব্রুয়ারির ১৪ আর ২১ তারিখের মধ্যে সাত দিনের তফাত না থেকে যদি সাত মিনিটের ফারাক হতো, তাহলে কোন গজব দেখতে হতো। এই দুইয়ের মধ্যে ১৭ ফেব্রুয়ারি বন্দরনগরী চট্টগ্রামে একটি বস্তিতে ভোররাতে অগ্নিকাণ্ডে আটজন নিহত হয়েছেন। পুড়ে যায় ভেড়া মার্কেট বস্তির অন্তত ২০০ কাঁচা ঘর। অগ্নিকাণ্ডে নিহত ব্যক্তিদের সাতজন ছিলেন দুটি পরিবারের সদস্য। ঘুমন্ত অবস্থায় মর্মান্তিকভাবে তাঁদের মৃত্যু হয়েছে। সেই অগ্নিকাণ্ডের কারণ এখন পর্যন্ত জানাতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ১৯ ফেব্রুয়ারি ভোররাতে খাগড়াছড়ি সদরের খবংপুড়িয়া এলাকায় গ্যাস সিলিন্ডারের দোকানে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে দোকানের শ্রমিকসহ সাতজন দগ্ধ হন। সংকটাপন্ন কতিপয় দগ্ধ ব্যক্তিকে (মোট চারজন) চট্টগ্রামে পাঠানো হলেও ভাগ্য ভালো কেউ সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়নি। পরে কি কেউ মারা গেছে? অন্য আগুনের ফলোআপে হারিয়ে গেছে সে খবর। তবে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে বিস্ফোরক পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন সাংবাদিকদের জানান, প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে অবৈধ উপায়ে গ্যাসের এক সিলিন্ডার থেকে অন্য সিলিন্ডারে গ্যাস ট্রান্সফারের সত্যতা পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, অধিক মুনাফার আশায় ভর্তি গ্যাস সিলিন্ডার থেকে অবৈধ উপায়ে খালি সিলিন্ডারে গ্যাস হস্তান্তর করতে গিয়ে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ভাগ্য ভালো থরে থরে সাজানো সিলিন্ডারের মাধ্যমে কোনো ধারাবাহিক বিস্ফোরণ এ যাত্রায় ঘটেনি।

কারণ কি গ্যাস সিলিন্ডার

গ্যাস সিলিন্ডারের দোকানে বিস্ফোরণের ঘটনা এখন প্রায় নিত্য খবরের অংশে পরিণত হয়েছে। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ায় ২০১৮ সালের ২৭ জানুয়ারি গ্যাস সিলিন্ডারের দোকানে বিস্ফোরণের পর কি কোনো জাতীয়ভিত্তিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল? ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর রাজধানীর কারওয়ান বাজারের জাহাঙ্গীর টাওয়ারের পেছনের গলিতে একটি টং দোকানে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। এতে জাহাঙ্গীর টাওয়ারের পেছনের অংশের প্রথম ও দ্বিতীয় তলার এসিতে আগুন ধরে যায়। পরে ফায়ার সার্ভিসের সাতটি ইউনিট প্রায় আধা ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এতে হতাহতের ঘটনা না ঘটলেও ভবনটির দ্বিতীয় তলা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। গত চার বছরে (২০১৯ এই হিসাবে ধরা হয়নি) এলপি গ্যাস থেকে ৪৭৬টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ১৮৬টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া ২০১৭ সালে ৭৯টি, ২০১৬ সালে ১৩১টি এবং ২০১৫ সালে ৮০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে।

ফায়ার সার্ভিস কেবল তাদের নির্বাপণব্যবস্থার মধ্যে থাকা ঘটনার রেকর্ড রাখে। এর বাইরেও এলপি গ্যাসের গ্রাহকেরা অগ্নিকাণ্ডের শিকার হন। তবে ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটলে তার তদন্ত হয় না। হিসাবও কেউ রাখে না। গ্যাস সিলিন্ডারের বিষয়ে অভিজ্ঞদের মতে গ্যাস-সংকটের কারণে আবাসিকে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলেছে। কিন্তু এই সিলিন্ডার ব্যবহারের ক্ষেত্রে ও সিলিন্ডারের মান পরীক্ষা করার বিষয়েও কোনো নীতিমালা না থাকায় ভোগান্তি আর দুর্ঘটনা বাড়ছে। ঘটছে একের পর এক এলপিজি সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা।

ঢাকায় নতুন ইমারতে গ্যাসলাইন দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ার পর এক অভিনব কৌশলে বাসায় বাসায় গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে। সবার গ্যাস সিলিন্ডার ইমারতের নিচতলায় এক জায়গায় জড়ো করে পাইপের মাধ্যমে প্রতিটি ফ্ল্যাটে সরবরাহের যে জটিল আর বিপজ্জনক পদ্ধতি গড়ে তোলা হয়েছে, তা দেখার কেউ নেই। এই গুচ্ছ সিলিন্ডারের কোনো একটি কোনো কারণে বিস্ফোরিত হলে বাকি সিলিন্ডারগুলো এক-একটি উড়ন্ত অগ্নিকুণ্ড হয়ে যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে, তা ভাবতেও গা শিউরে ওঠে।

হাসপাতালে আগুনের ঝুঁকি কি বাড়ছে?

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর জানা যায়, রাজধানীর ৪২৩টি হাসপাতালের মধ্যে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ ১০৫টিসহ মোট ৪১৬টি হাসপাতালই আছে অগ্নিঝুঁকিতে। মাত্র ৭টি হাসপাতালের অবস্থা মোটামুটি সন্তোষজনক বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। বেশির ভাগ হাসপাতালে অগ্নিনির্বাপণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে কীভাবে তা নেভানো হবে, রোগীদের কীভাবে অন্য স্থানে সরিয়ে নেবে—তার কোনো ব্যবস্থা নেই। দ্রুত রোগী নামানোর ঢালু সিঁড়ি নেই। ফায়ার সেফটি সার্টিফিকেট ছাড়া নিজেদের খুশিমতো বহুতল ভবনে হাসপাতাল করে রোগী ভর্তি করছে অনেকে। দিনের পর দিন বহু হাসপাতাল গড়ে উঠলেও হাসপাতালের লিফট-সিঁড়ি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে আগুন লাগলে দ্রুত রোগী ও স্বজনদের নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব নয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

প্রচুর অর্থের বিনিময়ে সেবা বিক্রির এসব প্রতিষ্ঠানে আগুনের ঝুঁকি কমিয়ে আর হঠাৎ আগুন লেগে গেলে তা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনার ক্ষেত্রে তাদের বিনিয়োগ সবচেয়ে কম। মালিকদের এদিকে নজর দিতে বাধ্য করবে কে? শুধু ব্যক্তিমালিকানার হাসপাতাল নয়, সরকারি হাসপাতালগুলোতেও আগুনের ঝুঁকি বেড়েই চলেছে। ১৪ ফেব্রুয়ারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। স্থানীয় মানুষ, ছাত্র, ডাক্তার, নার্স, হাসপাতালের কর্মচারীদের দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ আর ফায়ার সার্ভিসের তৎপরতার কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভবপর হয়েছে বলে বেঁচেছে অনেক রোগীর প্রাণ। কিন্তু যাঁরা জানেন তাঁরা দেখেছেন কীভাবে নতুন নতুন নির্মাণ পরিবর্ধন আর এক্সটেনশনের নামে গ্রিল দিয়ে দেয়াল তুলে জরুরি উদ্ধারের কাজ পদে পদে বাধাগ্রস্ত আর জটিল করা হয়েছে।

এক হাসপাতালে আগুন লাগলে কোন হাসপাতালে, কোন প্রটোকল অনুসরণ করে রোগী হস্তান্তর করতে হবে, তা আগে থেকে ঠিক থাকলে যানজটের এই শহরে, যানজটের মাত্রা বাড়িয়ে তিন-চার মাইল দূরের হাসপাতালে এক রাতের জন্য আতঙ্কগ্রস্ত রোগীদের পাঠানোর যুক্তি নিয়ে সাধারণ ভুক্তভোগী মানুষ প্রশ্ন করলে কে তার জবাব দেবে। শেরেবাংলা নগর এলাকায় নানা গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনার পাশাপাশি আটটি সরকারি হাসপাতালসহ নানা বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় আর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের কথা আর প্রয়োজনকে মাথায় রেখে অগ্নিব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার দায়িত্ব কে নেবে?

দায়িত্ব নেওয়ার কাঁধ নেই

পুরান ঢাকার অধিবাসীদের লোভের কথা, সচেতনতার অভাবের কথা একদমে সবাই নামতার মতো পড়ে চলেছেন। কেউ বলছেন না একনেকে পাস হওয়ার পর কেন টাকা পেল না কেমিক্যালপল্লি। ব্যবসায়ীরা নিজের টাকায় গুদাম, কারখানা গড়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়ার পরও কেন পেলেন না প্লট বরাদ্দ। এসব নিয়ে খোলা শুনানির পর সরকারের উচিত হবে অবহেলাকারীদের চিহ্নিত করে একটা শ্বেতপত্র প্রকাশ করা।

পুনশ্চ যে তরুণ ক্যামেরা ক্রুরা নির্ভয়ে ছুটে গিয়েছিলেন চুড়িহাট্টা কাভার করার জন্য, তাঁদের অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু তাঁদের মাস্ক-হেলমেট ছাড়া পাঠানো যে ঠিক হয়নি, তা তাঁদের বসরা কবে বুঝবেন?

একজন বিক্ষুব্ধ কবি লিখেছেন:

এ রাষ্ট্র আগুন পোষে। যেমন আমি আগুন পুষি বুকে

আমার আগুন জ্বলে বিদ্রোহে। রাষ্ট্র আগুন জ্বালায় তার খেয়ালখুশি আর সুখে। (কবি রাজাত হুগো)

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক