এখন উপায় বলো না

দোষারোপের সব আঙুল এখন পুরান ঢাকার পুরান ব্যবসায়ী আর পুরান অধিবাসীদের দিকে। যে যেমনভাবে পারছেন দোষ চাপিয়ে যাচ্ছেন। সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট হারবাট হামফ্রে একবার বলেছিলেন, ‘মানুষমাত্রই ভুল করে আর রাজনীতিবিদমাত্রই অন্য কারও ওপর দোষ চাপিয়ে দেয়।’ রাজনীতিবিদদের গলাবাজির জন্যই হোক আর টক শোর ক্যারিশমাতেই হোক, মানুষ বিশ্বাস করছে, ঢাকার এসব অর্বাচীন আপদ বুড়িগঙ্গা পার করে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ঠিক এ রকম ভাবনা থেকেই একদিন গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড তিন টুকরা করে তিন প্রান্তে পাঠিয়ে দিয়ে গুলিস্তানের যানজট নিরসনের আওয়াজ মানুষ বিশ্বাস করেছিল। না, গুলিস্তান ফাঁকা হলো না, খালি থাকল মহাখালী, গাবতলী, সায়দাবাদ—সবখানে চলছে শুধুই যানজটের আবাদ। লন্ডনের ভিক্টোরিয়া স্টেশন ১৮৫০ সাল থেকে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। বাস, রেল, পাতালরেল সব আসছে, ছেড়ে যাচ্ছে—কোনো গ্যাঞ্জাম নেই। পুরান ঢাকার সরু গলি মোটা করার দাওয়াই নিয়ে চ্যানেল টিভিগুলোর স্টুডিও গুলজার করছেন একদল সোজা কথার মানুষ। স্পেন, পর্তুগাল, ইংল্যান্ড, ইতালি এমনকি ফ্রান্সের অনেক পুরোনো শহরে ঢাকার চেয়ে চিকন অলিগলি-রাস্তা আছে, থাকা-খাওয়ার ব্যবসা সবই চালু আছে সেখানে। আমরা যানজটের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে গাছপালা কেটে, সড়ক চওড়া করে তার নাম দিয়েছি ভিআইপি রোড। ‘ছোট লোক’ রিকশাওয়ালাদের জন্য নিষিদ্ধ করেও কি সেই সড়ক থেকে যানজট মুছে দিতে পেরেছি? সেসব সড়কেই এখন বেশি নাকাল হচ্ছি না? উড়ালসেতু দিয়ে কি আমাদের ঘাম বেশি ছুটছে না? বনানীর শাহীন স্কুল, সোনারগাঁও হোটেল আর বেইলি রোডের উড়াল ল্যান্ডিং পয়েন্টগুলো এখন গোদের ওপর বিষফোড়া হয়ে উঠেছে।

ঢাকার বুড়িগঙ্গা বাঁচাতে আমরা বুড়িগঙ্গা উৎসমুখে হাজারীবাগকে টেনে নিয়ে গেলাম। ধলেশ্বরীর যে ধারাটি বুড়িগঙ্গায় পানি পাঠাত, সেটা গেল চিরতরে। পরিবেশবাদীরা কি কেউ জানেন এখন ধলেশ্বরীর কী অবস্থা? কী হয়েছে পাশের নদী কর্ণতলীর কর্ণপাড়া খালটা কোথায় গেল হারিয়ে? পরিশোধন-প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ হাজারীবাগে যতটা সহজ ছিল, এখন সাভারে গিয়ে সেটা করা ততটাই কঠিন। লাভের লাভ নষ্ট নদীর তালিকায় যুক্ত হলো ধলেশ্বরীর নাম। ধলেশ্বরীর কান্না কে শুনবে, ধলেশ্বরী কি কেবলই একটা জলনিকাশি পগার? আদালত বলছেন, জীবন্ত প্রাণসত্তা হিসেবে মান্য করতে হবে নদীকে। নদী হত্যা প্রাণ হত্যার শামিল। এই খুনের বিচার কে করবে? অভিযোগ না পেলে কী করবে পুলিশ? নদী কমিশন কি শুধুই একটা সাইনবোর্ড?

তবে কি রাসায়নিকের গুদাম শোবার ঘরের পাশেই থাকবে?
টক শো তারকাদের কেমিক্যাল সরাও সরাও শুনতে শুনতে বুয়া গুলজান জানতে চাইলেন, ‘মামা, কেরানীগঞ্জ কি বাংলাদেশে? ওখানে কি মানুষ থাহে না?’ তাঁর ধারণা, বাংলাদেশের কোথাও আর ফাঁকা জায়গা নেই, মানুষে মানুষে গাদাগাদি করে থাকে, যেখানে যে পারে। বুয়া গুলজানের ধারণা হয়তো খাপেখাপ ঠিক নয়, তবুও ঠিক। নতুন জায়গায় কারখানা, গুদাম, দোকান বসলে মানুষের বসতি গড়ে উঠবে। তারা চেষ্টা করবে কাজের জায়গার যত কাছে থাকা যায়। বস্তি, বসতি কিছুই ঠেকানো যাবে না। দরকার আগুন নিয়ন্ত্রণ আর প্রতিরোধের একাটা বিজ্ঞানসম্মত কিন্তু জনভিত্তিক ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা। কেরানীগঞ্জে যেন সাভারের মতো ‘ভুল’ না হয়, সেটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে।

