আপনি কখন 'যথার্থ ব্রিটিশ' হতে পারবেন?

শামীমা বেগম
শামীমা বেগম

শৈশব কাটিয়ে কৈশোরে পা দিতেই একটি মেয়ে এমন একটি অনলাইন চক্রের ফাঁদে পড়ে গিয়েছিল, যারা নারী মুক্তির বিপক্ষে কথা বলে, নানা ধরনের পশ্চাৎবর্তী সামাজিক চর্চায় ডুবে থাকে, ধর্মীয় অনুশাসনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় এবং সহিংসতার পক্ষে অবস্থান নিয়ে থাকে। সেই ভয়ানক উন্মত্ত গ্রুপের সঙ্গে যোগ দিতে মেয়েটি কাউকে কিছু না জানিয়ে দেশ ছেড়ে বিদেশের পথে পা বাড়িয়েছিল। চার বছর ধরে সেই গ্রুপের সঙ্গে থেকে এবং তাদের এক সদস্যকে ‘বিয়ে’ করে দুটো সন্তান হয়েছিল তার। কিন্তু দুটি সন্তানই মারা গেছে। আবার অন্তঃসত্ত্বা হয়ে একেবারে প্রসব অবস্থার কাছাকাছি এসে সে সেই দেশটির কাছে তাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য আকুল আবেদন জানিয়েছে, যে দেশটিকে আইনগত দিক থেকে সে নিজের দেশ বলে দাবি করতে পারে। তবে তার ‘নিজের দেশ’ তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে এবং তার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিল করার ঘোষণা দিয়েছে।

অনেকেই বলছেন, মেয়েটি যদি শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ হতো তাহলে হয়তো যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজিদ জাভিদের পক্ষে তার আবেদন নাকচ করা এত সহজ হতো না।

যে মেয়েটির কথা বলা হচ্ছে, তিনি এখন একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী। তিনি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত শামীমা বেগম। তাঁর গাত্রবর্ণ শ্যামলা। তিনি পূর্ণাঙ্গ হিজাবধারী। নৃশংস জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসে যোগ দেওয়া নিয়ে দৃশ্যত তাঁকে খুব কমই অনুশোচনা প্রকাশ করতে দেখা গেছে।

অ্যান্থনি লয়েড নামের একজন সাংবাদিক শামীমার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। এই সাংবাদিক শামীমার বক্তব্যের বিষয়ে বলেছেন, ‘যখন কেউ একটি ভয়ানক জঙ্গিগোষ্ঠীর ভেতরে বন্দী অবস্থায় থাকেন, তখন তাঁর পক্ষে শামীমা যা বলেছেন, তার বাইরে তেমন কিছু বলা প্রায় অসম্ভব।’

অ্যান্থনি লয়েড মনে করেন, শামীমা বেগম এবং অন্য যেসব ব্রিটিশ নাগরিক আইএসে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের সবাইকে ফিরিয়ে আনা উচিত এবং স্বচ্ছ ও সুন্দরভাবে তাঁদের বিচার করা উচিত।

একান্ত নিজের স্বার্থের এবং ওপরে ওঠার কথা চিন্তা করে ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ শামীমা বেগমের ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিলের ঘোষণা দিতে বিন্দুমাত্র ইতস্তত করেননি। সাজিদ জাভিদের এই পদক্ষেপকে ব্রিটিশ ভোটাররা খুব ভালোভাবে নিয়েছেন। যেসব ব্রিটিশ নাগরিক নিজেদের উদার ও সহিষ্ণু বলে দাবি করেন, তাঁরাও এই দলে আছেন। সাজিদ জাভিদ নিজে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত নাগরিক এবং হয়তো সেই কারণেই ব্রিটিশ ভোটারদের কাছে নিজের বংশগত পরিচয়কে সন্দেহমুক্ত রাখার মানসে তিনি শামীমার আবেদন খারিজ করেছেন। তবে এর মধ্য দিয়ে যে বার্তাটি বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট হয়ে ধরা দিল সেটি হলো, আপনি যদি শ্বেতাঙ্গ না হন এবং আপনার বংশপরিচয় যদি এশিয়ান বা আফ্রিকান দেশগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে, তাহলে আপনি ন্যায্য বিচার থেকে বঞ্চিত হবেন এবং এসব জায়গা থেকে আপনাকে ‘চলে যান’ বলে বের করে দেওয়া হবে।

