গণিত অলিম্পিয়াডে নতুন মাত্রা

গত শুক্রবার, ২২ ফেব্রুয়ারি ছিল গণিত অলিম্পিয়াড ঢাকা আঞ্চলিক উৎসব ও বাছাই পর্বের পরীক্ষা। সকাল ৯টায় উদ্বোধন। কিন্তু এর অনেক আগে থেকেই বনশ্রীর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণ কানায় কানায় ভরে যায়। অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের উপস্থিতিতে কলেজ এলাকা প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে। এর আগে সারা দেশের ৬৪ জেলায় বাছাইপর্ব হয়েছে। তারপর সেখান থেকে নির্বাচিত প্রতিযোগীদের নিয়ে আরও ১১টি আঞ্চলিক গণিত উৎসব ও অলিম্পিয়াড হয়েছে। ঢাকাসহ মোট ১২টি আঞ্চলিক উৎসব ও অলিম্পিয়াডে নির্বাচিতদের নিয়ে আগামী শুক্রবার ১ ও ২ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় অলিম্পিয়াড।

এবারের গণিত অলিম্পিয়াড বিশেষ মাত্রা পেয়েছে। কারণ, গত বছর রোমানিয়ায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে (আইএমও) বাংলাদেশ দল প্রথম স্বর্ণপদক অর্জন করে। আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরী এই পদক পেয়ে এক ইতিহাস সৃষ্টি করলেন। কারণ, আমরা আগে থেকেই বলছিলাম বাংলাদেশ বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় অনেক আগেই স্বর্ণপদক পাবে। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশ প্রথম যোগদানের পর মাত্র ১৩ বছরের মধ্যে স্বর্ণপদক পেয়েছে। এ রকম খুব কমই দেখা যায়। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণকারী ১৩৯ দেশের মধ্যে ৭১টি দেশ এখনো স্বর্ণপদক পায়নি। এদিক থেকে বাংলাদেশের অর্জন খুবই উচ্চ মানের।

তা ছাড়া ২০০৯ সালে, মাত্র চার বছরের মাথায় বাংলাদেশ প্রথম ব্রোঞ্জপদক লাভ করে। সে সময় নাজিয়া চৌধুরী ও সামিন রিয়াসত পদক পান। আর বাংলাদেশের ধনঞ্জয় বিশ্বাস ২০১২ সালে প্রথম রৌপ্যপদক পান। এ বছর স্বর্ণপদকের পাশাপাশি বাংলাদেশ দল আরও তিনটি ব্রোঞ্জপদক এবং দুটি সম্মানসূচক স্বীকৃতি পেয়েছে। গত বছর আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে ১১৪ নম্বর পেয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০৭টি দেশের মধ্যে দলগতভাবে ৪১তম। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। এর আগের বছর দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল প্রথম। আমরা ভারতকেও পেছনে ফেলে এসেছিলাম।

গণিতে বাংলাদেশের এই অসাধারণ অর্জন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাদেশের কৃতী শিক্ষার্থীদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধায় ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয়। এমআইটি, হার্ভার্ড, কেমব্রিজ, স্ট্যানফোর্ড প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডে আইএমও পদকপ্রাপ্ত অনেক শিক্ষার্থী স্নাতক, মাস্টার্স ও পিএইচডি করছেন।

বাছাইপর্বে প্রতিটি জেলায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল অনেক বেশি। সারা দেশে প্রায় ৫০ হাজার শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। এর একটি গভীর তাৎপর্য আছে। আমরা সব সময় বলে এসেছি, গণিত অলিম্পিয়াডকে একটি উৎসব হিসেবে গ্রহণ করব। এতে যেন পরীক্ষাভীতি না থাকে। প্রাণখোলা মনে সবাই অংশ নেবে। বনশ্রী আইডিয়াল কলেজেও দেখলাম তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণি থেকে শুরু করে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা খুব সুশৃঙ্খলভাবে মাঠে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছে। পরীক্ষা দেওয়ার জন্য এত আগ্রহ আর চোখে পড়ে না। তাও আবার গণিতের পরীক্ষা। এ থেকে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা অভিজ্ঞতা নিতে পারে। আমরা যদি শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে দাঁড় করাই, যেন শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাওয়াকে আনন্দ-উৎসবের মতো মনে করবে, তাহলে দেশের শিশু-তরুণদের শিক্ষায় গুণগত পরিবর্তন আনা সম্ভব।

