ভেনেজুয়েলা সিরিয়া নয়, মাদুরো আসাদ নন

ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরো
ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরো

অনেকে দাবি করলেও এটি ঠিক যে ভেনেজুয়েলার বর্তমান প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরো সিরিয়ার বাশার আল-আসাদ নন এবং ভেনেজুয়েলাও সিরিয়া, লিবিয়া বা ইরাক নয়। আসলে ভেনেজুয়েলার চলমান পরিস্থিতির ওপর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির লেন্স প্রয়োগ করা অত্যন্ত বিপজ্জনক না হলেও অযৌক্তিক। কলম্বিয়া ও ব্রাজিলের সঙ্গে ভেনেজুয়েলার সীমান্তে উত্তেজনা এখন যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা সেখানে যুদ্ধের দামামা বাজানো শুরু করে দিয়েছে।

মার্কিন-সমর্থিত অভ্যুত্থানের চেষ্টা এখন জোরসে এগিয়ে চলেছে এবং ওয়াশিংটনের পৃষ্ঠপোষকতায় সামরিক অভিযানও এখন সময়ের ব্যাপার। তাই এখন আর আমরা ফালতু বিশ্লেষণে অলস সময় কাটাতে পারি না। অতীতের রেকর্ড দেখায় যে অভ্যুত্থান ও সামরিক হস্তক্ষেপ কেবল দুর্যোগই নিয়ে এসেছে এবং বিবেকবান মানুষের উচিত যেকোনো মূল্যে তা প্রতিহত ও প্রত্যাখ্যান করা।

১৯৭৩ সালে চিলিতে সালভাদর আয়েন্দেকে উৎখাত করা এবং অগাস্তো পিনোশের উত্থান থেকে শুরু করে ২০০৯ সালে হন্ডুরাসে ম্যানুয়েল জেলায়ার অপহরণ এবং বামপন্থী ও কেন্দ্রীয় বাম সরকারগুলোর বিরুদ্ধে মার্কিন-সমর্থিত অভ্যুত্থানের ফলে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো ও সেসব দেশের প্রতিষ্ঠানসমূহ ও জনগণের ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতি হয়েছে। ভেনেজুয়েলায় এই ধরনের কিছু হলে তার চেয়ে ভিন্ন কিছু হবে না।

আমি বলতে চাই, ভেনেজুয়েলা স্পষ্টতই কোনো সমাজতান্ত্রিক স্বর্গ নয়। এটা অনস্বীকার্য যে ভেনেজুয়েলার বর্তমান সমস্যাসমূহ হলো: চরম অর্থনৈতিক সংকট, অপরাধের ক্রমবর্ধমান হার ও ব্যাপক দুর্নীতির জন্য মাদুরোর সরকার আংশিকভাবে হলেও দায়ী।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল যেমনটি উল্লেখ করেছে, মাদুরো ও তাঁর পূর্বসূরি প্রয়াত হুগো চাভেজ উভয়েরই কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং বিচার বিভাগের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপের ইতিহাস রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভেনেজুয়েলায় রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, যেগুলোতে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো জড়িত ছিল, যার পরিণতিতে বিক্ষোভকারীদের মৃত্যু অথবা কারাবাস হয়েছে। এ ছাড়া ভেনেজুয়েলার সরকার বেশ কয়েকটি স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছে এবং ২০১১ সালে আরব বসন্তের পর সিরিয়া ও লিবিয়ার শাসনকে সমর্থন দিয়েছে।

যদিও এসব সমস্যা জনসমক্ষে আসা এবং সমালোচিত হওয়া উচিত, তবে তাই বলে মাদুরোকে বাশার আল-আসাদ, মুয়াম্মার গাদ্দাফি বা সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে তুলনা করা উচিত হবে না। এই একনায়কেরা যেভাবে ক্ষমতায় এসেছেন, মাদুরো সেভাবে আসেননি। তিনি কোনো সামরিক অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেননি বা পারিবারিকভাবে ক্ষমতায় আসেননি। তিনি গণতান্ত্রিকভাবে দুবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন।

হুগো চাভেজ প্রতিষ্ঠিত বলিভারিয়ান রেভল্যুশনারি মুভমেন্ট ও যেসব বাহিনী আরব একনায়কদের সমর্থন দিচ্ছে—এই দুইয়ের মধ্যে খুব সামান্যই মিল রয়েছে। মাদুরো এখন এই আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব করছেন।

এই আন্দোলন একটি গণতান্ত্রিক, বামপন্থী, জনপ্রিয় আন্দোলন, যার মূল কথা হচ্ছে দরিদ্রদের উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের জন্য রাষ্ট্রের সম্পদ বিনিয়োগ করা। এই আন্দোলনের উত্থান হয়েছিল স্প্যানিশ বংশোদ্ভূত শ্বেতাঙ্গ ও অভিজাত ভেনেজুয়েলানদের হাতে কৃষ্ণাঙ্গ, দরিদ্র ও আদিবাসী জনগণের নিপীড়িত ও শোষিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে। মার্কিন হস্তক্ষেপ বিপর্যয়কর অর্থনৈতিক নীতিসমূহের (যা ওয়াশিংটন লাতিন আমেরিকার ওপর চাপিয়ে দিতে চাইত) কারণে ওই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল।

এই আন্দোলনের মাধ্যমে ২০০০ সালের গোড়ার দিকে হুগো চাভেজের সরকার লাখ লাখ প্রান্তিক ভেনেজুয়েলানের জীবনমানের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হয়। সরকার তাদের স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, খাদ্যনিরাপত্তা ও সামাজিক নিরাপত্তা দিতে সমর্থ হয়।

এসব কারণে চাভেজ অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলেন এবং চারবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। মারা যাওয়ার আগে তিনি মাদুরোকে তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে নির্বাচিত করেছিলেন, যিনি তাঁর প্রথম নির্বাচনে সামান্য বেশি ভোট পেয়ে জিতেছিলেন। ২০১৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ভেনেজুয়েলার বর্তমান সংকটের মূল উৎস। ওই নির্বাচনে মাত্র ৩০ শতাংশ ভোট পড়ে বিরোধী প্রার্থীদের পক্ষে।

বিরোধী নেতারা ব্যর্থ অভ্যুত্থানচেষ্টার মাধ্যমে অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু করে এবং নির্বাচন বর্জনের মাধ্যমে মাদুরোর সরকারকে অবৈধ প্রমাণ করতে চেয়েছে। অতীতেও বিরোধীদের এ ধরনের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। যাহোক, বিরোধীদের এই অর্থনৈতিক যুদ্ধের পাশাপাশি মাদুরো প্রশাসনের অব্যবস্থাপনা এবং তেলের দাম কমে যাওয়া সব মিলিয়ে পরিস্থিতিকে জটিল করে তোলে।

বস্তুত মাদুরো সরকারের অনেক ভুল আছে, কিন্তু এটা কোনো স্বৈরতান্ত্রিক সরকার নয়। তাই আমাদের অবশ্যই মার্কিন দখলদারির এ চেষ্টাকে প্রত্যাখ্যান করতে হবে।

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

হুসেইন ওয়ালিদ লন্ডনভিত্তিক ব্রিটিশ-ফিলিস্তিনি লেখক