জনভিত্তিক ব্যবস্থাপনা আবার কী?
এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের দমকল বাহিনীর নামের মধ্যেই আছে। তাদের অধিদপ্তরের নাম ‘বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর’। ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে সিভিল ডিফেন্স, অর্থাৎ যাদের জন্য আগুন লাগে আর যাদের বাঁচাতে ঘণ্টা ভেঁপু-সাইরেন বাজিয়ে দমকলের সদা প্রস্তুত কর্মীরা ছোটেন সেই জনগণকে সম্পৃক্ত করে একটা সমাজভিত্তিক আগুন প্রতিরোধ ও প্রতিকার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে। সিভিল ডিফেন্স ব্যবস্থার আওতায় কয়েকটি ওয়ার্ডেন ভাগ করে পোস্টভিত্তিক স্বেচ্ছাসেবক দল গড়ে তোলার কথা। এসব প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক ফায়ার সার্ভিসের অগ্রবর্তী দল হিসেবে কাজ করবেন। এলাকার মানুষের আগুনের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন করে তুলবেন। নিয়মিত মহড়ার আয়োজন করবেন। এলাকায় স্থাপিত হাইড্রেন্ট বা পানির উৎসমুখগুলোর দেখভাল করবেন আর আগুনের ঝুঁকি বাড়ার মতো কিছু ঘটলে ফায়ার সার্ভিসের কর্তাদের জানাবেন। ফায়ার সার্ভিসের সব কর্মকাণ্ড দিন দিন শক্তপোক্ত হলেও কোনো এক অথবা একাধিক কারণে সিভিল ডিফেন্স অংশটি দিন দিন হাড্ডিসার হয়ে যাচ্ছে । অনেকে ভুলেই গেছেন ওয়ার্ডেন পোস্ট কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবকের কথা। খুব সহজেই আমাদের বহুল আলোচিত আর বুক ফুলিয়ে বলে বেড়ানো আরবান ভলানটিয়ার কর্মসূচিকে সিভিল ডিফেন্সের সঙ্গে একীভূত করা যেতে পারে। তবে সংশ্লিষ্ট দুই মন্ত্রণালয় (স্বরাষ্ট্র আর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়) যদি বিশ্বাস করে হাজারটা মন্ত্রণালয় থাকতে পারে, কিন্তু দেশ একটাই আর দেশটা মানুষের জন্য, তাহলে এই একীভূতের কাজটি এক মিটিংয়েই করা সম্ভব।

এটা করতে পারলে আমাদের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের আরাধ্য স্বপ্ন বা ভিশন ‘অগ্নিকাণ্ডসহ সব দুর্যোগ মোকাবিলায় এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান হিসেবে সক্ষমতা অর্জন’ সহজেই সম্ভব হবে।

ভারতের ওডিশা, চীন, লাওস, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমারে অনেক দিন থেকে সমাজভিত্তিক আগুন ব্যবস্থাপনা সাফল্যের সঙ্গে কাজ করে আসছে। শহর হোক বা গ্রাম, মিয়ানমারে এমন একটি বাড়ি বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে আগুনকে প্রাথমিক পর্যায়ে নিভিয়ে ফেলার কার্যকর ব্যবস্থা নেই। আগুন ব্যবস্থাপনার ব্যবহারসামগ্রী প্রত্যেককে তার বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিগ্রাহ্য স্থানে ব্যবহার উপযোগী অবস্থায় রাখতে হয়। আমরা কথায় কথায় বিদেশের উদাহরণ দিয়ে থাকি, যাতে বিশ্বাস জন্মায় প্রস্তাবটা আজগুবি নয় । তবে সমাজভিত্তিক আগুন ব্যবস্থাপনা নিয়ে যশোর শহরে আর মেহেরপুরের গ্রামে সামাজিক উদ্যোগ অনেক দিন থেকে বেশ সফলতার সঙ্গে কাজ করছে।

আশ্বাসে কি বিশ্বাস আছে?
সাবেক ফরাসি প্রেসিডেন্ট জেনারেল দ্য গল একবার বলেছিলেন, ‘যেহেতু রাজনীতিবিদেরা নিজেরাই নিজেদের কথা বিশ্বাস করেন না, তাই অন্য কেউ যে সেটা বিশ্বাস করতে পারে, সেটা তাঁরা ভাবতেই পারেন না; তবুও কথা বলেন।’ তবে আমরা দ্য গলকে নয়; বরং আমাদের রাজনীতিবিদদের বিশ্বাস করতে চাই। তা ছাড়া আমাদের বিকল্পই বা কী আছে? তাঁরা বলেছেন, ওঁরা যাননি। ওঁরা বলেছেন, আমাদের নেয়নি। দুটোই তো আর ঠিক হতে পারে না! দাবি করা হচ্ছে রাসায়নিক দ্রব্য সরানো শুরু হয়েছে, কিন্তু যাচ্ছে কোথায়? চকবাজার থেকে ওয়ারী, নারিন্দা লোহারপুল, গেন্ডারিয়া কিংবা জিন্দাবাহার। একজন তালাশ দিলেন উত্তরা, মোহাম্মদপুরেও নাকি রাসায়নিকের গুদাম আছে। কী জানি? এখন টিভিতে বসে সোফা দেখা ছাড়া আর কীই-বা করার আছে?

লেখক গবেষক