ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা

পুলওয়ামার রক্তাক্ত উপাখ্যানের বদলা হিসেবে পাকিস্তানের ভূখণ্ডে থাকা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী জইশ–ই–মুহাম্মদের ঘাঁটিতে ভারত বিমান হামলা চালানোর মধ্য দিয়ে দিল্লি একটি ‘নতুন অধ্যায়ে’ প্রবেশ করেছে। সাধারণত উভয় দেশের হামলা–পাল্টাহামলা জম্মু-কাশ্মীরের দুই দেশের অধিকৃত অংশেই হয়ে আসছিল। এবারের বিমান হামলাটি পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ডে ঘটেছে বলেই ভারতের দাবি। এই ঘটনা শুধু একটি বিচ্ছিন্ন ‘পাল্টা হামলা’ হিসেবেই প্রতীয়মান হলে একটি কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে এবার ভারত একটি নীতি প্রতিষ্ঠিত করারও দাবি করছে। তারা বলছে, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে ভারত পাকিস্তানকে কূটনৈতিক উপায়ে সম্ভব সব রকম চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিল। আর সে কারণেই তাদের ১২টি মিরাজ-২০০০ যুদ্ধবিমান দ্বারা পাকিস্তানি ভূখণ্ডে সরাসরি আক্রমণ ছিল অবিকল্প। এর রণকৌশলগত দিক বোধগম্য। কিন্তু তার থেকেও বড় প্রশ্ন উপমহাদেশ দীর্ঘ মেয়াদে একটা অশান্তির ডামাডোলে পড়ল কি না।

পাকিস্তান বলেছে, আগ্রাসন চালানোর পাল্টা ব্যবস্থার উপযুক্ত সময় ও স্থান তারা নির্দিষ্ট করবে। সুতরাং এই মুহূর্তে উভয় দেশের শান্তিপ্রিয় সচেতন জনগণের উচিত হবে, শান্তির পক্ষে সরব হওয়া। শতসহস্র কণ্ঠে আওয়াজ তোলা, যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই। বিষয়টির রাশ টানা সম্ভব না হলে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি রাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা চাপের মধ্যে পড়তে পারে। উপমহাদেশ ভাগ হয়ে গঠিত ভারত ও পাকিস্তান কালক্রমে পরস্পরকে টার্গেট করেই পারমাণবিক বোমার অধিকারী হয়েছে।আমরা দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আলী মাজরুইয়ের ভবিষ্যদ্বাণী স্মরণ করতে পারি। তিনি বলেছিলেন, বিশ্ব একটি পারমাণবিক যুদ্ধ এই দুটি দেশের মধ্যে প্রত্যক্ষ করতে পারে। আর সেটা ঘটলে ধ্বংসযজ্ঞের ভয়াবহতায় যেটা হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে দেখা গেছে, সেটা বহুগুণে ছাপিয়ে যাবে।

আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করি, বৈশ্বিক রাজনীতিতে কিছু পালাবদল, যা অনেকের কাছেই একসময় অবিশ্বাস্য মনে হতো, সেখানেও বিস্ময়কর পরিবর্তন এসেছে। উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে সাম্প্রতিক কালের মৈত্রী তার বড় উদাহরণ। অথচ এই দুই প্রতিবেশী দেশ অব্যাহত উত্তেজনার ঘেরাটোপ থেকে কখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি।

বৈশ্বিক রাজনীতিতে ভারত ও পাকিস্তানের মর্যাদা সমান নয়। ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বিশেষ মর্যাদার দাবিদার। অন্যদিকে প্রলম্বিত সামরিক বা আধা সামরিক শাসনে বিপর্যস্ত পাকিস্তান অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর আকরভূমি হিসেবে উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর চোখে দেশটি দীর্ঘকাল ধরে আসামির কাঠগড়ায়। তারা জানে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ওপর পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব আরও বেশি জেঁকে বসেছে। পারমাণবিক শক্তি যেমন তেমনি পররাষ্ট্রনীতির চালিকা শক্তির নিয়ন্ত্রণ থেকে গেছে সামরিক বাহিনীর হাতেই।

পাকিস্তানের ডন এবং ভারতের দ্য হিন্দুর সম্পাদকীয়তে আমরা দুই দেশের সরকারি মনোভাবের প্রতিফলন দেখতে পাই। ডন স্মরণ করেনি, পুলওয়ামার পরে ইসলামাবাদের কী করণীয় ছিল, তার শুধুই মনে পড়েছে ‘বিনা উসকানিতে’ সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত এসেছে, তাই নিজেকে রক্ষার অধিকার পাকিস্তানের আছে। অন্যদিকে দ্য হিন্দুর যুক্তি হলো, ওআইসি বাদে বাকি বিশ্ব ভারতের সঙ্গে। কিন্তু তারা বলেনি, সন্ত্রাস দমন ভারতের জন্য যত জরুরিই হোক না কেন একতরফা কোনো সিদ্ধান্ত কার্যকর করার অনেক সীমাবদ্ধতাও রয়েছে।

আমরা উভয় দেশের উচ্চপর্যায়ের রাজনৈতিক ও সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের কাছ থেকে সর্বোচ্চ সংযম আশা করি। একটি সন্ত্রাসী হামলা বা এর প্রতিক্রিয়ায় একটি সার্জিক্যাল অ্যাটাক—এই বৃত্ত থেকে বের হয়ে আসার পথ ভারত ও পাকিস্তানকে খুঁজতে হবে। এই সমস্যা জিইয়ে রেখে কোনো পক্ষই লাভবান হতে পারবে না। ভারতের একজন সাবেক গোয়েন্দাপ্রধান যথার্থই বলেন, যুদ্ধ কোনো পিকনিক নয়।