বাণিজ্য-অস্ত্রে ঘায়েল হবে না মিয়ানমার

দক্ষিণ এশিয়ায় ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার পারদ আবার চড়ছে। এ বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি ভারতের কাশ্মীরের পুলওয়ামায় আত্মঘাতী জঙ্গি হামলায় ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ৪০ জন সদস্য নিহত হয়েছেন। এ জন্য পাকিস্তানের প্রত্যক্ষ মদদকে দায়ী করেছে ভারত। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে সামরিক শক্তি প্রয়োগে গুরুত্ব দিলেও প্রতিশোধমূলক প্রথম আঘাতটা হানা হয়েছে বাণিজ্য–অস্ত্র প্রয়োগ করে।

ঘটনার পরপরই পাকিস্তানকে দেওয়া এমএফএন (মোস্ট ফেভারড নেশন বা সর্বোচ্চ আনুকূল্যপ্রাপ্ত দেশ) মর্যাদা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয় ভারত। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নীতি অনুসারে সাধারণত এর সদস্যদেশগুলো একে অন্যকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এই মর্যাদা দিয়ে থাকে। এমএফএন নীতি অনুসারে, ডব্লিউটিওর কোনো সদস্য অন্য কোনো সদস্যকে শুল্কছাড়সহ কোনো বিশেষ বাণিজ্য–সুবিধা প্রদান করলে একই ধরনের সুবিধা অন্য সব দেশকেও দিতে হবে। মানে, বাণিজ্যক্ষেত্রে ছাড় বা সুবিধা প্রদানে ডব্লিউটিওর কোনো সদস্য একজনকে বাড়তি সুবিধা দিয়ে অন্যদের সঙ্গে বৈষম্য করতে পারবে না। আভিধানিক অর্থে এমএফএন বলতে তাই কাউকে কাউকে বিশেষ বা বাড়তি সুবিধা দেওয়ার কথা বোঝালেও ডব্লিউটিওতে এর মানে হলো বাণিজ্য–সুবিধা প্রদানে কোনো বৈষম্য না করা। জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফস অ্যান্ড ট্রেড বা গ্যাটের (১৯৯৪) প্রথম অনুচ্ছেদেই এই নীতির কথা বলা হয়েছে। বাস্তবতা হলো, এই নীতি সব সদস্যদেশ সমভাবে অনুসরণ করে না, করতে পারে না। ডব্লিউটিওর বিধানেই এর ব্যত্যয় ঘটানোর সুযোগ আছে। সেটা অবশ্য ভিন্ন আলোচনা। আর আদি গ্যাটের (১৯৪৭) একটি ধারায় ভারত ও পাকিস্তান পরস্পরের ক্ষেত্রে এটির ব্যত্যয় ঘটাতে পারে, এমন সুযোগ দেওয়া হয়েছিল।

তবে আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৯৫ সালে ডব্লিউটিওর যাত্রা শুরুর এক বছরের মাথায় ভারত অন্য সব দেশের সঙ্গে পাকিস্তানকে এমএফএন মর্যাদাভুক্ত করে। পাকিস্তান আজ পর্যন্ত তা করেনি। সীমান্ত সংঘাত ও জঙ্গি হামলার জের ধরে ভারত এর আগে একাধিকবার পাকিস্তানের এমএফএন প্রত্যাহার করতে চেয়েছে। শেষ পর্যন্ত পুলওয়ামা হামলার জবাবে এটি করা হলো। এর ফলে পাকিস্তানকে আর অন্য অনেকের মতো শুল্কছাড় দেওয়ার কোনো বাধ্যতা রইল না। তাই একই সঙ্গে পাকিস্তান থেকে আমদানিযোগ্য সব পণ্যের ওপর ২০০ শতাংশ বাড়তি শুল্কও চাপিয়ে দিল ভারত। স্বাভাবিকভাবেই এর ফলে ভারতের বাজারে পাকিস্তানি পণ্যের দাম বেড়ে যাবে; ভারতে পাকিস্তানের রপ্তানি কমবে। তাতে করে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যও খানিকটা কমবে। বর্তমানে ২৪০ কোটি ডলারের ভারত-পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ভারতে পাকিস্তানের রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ৫০ কোটি ডলার। অর্থাৎ বাণিজ্য ভারসাম্য ভারতের অনুকূলে রয়েছে। এমএফএন প্রত্যাহার ও ২০০ শতাংশ শুল্কারোপ পাকিস্তানকে কিছুটা বেকায়দায় ফেলবে। কিন্তু এটাকে অনেকে তার চেয়েও বড় ব্যাপার বলে মনে করছেন, তাঁরা এটাকে পাকিস্তানের ওপর ভারতের শক্তিশালী প্রতীকী আঘাত হিসেবে দেখছেন। অবশ্য ভারতের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে পাকিস্তান ডব্লিউটিওর দ্বারস্থ হতে পারে।

