স্টুডিও-যোদ্ধা, যুদ্ধবাজ সংবাদমাধ্যম

বিমানসেনার অভিযান নিয়ে ভারতীয় বিভিন্ন পত্রিকার প্রথম পাতার শিরোনাম
বিমানসেনার অভিযান নিয়ে ভারতীয় বিভিন্ন পত্রিকার প্রথম পাতার শিরোনাম

ভোররাতে বিমানসেনার অভিযান। সকাল হতে না হতেই ময়দানে সরকারের কিছু বিশ্বস্ত চ্যানেল। ভাবখানা এমন যেন সবিস্তার তথ্য জানানোর ভার সরকার ছেড়ে দিয়েছে কিছু বন্ধু সংবাদমাধ্যমের হাতে।

সরকার নয়, অভিযানের খবরে ‘সূত্র’ই সব। কোনো খবর দিচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকারের সূত্র। কোনোটি বিজেপির। আবার কোনোটি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের। একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ খবর। অথচ কোনো সরকারি পদাধিকারীর প্রকাশ্য বিবৃতি নেই। তাহলে খবরের উৎস কী? ঘুরতে থাকে ৩০০–এর সংখ্যা। কোনো নির্দিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্র ছাড়াই। প্রথমে নিউজ এইটিন বলে নিহত সন্ত্রাসবাদীর সংখ্যা ২০০-৩০০। জি নিউজ, নিউজ টোয়েন্টিফোর বলতে থাকে ৩০০–এর বেশি। ‘সরকারি সূত্র’ উল্লেখ করে এনডিটিভি জানায় ৩০০–এর ওপরে। নিউজ এক্স ঘোষণা করে ‘নিকেশ ৩৫০ জইশ’। বেলা ৩টা ৯ মিনিট। ইকোনমিক টাইমস পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ। শিরোনাম, ‘বালাকোটে ভারতীয় আকাশ হামলায় হত ৩০০ সন্ত্রাসবাদী: সূত্র’।

পরিস্থিতি তখন এমন, যেন ভারতীয় বিমানসেনার চেয়ে বেশি তথ্য জানে সর্বভারতীয় নিউজ চ্যানেল। বেলা গড়ানোর আগেই টুইটারে বাজার গরম করতে নেমে পড়েন কিছু পেটোয়া সাংবাদিক। যেন তাঁরা প্রতিরক্ষা বিটের সাংবাদিক নন, প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের মুখপাত্র। রিপাবলিক টিভির অর্ণব গোস্বামীরা বলতে শুরু করেন, ‘একজন সাংবাদিক হওয়ার পূর্বশর্ত হলো তাঁকে হতে হবে জাতীয়তাবাদী।’ এবিপি, রিপাবলিক ভারত বলতে শুরু করে দেয় ‘ভারতমাতা কি জয়’। আজতকের সাংবাদিক বলতে থাকেন ‘হাউ’স দ্য জইশ?’ তেলেগু টেলিভিশন চ্যানেল টিভি নাইনের সঞ্চালক তো হাজির হন রীতিমতো সামরিক উর্দিতে, হাতে খেলনা বন্দুক নিয়ে। চুলোয় যাক সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা। ওয়ার রুম থেকে স্টুডিও-যোদ্ধাদের যুদ্ধের হুংকার। টিআরপিই বাজার অর্থনীতিতে ধ্রুব সত্য। মিডিয়া সংস্কৃতিই আজ অলীক বাস্তবতার টিআরপি অর্থনীতি।

আখেরে লাভ তোলে সরকার। তথ্যে কোনো দায়দায়িত্ব নেই। অথচ আছে শতভাগ রাজনৈতিক ফায়দা। সকালে টাইমস নাউয়ের শিরোনাম ছিল ‘ভারতের আঘাত’; এনডিটিভি, নিউজ এইটিন, রিপাবলিকে তখন ‘ভারতের পাল্টা আঘাত’, কিংবা নিউজ এক্সে ‘ভারতের প্রত্যাঘাত’। জি নিউজে #জোশ হাই। বেলা গড়াতেই চড়তে থাকে যুদ্ধের উচ্চনাদ: ‘গুঁড়িয়ে গিয়েছে পাকিস্তান, কাঁপছে’ (নিউজ এক্স), রিপাবলিক টিভির ঘোষণা ‘নিকেশ করা গিয়েছে জইশের শীর্ষ নেতাদের’, ‘প্রত্যাঘাত শুরু’। রিপাবলিকান টিভি বলতে শুরু করে দেয়, ‘মোদি দেখালেন, যা তিনি বলেন, তা তিনি করেন।’ ইন্ডিয়া টুডে একটু এগিয়ে বলে, ‘এটা খুবই, খুবই কঠিন সিদ্ধান্ত, যা স্মরণে থাকবে বহুদিন।’ টিআরপি ধরতে টাইমস নাউ বলে, ‘কুর্নিশ আমাদের যোদ্ধাদের, আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে।’

