নারীর সাহিত্য কি গণ্ডিবদ্ধ?

বিখ্যাত গীতিকার সলিল চৌধুরীর একটা গান ‘আজ নয় গুনগুন গুঞ্জন প্রেমে, চাঁদ ফুল জোছনার গান আর নয়, ওগো প্রিয় মোর খোল বাহুডোর, পৃথিবী তোমারে যে চায়’। গানটা মনে পড়ল এ কারণে যে এ দেশের নারী সাহিত্যিকদের উদ্দেশেও তা নিবেদন করা যায়। অবশ্যই যাঁরা প্রিয় বাহুডোর উপেক্ষা করে নিজের পৃথিবী গড়ে নিয়েছেন, সেই হাতে গোনা সাহসী কজনকে টানছি না বা যে কজন বলেন, ‘ও ভীষণই সাপোর্টিভ’ তাঁরাও নন। যাঁরা বলেন, ‘ঘর–সংসার, স্বামী-সন্তান সামলিয়ে লেখালেখির সময় পাই না’ বা ‘চাকরি করি, সংসার করি, বাচ্চাদের পড়াই, বয়স্কদের সেবা করি—এর মধ্যে প্রতিভা বিকাশের সুযোগ কই?’ এ রকম হতাশাগ্রস্ত প্রতিভাবানদের সংখ্যাই বেশি। এক নারী লেখক বলছিলেন, ‘রাতে সবাইকে খাইয়ে–দাইয়ে বিছানায় পাঠিয়ে একটা টেবিলল্যাম্প জ্বেলে লিখতে বসি। স্বামী বলেন তার নাকি ঘুটঘুটে আঁধার ছাড়া ঘুম হয় না। সোজা কথা তিনি মেয়েমানুষের এসব সৃষ্টিছাড়া গুণকে অনাচার ভাবেন।’ আবার ‘এক ঘরমে দো পীর’ হলে ভাঙনের শব্দও শোনা যায়।

বড় সাহিত্যিকদের জীবনী পড়লে জানা যায়, হাওয়া বদল তাঁদের মাথা খোলার জন্য জরুরি এবং লেখালেখির ইচ্ছে চাঙা করার একটি অন্যতম পন্থা। এতে নতুন নতুন রসদও সংগ্রহ করা যায়, আবার একঘেয়েয়েমিও দূর হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশের ভেতরের বিভিন্ন অঞ্চল তো বটেই, পাঁচ মহাদেশের ৩৩টির বেশি দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। এর ফলে আলাদাভাবে যেমন ভ্রমণসাহিত্যের ভান্ডার সমৃদ্ধ হয়েছে, তেমনি ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী’র মতো গান ও কথিত বিদেশিনী এখনো আমাদের যুগপৎ আনন্দ ও কৌতূহলে নিমজ্জিত রাখে। ইদানীং ফেসবুকের বদৌলতে জানা যাচ্ছে, কবি-সাহিত্যিকেরা দলবদ্ধ হয়ে মাঝেমধ্যেই আজ বরিশাল, কাল ময়মনসিংহ, পরশু নেপাল, দার্জিলিং, কাশ্মীর ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কোনো দল পাহাড়ে, কোনো দল সমুদ্রে বা পূর্ণিমা রাতে নৌবিহারে। কিন্তু এসব দলে নারী লেখকের সংখ্যা কোনো কোনো ক্ষেত্রে নগণ্য, অধিকাংশ ক্ষেত্রে শূন্য। নারীরা দলবদ্ধ হয়ে একেবারে বেরোচ্ছেন না তা নয়। তবে সেসব দলের শ্রেণি, সামাজিক অবস্থান, শিক্ষা, বয়স এবং বেড়ানোর উদ্দেশ্য কেবল লেখক নারীর চাহিদা পূরণে বিবেচিত নয়।

যে দেশে ২৪ ঘণ্টার পুরোটাই পুরুষের গতিবিধির জন্য বরাদ্দ, নারীর জন্য মাত্র আট-দশ ঘণ্টা, তা–ও খুব সুবিধাপ্রাপ্ত নারীদের, সেখানে বুকের মধ্যে আত্মপ্রকাশের ঘোড়াটার গলায় লাগাম দেওয়া ছাড়া কী করার আছে? রাতে সব কাজ শেষে ভাবুক বউটি হয়তো জানালা দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে তাঁর ভাবনাগুলোকে দল মেলাতে চাচ্ছেন, তখনই শাশুড়ি-ননদের কেউ বলবেন, ‘ওমা! এখনো জেগে বসে আছ? কাল ভোরে ছোট মেয়ে-জামাই আসবে, খোকা ট্যুরে যাবে, সোনামণিদের ইশকুল। যাও যাও একটু ঘুমিয়ে নাও। শরীর বলে কথা!’

আহা! ঘরেই নারী সময় পান না, তিনি করবেন রাত-বিরেতে নদীর মধ্যে গুরুসঙ্গ?