ভারতের এই বাণিজ্য অস্ত্র প্রয়োগের পদক্ষেপ থেকে বাংলাদেশ কী কোনো কিছু নিতে পারে? বিশেষত প্রতিবেশী মিয়ানমারের ক্ষেত্রে? মিয়ানমার সরকার নিজ ভূখণ্ডে জাতিগত নিধন চালিয়ে সেখানকার রাখাইন অঞ্চলের অধিবাসী লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে বিতাড়িত করেছে বাংলাদেশে। অন্তত ১০ লাখ শরণার্থীর ভার বহন করছে বাংলাদেশ দুই বছরের বেশি সময় ধরে। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে নানা তৎপরতা ও চাপ তৈরি হলেও চীন ও রাশিয়া প্রকাশ্যে মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় কোনো কিছুতেই তেমন কাজ হচ্ছে না। অথচ বাংলাদেশ শুরু থেকেই যুক্তিসংগতভাবে ও শান্তিপূর্ণ কূটনৈতিক তৎপরতা ও আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা চালাচ্ছে।

এ রকম অবস্থায় মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ কি বাণিজ্যকে ব্যবহারের কথা ভাববে? বর্তমানে দুই দেশের মধ্যকার আনুষ্ঠানিক বাণিজ্য প্রায় সাত কোটি ডলারের, যার মধ্যে বাংলাদেশের আমদানিই বেশি। মিয়ানমার থেকে সবজি-তেল-চিনিসহ কিছু খাদ্যপণ্য ও যন্ত্রাংশ বেশি আমদানি করে। আর রপ্তানি করে প্রধানত ওষুধ ও কিছু তৈরি পোশাক। যদি ভারতের অনুসরণে মিয়ানমারের এমএফএন বাতিল কিংবা স্থগিত করা হয়, তাহলে ১৩ দশমিক ৯০ শতাংশ হারে গড় এমএফএন শুল্ক আর মিয়ানমার থেকে পণ্য আমদানির জন্য প্রযোজ্য হবে না; বরং বাংলাদেশ চাইলে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্কারোপ করতে পারে। তাতে মিয়ানমারের রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হবে।

কিন্তু মিয়ানমারের এমএফএন প্রত্যাহার করা হলে গ্যাটের ২০ ও ২১ অনুচ্ছেদে যথাক্রমে দেওয়া ‘সাধারণ ব্যতিক্রম’ ও ‘নিরাপত্তা ব্যতিক্রমে’র যেকোনো একটি দিয়ে এই পদক্ষেপের আইনি বৈধতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তারপরও শুল্কহার বাড়িয়ে মিয়ানমার থেকে আমদানি ব্যয়বহুল করে তুললে সম্ভাব্য ফলগুলো ভাবা দরকার।

প্রথমত, এতে বাংলাদেশের কিছু প্রয়োজনীয় পণ্য, বিশেষ করে খাদ্যসামগ্রী আমদানি কমতে পারে। দ্বিতীয়ত, মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সীমান্ত বাণিজ্য চুক্তি আছে, তা–ও বাতিল করতে হবে। তৃতীয়ত, এতে সীমান্ত দিয়ে অনানুষ্ঠানিক আমদানি তথা চোরাচালান বেড়ে যেতে পারে। কেননা, দুই পারেই চোরাকারবারিদের সক্রিয়তা ও পরস্পরের সঙ্গে সখ্য আছে। মিয়ানমার থেকে বিপুল পরিমাণ ইয়াবার অবৈধ আমদানি এর উৎকৃষ্ট প্রমাণ। চতুর্থত, মিয়ানমারও পাল্টা ব্যবস্থা থেকে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে দিতে পারে, যা থেকে বাংলাদেশের রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

দেখা যাচ্ছে, বাণিজ্য–অস্ত্র প্রয়োগ করে মিয়ানমারকে ঘায়েল করা বাংলাদেশের পক্ষে খুব কঠিন হবে। তবে এই বাণিজ্য দিয়ে মিয়ানমারের ওপর কৌশলে কিছুটা চাপ বাড়ানোর সুযোগ আছে। দুই দেশ একটি অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (প্রেফারেনশিয়াল ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট) করার জন্য কিছুটা আলোচনা করেছে মূলত মিয়ানমারের আগ্রহে। আবার বিমসটেক (বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি-সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো–অপারেশন) জোটে বাংলাদেশসহ যে সাতটি দেশ সদস্য, তার মধ্যে মিয়ানমারও আছে। একইভাবে সাসেকেও (সাউথ এশিয়া সাব-রিজিওনাল ইকোনমিক কো–অপারেশন) উপ–আঞ্চলিক জোটেরও সদস্য এই দুই প্রতিবেশী দেশ। কোনো রকম সংঘাতময় পথে না গিয়েও এসব জোটে সক্রিয় হয়ে মিয়ানমারের তৈরি করা রোহিঙ্গা সমস্যাটাকে আঞ্চলিক সহযোগিতা বিস্তারের অন্যতম অন্তরায় হিসেবে দেখানোর বিষয়টি হয়তোবা বাংলাদেশ বিবেচনা করতে পারে।

আসজাদুল কিবরিয়া : সাংবাদিক