কর্তব্যের অবহেলায় নিরাপত্তা বিপন্ন

হুজ্জতে বাঙালি আর হিকমতে চীন—এই প্রবচনের কথা কয়েকটি অতি সত্য। যেকোনো বিষয়ে বা ঘটনা-দুর্ঘটনায় বাঙালি হুজ্জত বা তর্কাতর্কি করতে ভালোবাসে। সমাধানের জন্য যে হিকমত বা দক্ষতা ও কুশলতা দরকার এবং যে হিম্মত বা বল দরকার, তা বিধাতা বাঙালিকে দেননি।

ঘূর্ণিঝড়, টর্নেডো, জলোচ্ছ্বাস প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর মানুষের ভুলের বা অসাবধানতা-অব্যবস্থার কারণে সংঘটিত দুর্ঘটনা দুই জিনিস। প্রথমটিতে কারও হাত নেই। দ্বিতীয়টি সাবধানতা ও উপযুক্ত ব্যবস্থা নিলে এড়ানো সম্ভব। গত বুধবার পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডে হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি দ্বিতীয় শ্রেণির। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ বহু জায়গায় ঘটে, ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণও হামেশাই ঘটছে, তার ফলে ৬৭ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটত না, যদি সেখানে রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ না থাকত।

২০১০ সালে পুরান ঢাকারই নিমতলীতে যে অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জন প্রাণ হারান, সেটা ছিল দেশের ইতিহাসে মর্মান্তিক দুর্ঘটনাগুলোর অন্যতম। কিন্তু ওই দুর্ঘটনার পর কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের তোড়জোড়ের চেয়ে সেখানে বেঁচে যাওয়া তিনটি মেয়ের বিবাহ উৎসব প্রাধান্য পেয়েছিল। বাবা-মা হারানো এতিম মেয়েদের বিয়ে দিয়ে পুনর্বাসনের প্রয়োজন ছিল বটে, তবে খুব বেশি দরকার ছিল পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিক পদার্থের গুদাম ও কারখানাগুলো সরিয়ে নেওয়া।

মানুষের জীবন অমূল্য। তা একবার হারিয়ে গেলে আর ফেরত পাওয়া যায় না। যে ৬৭টি বা তারও বেশি জীবন আগুনে পুড়ে কয়েক মুহূর্তে অকল্পনীয় যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে শেষ হয়ে গেল, তার জন্য দায়ী সেই ভবনের মালিক ও আমাদের রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা। নিমতলীর দুর্ঘটনার পরে তদন্ত কমিটি যে ১৭টি সুপারিশ করেছিল, সেগুলোর অর্ধেকও যদি বাস্তবায়িত হতো, তাহলে হয়তো এই প্রাণহানি ঘটত না।

গত ৮ বছরে নিমতলী ও তার আশপাশের মহল্লায় পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো থেকে আমরা বহুবার সমাবেশ ও মানববন্ধন করে বলেছি ঘিঞ্জি আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক পদার্থের গুদাম ও কারখানা সরানো হোক। আমাদের আবেদন ছিল সরকারি কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় ব্যবসায়ী ও ভবন মালিকদের কাছে। ভবনমালিকেরা যদি ভাড়া না দেন তাহলে সেখানে কেমিক্যালের গুদাম হতে পারবে না। আর অবৈধভাবে যদি গুদাম হয়, তা বন্ধ করে দেওয়ার ক্ষমতা সরকারি কর্মকর্তাদের আছে। বাড়ির মালিকদের মুনাফার লোভ এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কর্তব্যে অবহেলা এই–জাতীয় দুর্ঘটনার জন্য দায়ী।

সেদিন সকালে গিয়ে দেখি আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। দমকল বাহিনী আপ্রাণ চেষ্টা করেছে সারা রাত। দেখতে পাই গলির ভেতরে বিপুল পরিমাণ মসুরের দানার মতো প্লাস্টিক দ্রব্য পানিতে ডুবে আছে। তার ভেতর দিয়েই পা ডুবিয়ে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে আমি হেঁটে ভেতরে যাই। আবাসিক বহুতল ভবনে দাহ্য বস্তুর গুদাম কীভাবে হতে পারল? সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জবাব কী?

এই মর্মান্তিক বেদনাদায়ক ঘটনার মধ্যেও আমাদের রাজনীতিকরনেওয়ালাদের মুখ থেমে থাকল না। তাঁরা হুজ্জতি ও পারস্পরিক দোষারোপের বিষাক্ত তির ছুড়তে থাকেন। ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। এখন যাঁরা পুরান ঢাকায় দাহ্য পদার্থের ব্যবসা করেন, তাঁদের অনেকেই তখনো তা করেছেন। বিএনপি সরকার কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে তার প্রমাণ নেই। চুড়িহাট্টায় দুর্ঘটনার জন্য অনেকের মতো বিএনপি নেতারাও সরকারের অব্যবস্থাপনার সমালোচনা করেন। তার জবাবে এক মন্ত্রী বলেছেন, বুধবারের অগ্নিকাণ্ডে বিএনপির হাত আছে।

বিএনপির নেতাদের সমালোচনামূলক বক্তব্যে আওয়ামী লীগ ও সরকারের এক বালুকণা সমান ক্ষতি হয়নি। কিন্তু মন্ত্রীর বক্তব্যে আওয়ামী লীগ ও সরকারের খুবই ক্ষতি হলো। কোনো ক্ষমতাসীন দলের জনগণের মধ্যে ভাবমূর্তির ক্ষতি হলে বাইরে থেকে দেখা যায় না। যেমন কোথাকার বাতাসে অক্সিজেন কম, কোথাকার বাতাসে বেশি তা চোখে দেখা যায় না। সব ব্যাপারে নোংরা রাজনীতি মানুষ ঘৃণা করে।

