রাখাইনে জাপানের বিনিয়োগ মেলা

মিয়ানমারের বাহিনীর নৃশংস নিপীড়নের মুখে রাখাইন থেকে পালিয়ে লাখো রোহিঙ্গা বাংলাদেশ আশ্রয় নিয়েছে। রয়টার্স ফাইল ছবি
মিয়ানমারের বাহিনীর নৃশংস নিপীড়নের মুখে রাখাইন থেকে পালিয়ে লাখো রোহিঙ্গা বাংলাদেশ আশ্রয় নিয়েছে। রয়টার্স ফাইল ছবি

যুদ্ধে বিজয়ীরা সাধারণত পরিবর্তিত হয় না, পরিবর্তিত হয় পরাজিতরা। যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য পশ্চিমে, যাকে বাইবেল বেল্ট নামেও অভিহিত করা হয়, অনেক জার্মান বংশোদ্ভূত আমেরিকানের বাস। যুক্তরাষ্ট্রের এই অঞ্চল কট্টর দক্ষিণপন্থী, যুদ্ধবাদী এবং রিপাবলিকান অধ্যুষিত। এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে আমার পোস্টিং ছিল কলকাতায়। সেখানে জার্মান কনসাল জেনারেলকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আর তার আগে জার্মানি তো বর্ণবাদী এবং আগ্রাসী ছিল। যুদ্ধের পর তোমরা তা থেকে বেরিয়ে এসেছ। জার্মানরা এখন অন্যতম মানবিক, শান্তিবাদী জনগোষ্ঠী। মার্কিন জার্মানদের তাহলে এ হাল কেন? ভদ্রলোক এর খুব সহজ উত্তর দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘দেখো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে আমরাও ওদের মতোই ছিলাম। যুদ্ধে আমরা পরাজিত এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিলাম। আমাদের নেতারা উপলব্ধি করেছিলেন যে পরিবর্তন ছাড়া আমাদের কোনো বিকল্প নেই। মার্কিন জার্মানরা তো পরাজিত পক্ষে ছিল না, তাই তারা পরিবর্তিত হওয়ার কোনো প্রয়োজন অনুভব করেনি।’

একই কথা জাপানের বেলায়ও খাটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অধিকৃত চীন ও কোরিয়ায় জাপানের নিষ্ঠুরতা সাম্প্রতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানি আচার–আচরণ সম্পূর্ণ বদলে গেছে। যুদ্ধোত্তর জাপান সবচেয়ে শান্তিবাদী দেশগুলোর একটি হিসেবে নিজের পরিচিতি প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে উন্নয়ন সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রেও জাপানের ভূমিকা অনুকরণীয়। দ্বিপক্ষীয় পর্যায়ে জাপান বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী। জাপানি সহায়তার গুণগত মানও সবচেয়ে ভালো। অধিকাংশ জাপানি ঋণ চূড়ান্ত পর্যায়ে অনুদানে পরিণত হয়। সব দিক বিচারে উন্নত দেশগুলোর মধ্যে বৈশ্বিক আচরণে জাপান একটি আদর্শ ভূমিকা পালন করেছে, এটা বলা যায়।

জাপানের এরূপ ভূমিকার একটি ছন্দপতন যেন দেখা গেল মিয়ানমার সেনাবাহিনী কর্তৃক রোহিঙ্গা নির্যাতন ও গণহত্যার ক্ষেত্রে। ভারত, চীন, রাশিয়ার মতো সরাসরি মিয়ানমার জান্তার পক্ষে দাঁড়ায়নি জাপান, তবে প্রথম থেকেই জাপানের প্রতিক্রিয়া ছিল অনেকটাই অপ্রত্যাশিত। পশ্চিমা বিশ্ব ও জাতিসংঘ যেভাবে এই নির্যাতনের প্রতিবাদ এবং সংগত কারণেই মিয়ানমারকে এ জন্য দায়ী করেছে, জাপান তখন অনেকটাই নীরব।

জাপানের এই স্ববিরোধী নীতি অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের পূর্ব এশিয়া ডেপুটি ডিরেক্টর লিসা তাশির একটি লেখায় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। ২৫ আগস্ট ২০১৭ আরসার আক্রমণের অজুহাতে নিরস্ত্র রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ শুরু হওয়ার তিন সপ্তাহ আগে ২ আগস্ট মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাই এক সামরিক প্রতিনিধিদল নিয়ে জাপান সফরে যান। জাপানি সামরিক বাহিনী ছাড়াও তিনি জাপানি অনুদান দেয় যে সরকারি প্রতিষ্ঠান তার প্রধানের সঙ্গে দেখা করেন এবং সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করেন। হত্যাযজ্ঞ শুরুর পর এবং সেপ্টেম্বর মাসে রাখাইন রাজ্যে জরুরি ত্রাণ সহায়তা ঘোষণার বেলায়ও জাপানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরসার আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রবল নিন্দা জ্ঞাপন করে, কিন্তু মিয়ানমার সেনাদের সুস্পষ্ট লক্ষ্য নিয়ে গণহত্যামূলক কার্যকলাপের বিষয়ে নীরবতা অবলম্বন করে।

মিয়ানমার সেনাদের যুদ্ধাপরাধমূলক কর্মকাণ্ড শুরুর দুই মাস পর জাপানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সে দেশ সফরে গিয়ে সেনাপ্রধান মিন অং হ্লাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান গভীর সামরিক সম্পর্কের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। জাতিসংঘ যখন মিয়ানমারের
সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাদের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য বিচারের আহ্বান জানায়, তার পরদিনই মিয়ানমারে জাপানের রাষ্ট্রদূত মিন অং হ্লাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করেন। অ্যামনেস্টি মনে করে, জাপান যদি তার এই অবস্থান না পাল্টায় এবং রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জাতিগত উচ্ছেদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বিশ্ব সম্প্রদায়ের নিন্দায় সমবেত হতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আবার জাপান ইতিহাসের ভুল প্রান্তে অবস্থান নেবে।

এহেন প্রেক্ষাপটে গত শুক্রবার অনেক উৎসাহ–উদ্দীপনার মধ্যে রাখাইন রাজ্যে জাপানি উদ্যোগে বিনিয়োগ মেলা শুরু হয়ে গেল। স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি উপস্থিত ব্যবসায়ীদের সমস্যাসংকুল রাজ্যটিতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসতে আহ্বান জানান। পশ্চিমের প্রায় কেউ এই মেলায় যোগ দেননি। জাপান, কোরিয়া, ভারত, চীন, থাইল্যান্ড থেকে ব্যবসায়ী, কর্মকর্তা আর কূটনীতিকেরা এসেছিলেন মেলায় অংশ নিতে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি যেখানে মিয়ানমারের একগুঁয়েমির কারণে পুরোই আটকে আছে, সেখানে রাখাইন রাজ্যে জাপানি উদ্যোগে এরূপ একটি বিনিয়োগ মেলা, অপরাধের শিকার দুর্দশাগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের প্রতি একধরনের অবহেলাই শুধু নয়, অপরাধীদের প্রতি নৈতিক সমর্থন জ্ঞাপনেরও শামিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–উত্তরকালে জাপানে যে বিরাট মানসিক পরিবর্তন হয়েছে বলে বিশ্বসম্প্রদায় বিশ্বাস করে আসছে, সেটা বোধ হয় পুনর্মূল্যায়নের সময় হচ্ছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশের কি কিছুই করণীয় নেই? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কার্যালয়ে গত সপ্তাহে যোগাযোগ করেছিলেন এক সাংবাদিক। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে বিষয়টি ‘স্পর্শকাতর’, তাই এ বিষয়ে কিছু করা সম্ভব নয়। আমার তো মনে হয় স্পর্শকাতর বলেই বিষয়টা নিয়ে উচ্চকিত হওয়া প্রয়োজন। সন্দেহ নেই জাপান খুবই গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগী। অনেক বড় বড় প্রকল্পে সহায়তা দিচ্ছে জাপান। বিষয়টি নিয়ে কথা বললেই জাপান এগুলো থেকে সরে যাবে বলে আমার মনে হয় না। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের নিয়ে যে ‘ক্যাচ টোয়েন্টি টু’ অবস্থানে আমরা আছি, তার গুরুত্ব এসব প্রকল্পের চেয়ে কম, এ কথা বিশ্বাস করা কঠিন।

মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব