পলান সরকার ও চোখ থাকিতে অন্ধ যাঁরা

এভাবেই গ্রামে গ্রামে গিয়ে বই বিলাতেন পলান সরকার
এভাবেই গ্রামে গ্রামে গিয়ে বই বিলাতেন পলান সরকার

আর দুই বছর বেঁচে থাকলে পলান সরকার শতায়ু হতেন। তাতে ব্যক্তিমানুষটির কী লাভ হতো জানি না, সমাজ লাভবান হতো। স্কুলের ছোট ছেলেমেয়েরা বিনা পয়সায় আরও বেশি বই পড়ার সুযোগ পেত।

পলান সরকারের কথা মনে হলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটি ছবি—একজন মানুষ বই হাতে গ্রামের পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন, ছেলেমেয়ে যাকে পাচ্ছেন, তাকেই জিজ্ঞেস করছেন, পুরোনো বই পড়া শেষ হয়েছে কি না। নতুন বই লাগবে কি না। গ্রামের মানুষ সকালে যখন ঘর থেকে নিজের কাজে বের হতেন, পলান সরকার তখন বই ফেরি করে বেড়াতেন। পুরোনো বই নিয়ে ছেলেমেয়েদের হাতে নতুন বই তুলে দিতেন। তিনি আলোর ফেরিওয়ালা।

পলান সরকারের জন্ম ১৯২১ সালে। পিতৃপ্রদত্ত নাম হারেজ উদ্দিন সরকার। মা তাঁকে আদর করে ডাকতেন পলান। শৈশব থেকে সে নামেই পরিচিত হন তিনি। পলান সরকারের জন্মের পাঁচ মাসের মাথায় বাবা মারা যান। এ কারণে পরিবারটি অর্থসংকটে পড়ে এবং ষষ্ঠ শ্রেণিতে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার ইতি ঘটে। কিন্তু পলান সরকার নিজের চেষ্টায় পড়াশোনা চালিয়ে যান। তাঁর নানার ছোটখাটো জমিদারি ছিল। সেখানে খাজনা তোলার কাজ করতেন। সেটি ছিল তাঁর পেশা। নেশা ছিল বই পড়া। ধরাবাঁধা পাঠ নয়, যখন যেটা মন চায়।

পরে যখন নানার জমিদারি চলে যায়, পলান সরকার ইউনিয়ন পরিষদের চৌকিদারের চাকরি নেন। তাঁর কাজ হয়ে পড়ে গ্রাম ঘুরে ঘুরে কর আদায় এবং ছেলেমেয়েদের মধ্যে বই বিলানো। তিনি গ্রামে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে প্রতিবছর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে যারা ১ থেকে ১০-এর মধ্যে মেধাতালিকায় স্থান লাভ করত, তাদের তিনি একটি করে বই উপহার দিতেন। তাঁর দেখাদেখি অন্যান্য বিদ্যালয়েও বই উপহার দেওয়ার রীতি চালু হয়ে যায়। এভাবে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলেন।

১৯৯০ সালে পলান সরকারের ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। চিকিৎসক তাঁকে হাঁটার পরামর্শ দেন। পলান সরকার ভাবলেন, নিজের স্বাস্থ্য রক্ষার পাশাপাশি একটি ভালো কাজ করবেন। এরপর প্রতিদিন রুটিন করে হেঁটে হেঁটে বই বিলি করেন। একটানা ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি এই কাজ করেছেন। রাজশাহী অঞ্চলের অনেক গ্রামে বই পড়ার আন্দোলন গড়ে তুলেছেন।

২০০৭ সালে প্রথম আলোর  ক্রোড়পত্রে ‘ছুটির দিনে’তে ‘বিনে পয়সায় বই বিলাই’ শিরোনামে পলান সরকারকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন করলে চারদিকে সাড়া পড়ে যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছিলেন প্রথম আলোর রাজশাহী ব্যুরোপ্রধান মুহম্মদ আবুল কালাম আজাদ। এরপর পলান সরকারের নাম দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ে। ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’ উপলক্ষে ‘আলোর ফেরিওয়ালা’ শিরোনামে পলান সরকারের বই পড়ার আন্দোলন নিয়ে লেখাটি পৃথিবীর ৪০টি প্রধান দৈনিকে ছাপা হয়। তিনি হন বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত নামগুলোর একজন।