দুটি সংস্থা এই মহানগরের হর্তাকর্তা: সিটি করপোরেশন এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের জন্য রাজউকের অনুমোদন প্রয়োজন। রাজউক তার দায়িত্ব সুকৌশলে পালন করে ‘শর্ত সাপেক্ষে অনুমোদন’ প্রদানের মাধ্যমে। তবে বাস্তবে ভবনটি ‘শর্ত’ মেনে নির্মিত হলো কি না, তা বিধাতা ছাড়া রাজউকের কর্মকর্তাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়।  

রাজউক যে বসে থাকে তা নয়। নানা রকম প্রকল্প তাকে রচনা করতে হয়। যেমন তার ‘আরবান ল্যান্ড রিডেভেলপমেন্ট’ (নগরে ভূমি পুনঃ উন্নয়ন) প্রকল্প। এই
প্রকল্প পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের সমর্থন পায়নি। সমর্থন না দেওয়ার পেছনে তাঁদেরও যুক্তি আছে। পুরান ঢাকাকে ‘ঢেলে সাজানো’ সম্ভব নয়। চিরকাল কোনো এলাকা এক রকম থাকে না। তার অর্থ এই নয় যে অতীতের সব স্থাপনাকে ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করতেই হবে। এলাকার চরিত্র অক্ষুণ্ন রেখে রাস্তাঘাট ও অন্যান্য আবশ্যকীয় স্থাপনার সংস্কার করে নাগরিক সুবিধা কীভাবে বাড়ানো যায়, সেটাই বাস্তবসম্মত এবং ইতিহাসসম্মত।

পুরান ঢাকায় বহুতল ভবনের অনুমতি কারা দিয়েছে? যদি রাজউক দিয়ে থাকে এবং রাজউকই দেয়, তারা কোন নীতির ভিত্তিতে দেয় তা জানা দরকার। কোন নগরপরিকল্পনাবিদ তাদের পরামর্শক, তা–ও জানা প্রয়োজন। রাজউক যদি দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান হতো, তাহলে তার ওপর মানুষের আস্থা থাকত।

বর্তমানে পুরান ঢাকায় প্রতি একর জমিতে ৬০০ মানুষ বাস করে। পৃথিবীর সব প্রাচীন নগরীর ঐতিহ্য রক্ষার ব্যবস্থা আছে। কয়েক শতাব্দী যাবৎ পুরান ঢাকায় বিশেষ সামাজিক ব্যবস্থা, নিজস্ব অর্থনীতি অর্থাৎ ব্যবসা-বাণিজ্য ও সংস্কৃতি রয়েছে। সেখানকার বাড়িঘর আবাসিক ও বাণিজ্যিক দুভাবেই ব্যবহৃত। দোকানপাট ছাড়াও ছোট ছোট কারখানা রয়েছে দীর্ঘকাল যাবৎ। অবাস্তব ‘রিডেভেলপমেন্ট’ প্রকল্প ইতিহাস-ঐতিহ্যের পরিপন্থী। কথায় কথায় সিঙ্গাপুর, কোরিয়া, জাপান ও তাইওয়ানের দৃষ্টান্ত ঢাকা নগরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

দেশে রাসায়নিক পদার্থ ও প্লাস্টিকের কারখানা প্রায় ৪৫০টি। তার অনেকগুলো পুরান ঢাকায়। ঘিঞ্জি অলিগলির পুরান ঢাকা থেকে সেগুলো সরানোর ব্যবস্থা করতেই হবে। সে জন্য কেরানীগঞ্জে পরিকল্পিত কেমিক্যাল পল্লি স্থাপন করার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর বলে একটি জিনিস রয়েছে ব্রিটিশ আমল থেকেই। তার সদ্য অবসরপ্রাপ্ত এক মহাপরিচালক প্রথম আলোতে এক সাক্ষাৎকারে অনেক মূল্যবান পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘নিমতলীর পরে কেরানীগঞ্জে রাসায়নিক গুদামঘর সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। আপনারা কি কখনো সেখানে পরিদর্শনে গিয়েছিলেন?’ মহাপরিচালক সাফ জবাব দেন, ‘না, আমরা কখনো যাইনি।’ এই না যাওয়াতে কর্তব্যের অবহেলা হয়েছে কি না, আমাদের মতো নাগরিকদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়।

বিশ্বের সব বিখ্যাত সংবাদমাধ্যমে আগুনের খবর ফলাও করে প্রচারিত হওয়ায় দেশের ভাবমূর্তির ক্ষতি হয়েছে। আমাদের সক্ষমতা বেড়েছে বলে প্রতিদিন গর্ব করি। আমরা ফ্রিগেট কিনি, বড় বড় স্থাপনা বানাই, কিন্তু পুরোনো স্থাপনায় বসবাসকারী মানুষকে বাঁচাতে পারি না। বাইরে বেরোলে মানুষ সড়কে পিষ্ট হয়ে মরে। ঘরে থাকলে বেঘোরে পুড়ে মরে।

মধ্যম আয়ের দেশে মানুষের জীবনের নিম্নমানের নিরাপত্তার ব্যবস্থা লজ্জাকর।  

সৈয়দ আবুল মকসুদ লেখক ও গবেষক