গণতন্ত্র আছে, গণতন্ত্র নেই

সম্প্রতি জর্মানি সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বর্তমান মেয়াদের পর তিনি আর দায়িত্বে থাকবেন না। এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে কিছু প্রতিক্রিয়া দেখা গেলেও তেমন শোরগোল শোনা যায়নি। আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতাকে বলতে শোনা গেছে, দেশে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই।

শেখ হাসিনা যদি সত্যি সত্যিই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, নিশ্চয়ই তিনি একই সঙ্গে একটি ‘এক্সিট প্ল্যান’ বা প্রস্থান পরিকল্পনার কথা ভাবছেন। অবশ্য এখনো যথেষ্ট সময় আছে। সবকিছু ঠিকঠাকমতো চললে ২০২৩ সালের শেষে আবার যখন জাতীয় নির্বাচন হবে, তখন বা তার কিছুদিন আগে হয়তো বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে।

তবে এটা ঠিক যে তিনি সিদ্ধান্ত বদলাতে পারেন। অতীতেও এমন হয়েছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে সব পূর্বাভাস ভুল প্রমাণ করে বিএনপি
একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করেছিল। নির্বাচনে হেরে যাওয়ার দায় নিয়ে শেখ হাসিনা দলের সভাপতির পদে ইস্তফা দিয়েছিলেন। তখন দলের অনেকের, বিশেষ করে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের আবেগ ও দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে নেন।

নির্বাচনে দল পরাজিত হলে দলের নেতৃত্বে রদবদল হয়, এটা পশ্চিমের দেশগুলোতে হামেশাই ঘটছে। সেসব দেশে রাজনৈতিক দলগুলো এক ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল নয়। আমাদের এ অঞ্চলের চালচিত্র ভিন্ন। এখানে দল চলে ব্যক্তি বা পরিবারের ক্যারিশমাকে কেন্দ্র করে।

স্মরণ করা যেতে পারে, আওয়ামী লীগের গত কাউন্সিল সভার আগে ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব আসবেন মুজিব পরিবার থেকেই। আমরা যদি তারও আগে ফিরে যাই, সর্বশেষ ডিগবাজিটি দেওয়ার আগে বিএনপি নেতা নাজমুল হুদা বলেছিলেন, জিয়া পরিবার থেকেই বিএনপির নেতৃত্ব আসতে হবে। এক-এগারোর পালাবদলের পর বিএনপি যখন সংকটে এবং খালেদা জিয়া অন্তরীণ, এমনকি তারেক রহমানও গ্রেপ্তার হলেন, তখন তাঁর আইনজীবী রফিকুল হক একবার বলেছিলেন, বউমাকে রাজনীতিতে নিয়ে আসতে হবে। এই ‘বউমা’ হলেন তারেকের স্ত্রী জোবাইদা রহমান। বেশ কিছুদিন আগে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর পরামর্শ ছিল, জোবাইদা রহমানকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য করা হোক। বিষয়টি এখনো আলোচনায় আছে কি না, জানি না।

এটা ঠিক যে আওয়ামী লীগের মধ্যে শেখ হাসিনার বিকল্প এখনো গড়ে ওঠেনি। একই সঙ্গে এ প্রশ্নটিও চলে আসে, সরকার পরিচালনায় দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কোনো বিকল্প আছে কি না। ১৯৯১ থেকে বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ পালাক্রমে সরকার পরিচালনা করে আসছিল। তখন ছিল অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনের রেওয়াজ, যাতে ছেদ পড়ে ২০১৪ সালে।

২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগ একটানা ক্ষমতায় আছে। রাজনীতির এখন যা হালচাল, তাতে এই ধারা অব্যাহত থাকবে। এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ জানানোর বা মোকাবিলা করার মতো রাজনৈতিক দল দেশে আর নেই।

অনেকেই মনে করেন, বিএনপি অনেক জনপ্রিয় দল। এযাবৎ দলটি ছিল আওয়ামী লীগের একক বিকল্প এবং এখনো তা প্রযোজ্য। মুশকিল হলো, ইচ্ছাপূরণের শক্তি দিয়ে সবকিছু জেতা যায় না। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘ইফ উইশেস অয়ার হর্সেস, অল বেগার্স উড রাইড’ (ইচ্ছেগুলো যদি ঘোড়া হতো, তাহলে সব ভিখিরিই ঘোড়ায় চড়ত)। কথাটা শুনতে খারাপ লাগতে পারে। কিন্তু এটিই বাস্তবতা। বিএনপি আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে বলে মনে হয় না। আওয়ামী শাসনের বিরুদ্ধে যত ক্ষোভ বা নালিশ থাকুক না কেন, মানুষ দলে দলে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে পথে নেমে একটি গণ–অভ্যুত্থান ঘটিয়ে দিয়ে বিএনপিকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে না। এ দেশে আরেকটি ‘উনসত্তর’ বা ‘নব্বই’ হওয়ার সম্ভাবনা আপাতত দেখি না।