এবং এটা খুবই সম্ভব। যেমন, শিশুদের প্রথম থেকেই সৃজনশীল করে তোলার বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করা যায়। আজকাল বিলাত-আমেরিকায় এভাবেই শিশুদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহী করে তোলা হয়। যেমন, প্রতিদিন একজন শিশুকে বলা হয়, বাসা থেকে সে তার পছন্দমতো যেকোনো একটি জিনিস নিয়ে আসবে। এরপর সে ক্লাসে তার বন্ধুদের সামনে নিজে বলবে সে কেন বাসা থেকে একটা বই এনেছে। সেই বইয়ের মূল আকর্ষণ কী? সেখানে কোন গল্পটা তাকে বিশেষভাবে টেনেছে। সবাই শুনে আবার প্রশ্ন করবে। উত্তর দেবে সেই শিশু। এভাবে শিশু খেলার ছলে তার কথা গুছিয়ে বলা, ব্যাখ্যা করা প্রভৃতি গুণ অর্জন করে।

যদি তা-ই হয়, তাহলে আর আমাদের মুখস্থ বিদ্যার ওপর নির্ভর করতে হবে না। কোনো বিষয় আত্মস্থ করতে যে সৃজনশীলতা দরকার, সেটা সে শিশু অবস্থা থেকেই পাবে। আমাদের নতুন প্রজন্ম শিক্ষা ও চিন্তাভাবনার দিক থেকে অনেক উন্নত অবস্থানে যাবে। বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির উদ্ভাবনী উদ্যোগের ফলেই গণিত উৎসব ও অলিম্পিয়াড আজ নতুন মাত্রা পেয়েছে। ডাচ্‌-বাংলা ব্যাংক ও প্রথম আলো সহযোগিতা দিচ্ছে। কিন্তু অসামান্য প্রাপ্তির পেছনে রয়েছে গণিতে উৎসাহী অগণিত তরুণের উদ্যম-উদ্যোগ।

গণিত হলো সব বিজ্ঞানের বিজ্ঞান। এটা অভিভাবকেরা সবচেয়ে ভালো বুঝেছেন। তাই তাঁরা সন্তানদের নিয়ে আসেন গণিত উৎসব ও অলিম্পিয়াডে। সেদিন ঢাকা আঞ্চলিক গণিত উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমার সামনের সারিতে দেখছিলাম, ছয়-সাত বছরের শিশু সাংঘাতিক গম্ভীর মুখ করে দাঁড়িয়েছে। সে হয়তো তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। তাকে লক্ষ করেই সবাইকে মনে করিয়ে দিলাম, এটি আসলে শুধু পরীক্ষা নয়, উৎসবও। ঘাবড়ানোর কিছু নেই। একটু হাসিমুখ থাকলেই এই উৎসব-সিক্ত পরীক্ষায় ভালো ফল পাওয়া যাবে। এরপরই সেই প্রাঙ্গণে হাসির ধ্বনি শোনা গেল। আসলে শিশুরা তো পরীক্ষাকে আনন্দমুখর উৎসবের মতোই দেখতে চায়। তখনই মনে সাহস আসে। অভিভাবকদের সব সময় এ কথাটা মনে রাখতে হবে।

সেদিন অলিম্পিয়াডে আসা শিশু গণিতবিদদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, ওরা অনেক বেশি আস্থাশীল। এ কথাটিই আমি সেদিন বললাম। মনে করিয়ে দিলাম, সেখানে ওরা ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রাথমিক বাছাই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এসেছে। তাই আমরা ধরে নিতে পারি তাদের প্রত্যেকেই মেধাবী ও গণিতে পারদর্শী। এটাই তাদের মনকে শক্তি জোগাবে। এই কথায় ওরা সেদিন উদ্দীপিত হয়।

ভেবেছিলাম, আমার চিন্তাটা যে সত্য, তার একটা তাৎক্ষণিক পরীক্ষা নিই। কিন্তু পরে ভাবলাম, ওরা পরীক্ষা দিতে এসেছে। একটু পরেই শুরু হবে। তার আগে আবার বাড়তি পরীক্ষা নেওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সেদিন যদি তাদের গণিতের সেই প্রশ্নটি করতাম, হয়তো সঙ্গে সঙ্গেই অনেকে একসঙ্গে সঠিক উত্তরটি বলতে পারত।

আজ সেই প্রশ্নটি এখানে লিখছি। প্রশ্নটি এ রকম: একটি ব্যাগে লাল, সাদা ও কালো—এই তিন রঙের বেশ কিছু মার্বেল রাখলাম। মার্বেলের মোট সংখ্যা জানা নেই। এখন চোখ বন্ধ করে তুমি ন্যূনতম কতটি মার্বেল তুললে নিশ্চিতভাবে বলা যাবে যে একই রঙের অন্তত দুটি মার্বেল পেয়েছ?

যদি কোনো শিক্ষার্থী এর উত্তর বের করতে পারো, প্রথম আলো অনলাইনে অথবা নিচে উল্লিখিত আমার ই-মেইলে লিখতে পারো।

আব্দুল কাইয়ুম : প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও মাসিক ম্যাগাজিন বিজ্ঞানচিন্তা সম্পাদক