পলান সরকার বই বিতরণের জন্য এলাকায় পাঁচটি বিকল্প বই বিতরণকেন্দ্র তৈরি করেছেন। এ জন্য তিনি বেছে নিয়েছেন কয়েকটি বাজারের বইপ্রেমী দোকানিকে। দোকানের মালিক দোকানে মালামালের পাশাপাশি তাঁর বইও রাখেন। সেখান থেকে স্থানীয় লোকজন বই নিয়ে যান। পড়া বই তাঁরা নিজেরাই আবার ফেরত দিয়ে নেন নতুন বই। মাসে এক-দুবার করে পলান সরকার দূরবর্তী এই কেন্দ্রগুলোতে ছেলের সঙ্গে মোটরসাইকেলে চেপে গিয়ে নতুন বই দিয়ে পুরোনো বই নিয়ে আসেন। এ ছাড়া পাঠাগারে শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন তিনি। পুরস্কার হিসেবে তাদের হাতেও বই তুলে দেন পলান সরকার। তখন তাঁর বয়স ৯৬ বছর। জ্ঞানের প্রতি অদম্য ইচ্ছা ও ভালোবাসা না থাকলে কেউ এ কাজ করতে পারেন না।

পলান সরকার তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১১ সালে একুশে পদক পান। গত ৮ ডিসেম্বর তাঁকে বাংলা একাডেমির সম্মানসূচক ফেলোশিপ-২০১৮ প্রদান করে সরকার। ২০০৭ সালে সরকারিভাবে তাঁর বাড়ির আঙিনায় একটি পাঠাগার করে দেওয়া হয়েছে। তাঁকে নিয়ে সায়াহ্নে সূর্যোদয় নামে শিমুল সরকার একটি নাটক নির্মাণ করেছেন। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুর পর তাঁর বাড়িতে প্রধানমন্ত্রীর শোকবার্তাটি নিয়ে যান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি পলান সরকার প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়টিকে সরকারি করার প্রতিশ্রুতি দেন। আলোর ফেরিওয়ালার প্রতি এটি যথাযথ সম্মান বলেই মনে করি।

প্রথম আলোর সঙ্গে অপর এক সাক্ষাৎকারে পলান সরকার বলেছিলেন, ‘ছোটবেলায় শুনেছিলাম, অন্নদান, বস্ত্রদান—অনেক রকম দান আছে। কিন্তু সবার সেরা দান জ্ঞানদান। তো আমি ঠিক করলাম, মানুষকে দেব যখন সেরাটাই দিই। আমাদের গ্রামটায় মানুষের লেখাপড়া কম। পেটের দায়েই ঘুরতে হয় ২৪ ঘণ্টা, বই পড়বে কী! সে কারণেই ভাবলাম কোনোভাবে যদি ওদের বই পড়ানো যায়...।’

৩০ বছর ধরে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাউশা গ্রামের পলান সরকার বিনা পয়সায় বই বিলিয়েছেন তাঁর আশপাশের ১০ গ্রামে। উপজেলার ১২টি গ্রামে তিনি পাঁচ হাজার পাঠক তৈরি করেছেন।

একুশে পদক পাওয়ার পর যখন পলান সরকার প্রথম আলো কার্যালয়ে এসেছিলেন, তাঁর সঙ্গে অনেক কথা হয়েছিল। এ রকম সাদামাটা ও সরল মানুষ খুব কমই দেখেছি। একুশে পদক পেয়ে তিনি খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর কথাবার্তায় কোনো উচ্ছ্বাস ছিল না। বিনয়ের সঙ্গে বললেন, ‘আমি এমন কিছু করিনি, যাতে এত বড় সম্মান আমাকে দিতে হবে।’ পরে শুনেছি একুশে পদকের অর্থ তিনি রেখে দিয়েছিলেন তাঁর স্কুল ও পাঠাগারের জন্য।

পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষই নিজেকে নিয়ে বাঁচেন। নিজের পরিবার ও স্বজন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু পলান সরকারের মতো মানুষেরা পরিবার ও স্বজনের বাইরের মানুষদের আপন করে নেন। সবার মধ্যে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে পারেন। আর এ কাজে তিনি মাধ্যম হিসেবে বেছে নিয়েছেন বই। পলান সরকার তেমন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না নিয়েও জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে গেছেন আজীবন।

কিন্তু আমাদের সমাজে যাঁরা উচ্চশিক্ষিত, তাঁদের বেশির ভাগই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়ে এসে আর বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন না। অনেকে বইকেই আপদ মনে করেন। সৈয়দ মুজতবা আলী যেমন তাঁর ‘বই কেনা’ নিবন্ধে এক উচ্চশিক্ষিত দম্পতির কথা বলেছেন। তাঁরা যখন বাজারে গিয়ে এটা-সেটা কিনেছেন। দোকানি বইয়ের কথা বললে ভদ্রমহিলা জবাব দিয়েছিলেন, ওটা বাসায় একটা আছে। যেসব উচ্চশিক্ষিত মানুষ বইকে অপ্রয়োজনীয় বস্তু মনে করেন, তাঁরা হলেন চক্ষুষ্মান অন্ধ। এই চক্ষুষ্মান অন্ধদের চোখ খুলে দেওয়ার কাজটিই করে গেছেন পলান সরকার।

আপনাকে অভিবাদন।

সোহরাব হাসান: কবি ও সাংবাদিক