তাহলে যাঁরা একদিকে বলেন নারীর লেখায় বৈচিত্র্য নেই, নারীর লেখা গণ্ডিবদ্ধ, আবার অন্যদিকে খোলামেলা প্রথাবিরোধী নারী লেখককে বলেন, ‘বাপ রে! পুরুষালি হাত। নারীর লেখা মনেই হচ্ছে না’—তাঁরা আসলে কী চান? এ কথা বলাই বাহুল্য যে তাঁরা ঝোলেও আছেন, আবার অম্বলেও। একদিকে চান নারীরা নারীর লক্ষণরেখা অতিক্রম না করে যেমন লিখছেন, তেমনই লিখতে থাকুন যাতে সাহিত্যিক হিসেবে উপেক্ষার পাত্রই থাকেন। আবার যখন কিছু বাঁধভাঙা নারীর লেখা তাঁদের গাত্রদাহের কারণ ঘটায় তখন সাহিত্য সমাজে উদারপন্থী হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিরা বাহবা দেন। কিন্তু পুরুষের সমকক্ষ ব্যতিরেকে আরও উঁচুতে ওঠাতে নারাজ। অসূয়াপ্রাপ্তরা সমানে চরিত্র তুলে গালাগালি করতে থাকেন।

সমাজ-সংসারের কারণেই নারী গণ্ডিবদ্ধ। একজন নারী সাহিত্যিককে তাঁর লেখার মান নিয়ে সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌঁছাতে যত কাঠখড় পোড়াতে হয়, পুরুষ সাহিত্যিককে ততটা নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে শিল্পাঙ্গনের অনেক ঘটনা-অঘটনার বিশ্লেষণ চলতে থাকে পরবর্তী মুখরোচক সংবাদের আগমনের আগ পর্যন্ত। ঘটনা এ রকম, একবার এক নারী সাহিত্যিক পুরুষ সাহিত্যিকদের আয়োজিত আড্ডায় রাতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এটাকে তথাকথিত উদারপন্থীরা স্বাগত জানালেও যাঁরা নীচতার মনোজগৎ থেকে বেরোতে পারেননি, তাঁরা সেই নারীকে ঘিরে মনগড়া অশালীন কাহিনির অবতারণা করলেন। নারী নাক-কান মলে প্রতিজ্ঞা করলেন আর ভুলেও কোনো দিন ও রকম আড্ডায় পা রাখবেন না।

সাহসী নারী শিল্পী-সাহিত্যিকেরা কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে তাঁদের কাজের ক্ষেত্রে গণ্ডি ভাঙছেন। তাঁদের সৃষ্টি আমাদের বিস্মিত করছে। কারণ, শিল্প-সাহিত্যের জগতে নারীর অবাধ পদচারণের বয়স পুরুষের হাঁটুর বয়সী। গণমাধ্যমে তাঁদের কথোপকথন বুদ্ধিদীপ্ত, পরিপক্ব ও পরিশীলিত। সেখানে দীর্ঘদিনের অনুশীলিত অনেক পুরুষ সাহিত্যিককেও প্রাজ্ঞতায় খানিক খর্ব বোধ হয়। অবশ্য অনেকের অনুকূল পরিবেশ ও অনুপ্রেরণাদায়ী সঙ্গীর অবস্থান চলার পথকে আরও মসৃণ করে। উত্তম মানুষে (ব্যাকরণের ‘উত্তম পুরুষ’ লিঙ্গনিরপেক্ষ হওয়া বাঞ্ছনীয়) রচিত নারীর সাহিত্য একই আঙ্গিকে রচিত পুরুষের সাহিত্যের মতো করে বিবেচনা করতে হবে। এ ধরনের আঙ্গিককে সাহিত্যিকদের আত্মজীবনী ভেবে ব্যক্তিগত আক্রমণ সুপাঠকসুলভ আচরণ নয়। এ আঙ্গিকের নারী সাহিত্যিককে আরও বেশি সমালোচনায় বিদ্ধ হতে হয়। কিন্তু আশার কথা, কোনো খিস্তিখেউড় গায়ে না মেখে এসব পথিকৃৎ অকুতোভয় নারী অনুসরণীয় হয়ে উঠছেন ওই সব নারীর জন্য, যাঁরা ‘পাছে লোকে কিছু বলে’—এর দলে ছিলেন। বাইরে বেরোলে প্রকৃতি, মানুষ ও সতীর্থের সাহচর্যে ভাবনার জগৎ, অভিজ্ঞতার ভান্ডার সমৃদ্ধ হয়—এ তো সত্যি। কিন্তু ভয়ার্ত শৈশব, অব্যক্ত কৈশোর, বৈষম্যের যৌবন, অতৃপ্তির দাম্পত্য, সামাজিক নিষ্পেষণ যে বিষয়বৈচিত্র্য হাজির করে তা কেন সাহসের অভাবে নারী সাহিত্যিককে গণ্ডিবদ্ধের অপবাদে কলঙ্কিত করবে?

উম্মে মুসলিমা সাহিত্যিক