বিরোধী দলগুলোর একটি বড় নালিশ হলো, আওয়ামী লীগ প্রশাসনকে কবজা করে জোরজবরদস্তি করে নির্বাচনে জিতেছে। নাম ঘরানার দলগুলোও একই সুরে কথা বলছে। অথচ মার্ক্সীয় দর্শনের অ আ ক খ সম্বন্ধে যাঁদের ন্যূনতম ধারণা আছে, তাঁরা জানেন, ‘রাষ্ট্র হচ্ছে একটি বলপ্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠান এবং এটি ধনিকশ্রেণির (বুর্জোয়া) দখলে।’ সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির বিরোধকে তো ধনিকশ্রেণির মধ্যকার দ্বন্দ্ব হিসেবেই দেখতে হয়। এখানে বামদের লাভ কী, যদি না তারা নিজ শক্তিতে নিয়ামক হয়ে উঠতে পারে। আমি তার আশু সম্ভাবনা দেখি না। বাম দলগুলো একে অন্যকে খারিজ করে দেয়। তাদের মধ্যে অগুনতি দল-উপদল এবং সবাই মনে করে, তারাই সাচ্চা, অন্যরা হঠকারী বা সুবিধাবাদী। এই যখন অবস্থা, তখন নৌকার পালে বাতাস তো লাগবেই। এবং তা তরতরিয়ে চলবে উজানপথে কিংবা ভাটির দিকে।

বছরখানেক আগে একটা কলামে আমি মন্তব্য করেছিলাম, দেশ এখন ‘মাহাথির যুগে’ প্রবেশ করেছে। প্রবণতাটি হলো, দীর্ঘ মেয়াদে সরকারে থাকা। অনুষঙ্গ হলো ‘উন্নয়ন’। কোনো একটি দল বা গোষ্ঠী যদি দীর্ঘকাল সরকার চালায়, উন্নয়ন তো হবেই। আমরা এ দেশে এ ধরনের উন্নয়নের ঢেউ দেখেছি তিনবার। প্রথমবার ছিল ষাটের দশকজুড়ে আইয়ুব খানের ‘উন্নয়ন দশক’। দ্বিতীয় ঢেউটি এসেছিল আশির দশকে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জমানায়। এখন আমরা তৃতীয় ঢেউয়ের মধ্যে আছি। এই পর্বটি সহসা শেষ হবে বলে মনে হয় না। কারণ একটিই, কে জানাবে চ্যালেঞ্জ।

প্রশ্ন উঠতে পারে, বিএনপির ভবিষ্যৎ কী? একসময় শেরেবাংলার দল কৃষক প্রজা পার্টির (পরে নাম হয় কৃষক-শ্রমিক পার্টি) যথেষ্ট প্রতাপ ছিল। তাঁর জীবনকালেই এটি নিঃশেষিত হয়ে যায়। দলের সাইনবোর্ডটি টিকে ছিল ১৯৭০ সাল অবধি। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) একসময় আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। টুকরো টুকরো হয়ে এখন আর তার অস্তিত্ব নেই। যে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, এখন তাকে খুঁজতে হলে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের দরকার হবে। সত্তরের দশকে, বিশেষ করে ১৯৭২-৭৫ সালে রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়ানো দল ছিল জাসদ। এখন সেটিও ছয় টুকরো হয়ে অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে। এ উদাহরণগুলো আছে বলেই শঙ্কা হয়। বিএনপির পরিণতি এমন হবে না তো?

দেয়ালের চিকা বা লিফলেটে আগুন ঝরানো শব্দ বসিয়ে দেশ পাল্টে দেওয়া যায় না। কোনো কোনো ক্যাম্পাসে কোনো কোনো ছাত্রসংগঠনের দেয়াললিখন পড়লে মনে হয়, পুরো দেশই বুঝি সমাজতন্ত্রীদের দখলে।

দেশে রাজনীতির ব্যাকরণ পাল্টে যাচ্ছে। পুরোনো সূত্র আর কাজে আসছে না। এ নিয়ে একাডেমিক আলোচনা-বিশ্লেষণ তেমন নেই। মাঝেমধ্যে টক শোতে কোটেশন-কণ্টকিত বোলচাল শুনি। এর মধ্যেই হাহাকার—দেশে ‘গণতন্ত্র’ নেই। প্রশ্ন হলো, এই গণতন্ত্র কখন ছিল? শাসকেরা সব সময় বলেন, তাঁরা গণতন্ত্র দিয়েছেন। টেবিলের অন্য পাশে যাঁরা বসে আছেন, তাঁরা মনে করেন, গণতন্ত্র নেই। আমার মনে হয়, এ তর্কের শেষ নেই।

মহিউদ্দিন আহমদ : লেখক ও গবেষক