অথচ দুদিন বাদে বিমানসেনার ভাইস মার্শাল জিকে কাপুর নিজেই জানান, নিহত সন্ত্রাসবাদীর সংখ্যা বলাটা এখনো ‘প্রি–ম্যাচিওর’।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে জার্মানদের পরিস্থিতি যখন খারাপ থেকে আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে, তখন হিটলারের প্রোপাগান্ডা মন্ত্রী জোসেফ গোয়েবলস এক বক্তৃতায় বলেন, ‘আমরা কি একটা পুরোদস্তুর যুদ্ধে যাব?’ উত্তেজিত জনতা সমস্বরে জানায়, ‘হ্যাঁ, আমরা পুরোদস্তুর যুদ্ধেই যেতে চাই।’ কে না জানেন, প্রত্যেককে আলাদা করে জিজ্ঞাসা করা হলে অনেকেই বলতেন, ‘যুদ্ধ চাই না, দুবেলা দুমুঠো খেতে চাই, দুহাতে কাজ চাই।’

হিটলারের সময় পত্রিকা থেকে সাময়িকী, নাটক থেকে সংগীত, চিত্রকলা, রেডিও থেকে চলচ্চিত্র—সব গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রণের জন্য ছিল গোয়েবলসের প্রোপাগান্ডা মন্ত্রক। যাঁরা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁদের হয় দেশ ছাড়তে হয়েছিল, অথবা ঠিকানা ছিল জেল কিংবা গুম–খুন। শুধু দেশের নয়, সব গণমাধ্যমকে হিটলারের জয়গান করতে হতো। এটা ঠিক, আমরা এখনো সরকারি সমন্বয়ের সেই স্তরে পৌঁছাইনি। নেই কোনো প্রোপাগান্ডা মন্ত্রক। আইন জোর করে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করতে বাধ্য করে না। কিন্তু তার দরকারই–বা কী, সরকারি নির্দেশিকা ছাড়া যখন দিব্যি চলছে চমৎকার সমন্বয়? রাষ্ট্র এখনো ফ্যাসিস্ট হয়ে না উঠলেও এর মতাদর্শ যেন চেপে বসতে শুরু করেছে।

১৫ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৮। বিস্ফোরণে উড়ে যায় হাভানা বন্দরে নোঙর করা মার্কিন যুদ্ধজাহাজ ‘ইউএসএস মেইন’। হত ২৬৬ নৌসেনা। কিউবা তখন স্পেনের উপনিবেশ। দেরি করেননি মিডিয়া মোগল উইলিয়াম রুডলফ হার্স্ট। জাহাজে করে দ্রুত কিউবায় পাঠিয়ে দেন সাংবাদিক ও ছবি-আঁকিয়েদের। এই সেই হার্স্ট, যাঁর আদলেই অরসন ওয়েলস তৈরি করেছিলেন তাঁর কালজয়ী চলচ্চিত্র সিটিজেন কেন। হার্স্টের কাগজ তখন প্রতিদিন কিউবা থেকে স্পেনবিরোধী রোমাঞ্চকর সব ফেক নিউজ ছেপে চলেছে। হার্স্টের কাগজ থেকে যে সাংবাদিক কিউবায় গিয়েছিলেন, একদিন তিনি জানান, যুদ্ধ হবে না। তাঁর প্রতি হার্স্টের জবাব আজও বিখ্যাত, ‘ইউ ফার্নিশ দ্য পিকচার্স, আই উইল ফার্নিশ দ্য ওয়ার’, তুমি ছবিটা সাজিয়ে দাও, আমি যুদ্ধটা বাধিয়ে দেব। পরের সংখ্যায় ছাপা হয় বেশ কিছু ঝুটা ছবি। নগ্ন করে তল্লাশি চালানো হচ্ছে মার্কিন নারীদের। আর তারপরই যুদ্ধ।

ভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এখন হার্স্টের ভূমিকায়। যুদ্ধকে সাজাতে চাইছে। মিডিয়া আসলেই যুদ্ধের ফেরিওয়ালা। হার্স্ট থেকে রুপার্ট মারডক—চলছে সেই পরম্পরা। চার দশক ধরে রুপার্ট মারডকের সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেল সমর্থন জানিয়ে আসছে সমস্ত মার্কিন-ব্রিটিশ যুদ্ধকে। ফকল্যান্ড যুদ্ধে, ব্রিটিশ সাবমেরিনের আক্রমণে আর্জেন্টিনার রণতরি জেনারেল বেলগ্রানো যখন ৩২০ জন নাবিককে নিয়ে ডুবছে, তখন উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে মারডকের সান পত্রিকা। সেদিন সেই পত্রিকার প্রথম পাতার শিরোনাম ছিল: ‘গোচা’। জাহান্নামে যাক। অথচ বেলগ্রানোর ওপর এই আঘাত ছিল স্পষ্টতই যুদ্ধাপরাধ। কারণ, জাহাজটি ফকল্যান্ডের জলসীমায় ছিল না। ছিল রণক্ষেত্রের অনেক বাইরে।

ইরাক যুদ্ধের সমর্থনে মারডক যে তাঁর মিডিয়া আউটলেটগুলোকে ব্যবহার করেছেন, সে কথা ভিডিও ফুটেজে অকপটে স্বীকার করেছেন। বলেছেন, এর মধ্য দিয়ে যুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ার চেষ্টা করেছেন তিনি এবং এই ভাষ্যে এতটুকু লজ্জিত নন তিনি। বিশ্বের বৃহত্তম যুদ্ধবিরোধী মিছিলের সপ্তাহখানেক আগে, ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি নাগাদ রাষ্ট্রসংঘ ইরাক যুদ্ধকে খারিজ করে দেওয়ার সময় মারডক সরাসরি বলেন, যুদ্ধ নিয়ে বুশ ‘সঠিক’ ও ‘নৈতিক’ কাজ করেছেন, ব্লেয়ার ছিলেন ‘অসম্ভব প্রত্যয়ী’ ও ‘সাহসী’। সস্তায় তেল ও স্বাস্থ্যকর অর্থনীতির জন্যই আজ যুদ্ধ জরুরি—সেদিন এভাবেই যুদ্ধের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন মারডক। বলেছিলেন, যুদ্ধে জিতলে বুশ যে পুনর্নির্বাচিত হবেন এবং মার্কিন অর্থনীতির যে বিকাশ হবে, তাতে অন্তত তাঁর কোনো সন্দেহ নেই।

এই সংবাদমাধ্যম মিতা সাঁতরার কথা বলে না। এই মিডিয়া বলে না গুরমেহেরের কথা। মিতার স্বামী পুলওয়ামায় সন্ত্রাসবাদী হামলায় নিহত সিআরপিএফ জওয়ান বাবলু সাঁতরা। ভারতের এই প্রত্যাঘাতে যখন মিডিয়া তুলতে চাইছে যুদ্ধের জিগির, তখনো ঋজু মিতা সাঁতরা। বলেন, ‘আমার যা গিয়েছে, তা গিয়েছে। যুদ্ধ হলে শুধু আবার কোনো মায়ের কোল খালি হবে, স্ত্রী তাঁর প্রিয়তমাকে হারাবেন, সন্তান হারাবে তার বাবাকে। আমি এখনো যুদ্ধ চাই না। কারণ, যুদ্ধে শুধু ওপারের মায়ের কোল খালি হবে না। এপারেও কোল খালি হবে।’ যেমন গুরমেহের কৌর। কারগিলে নিহত ক্যাপ্টেন মন্দিপ সিংয়ের মেয়ের কথা, ‘পাকিস্তান নয়, যুদ্ধ মেরেছে আমার বাবাকে।’ কয়েক দিন আগেও সংবাদমাধ্যমকে দেখা হতো গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে। কোথায় ফোর্থ এস্টেট? এত রিয়েল এস্টেট! আগে রিপোর্টারদের ছিল আলাদা মর্যাদা। এখন কোথায় রিপোর্টার, প্রায় সবাই তো স্ট্যানোগ্রাফার। আগে সংবাদমাধ্যম ছিল ওয়াচডগের ভূমিকায়। কোথায় ওয়াচডগ? সংবাদমাধ্যম এখন ল্যাপডগের ভূমিকায়।

আশা একটাই, ইতিহাস জানে বাস্তবতার কাছে চিরকাল পরাজিত হয় অলীক বাস্তবতা।

শান্তনু দে: কলকাতার সাংবাদিক