শামীমার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার যা বলেছে, তা একদম সঠিক। বাংলাদেশ বলেছে, শামীমার বাবা–মা বাংলাদেশি হলেও বাংলাদেশে শামীমার জন্মও হয়নি, বাংলাদেশে তিনি বড়ও হননি। সুতরাং বাংলাদেশ তাঁর কোনো দায় নিতে পারে না। আইন অনুযায়ী, শামীমার সদ্যোজাত সন্তান নিশ্চিতভাবেই একজন ব্রিটিশ নাগরিক, বাংলাদেশি নাগরিক হওয়ার প্রশ্নই আসে না। শামীমা বেগমের দায় বাংলাদেশের ওপর চাপানোর চেষ্টার মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ সরকার এটিই প্রমাণ করতে চায় যে অ-ইউরোপীয় নাগরিকদের মধ্যে সন্ত্রাস ও অপরাধপ্রবণতা বেশি থাকে এবং সে জন্য যুক্তরাজ্য তাঁদের নাগরিকত্ব দিতে সতর্ক থাকে। যেহেতু শামীমা কোনো দিনই বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী ছিলেন না, সেহেতু মনে হচ্ছে জাভিদের ঘোষণা আদালতে টিকবে না। মনে হচ্ছে শামীমার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব বাতিলের সিদ্ধান্ত খারিজ হয়ে যাবে।

ব্রিটেনে জন্ম নেওয়া একজন নারীর নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার এই চেষ্টার মধ্য দিয়ে ব্রিটেনে বসবাসকারী বহু লোকের ধারণা হবে, যাঁরা শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশ নন, তাঁরা আসলে ব্রিটিশ নাগরিক হতে পারবেন না। এ বিষয়ে সবচেয়ে রাখঢাকহীন মন্তব্য করেছেন ব্রিটিশ লেখক এলিসন পিয়ারসন। তিনি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় লিখেছেন, ‘শামীমা বেগমের জন্ম হয়তো এখানে, কিন্তু কখনোই তিনি ব্রিটিশ নন।’ তার মানে, আপনার বাপ–দাদা যদি এশিয়ান, ক্যারিবিয়ান কিংবা আফ্রিকান হয়ে থাকেন, তাহলে আপনি কখনোই ‘পাক্কা ব্রিটিশ’ হিসেবে নিজেকে মনে করতে পারবেন না, সে আপনি যেখানেই জন্ম নিন বা আপনার বাপ–দাদা যত দিনই ব্রিটেনে বসবাস করে থাকুন।

শামীমার বিষয়ে যুক্তরাজ্য সরকার যে দৃষ্টিভঙ্গি দেখাল, তা দেখে ব্রিটেনের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার লোকজন, বিশেষ করে এশিয়ার বংশোদ্ভূত মুসলিমদের মধ্যে ভীতি কাজ করবে। এই সম্প্রদায়ের লোকজন ডানপন্থীদের হিংসার লক্ষ্যবস্তু হয়ে আছে। এখন ডানপন্থীরা নতুন করে অপপ্রচারের মুখে তাদের ফেলে দেবে বলে মনে করা হচ্ছে।

উইন্ডরাশ কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর আমরা জেনেছি, ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভূত শত শত ব্রিটিশ নাগরিককে শুধু ‘কালো’ হওয়ার কারণে ক্যারিবিয়ান দেশগুলোতে ফেরত পাঠানো হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। অথচ যাঁদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে তাঁদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা কখনোই সেসব দেশে ছিলেন না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই পদক্ষেপে অভিবাসী সম্প্রদায় মনে করতে বাধ্য হচ্ছে, শুধু বর্ণ পরিচয়ের কারণে তাঁরা কখনোই পুরোপুরি ব্রিটিশ নাগরিক হয়ে উঠতে পারবেন না।

এই আলোচনার মধ্যে আমি এটি বলছি না, শামীমা এবং অন্যরা নির্দোষ (যদিও আদালতে প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দোষীও বলা যায় না), কিন্তু আমি বলতে চাই, তাঁর বিষয়ে যা হবে, তা আদালতের রায়ের মধ্য দিয়ে হতে হবে। তিনি যদি দোষী ও অপরাধী হন, তাহলে অন্য ব্রিটিশ নাগরিকদের মতো তাঁকেও বিচারের আওতায় এনে সাজা দেওয়া হোক। কিন্তু তা না করে জনতুষ্টিবাদী চেতনা দিয়ে তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল করা হলে আবার প্রমাণিত হবে, ব্রিটিশরা ঔপনিবেশিক আমলের সেই বর্ণবাদী আচরণ থেকে আজও বেরিয়ে আসতে পারেনি।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
প্রিয়ংবদা গোপাল: লেখক ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি অনুষদের শিক্ষক