পথের শেষ কোথায়, কী আছে শেষে

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপনির্বাচনে ভোটারশূন্য একটি কেন্দ্র
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপনির্বাচনে ভোটারশূন্য একটি কেন্দ্র

মাওলানা ভাসানী অনেকবার বলেছেন, ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে এক অতিবৃদ্ধ অসুস্থ ব্যক্তি কোনোরকমে ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোটটা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে মারা যান। ১৯৫৪-তে হাফপ্যান্ট পরা বালক ছিলাম, তখন আমি আমার নিজের চোখে দেখেছি আমাদের পরিচিত এক ব্যক্তিকে তক্তায় শুইয়ে তাঁর ছেলেরা ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যান। গ্রামের রাস্তাঘাটের অবস্থা তখন ছিল শোচনীয়। ওই লোকের যক্ষ্মা বা ক্যানসার হয়েছিল। ১০-১৫ দিন পর তিনি মারা যান। কুলখানির দিন লোকে বলাবলি করছিল, তিনি হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর প্রার্থীকে নৌকায় ভোট দিয়েছিলেন।

বাংলাদেশের মানুষের ভোট দেওয়ার আগ্রহ অপার। ভোট দিতে পেরে তাঁরা গর্ব বোধ করেন। ওই দিন তাঁরা নিজেদের মনে করেন ক্ষমতাবান ও দায়িত্বশীল মানুষ। এখন অনেক বড় বড় কর্মকর্তা ‘ভোট উৎসব’ কথাটা বলে থাকেন। ভোট কোনো উৎসবের ব্যাপার নয়। সার্কাসের খেলা নয়। তামাশা তো নয়ই। অতি গুরুতর বিষয়। গুরুতর বলেই ভারতের অরুণাচল প্রদেশের এক প্রত্যন্ত দুর্গম এলাকায় দু-তিনজন ভোটারের জন্য একটি ভোটকেন্দ্র খুলতে হয়। একজনকেও তাঁর ভোট প্রয়োগের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যায় না।

নির্বোধের মতো একটা বিষয় ভাবছিলাম। এখনকার অবস্থা যদি ১৯৭০-এ হতো, তাহলে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও বাংলাদেশ—এই শব্দ তিনটি আমাদের কাছে অপরিচিত থাকত। আমরা হয়তো ইয়াহিয়া-টিক্কাদের জন্মবার্ষিকী-মৃত্যুবার্ষিকী সপ্তাহব্যাপী ঘটা করে পালন করতাম।

সরকারি, আধা সরকারি অফিস, ব্যাংক-বিমা প্রভৃতি বন্ধ ঘোষণা করা হলো ভোট দেওয়ার জন্য, তারপরও মানুষ ভোট দিতে গেল না—এ এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। ১৯৪৬, ১৯৫৪ ও ১৯৭০ সালে এ দেশের কেউ স্বপ্নেও দেখেনি বাংলাদেশে একদিন ভোটকেন্দ্র জনশূন্য। দায়িত্বপ্রাপ্তরা ঠায় বসে বসে মশা তাড়াচ্ছেন। কেন্দ্রের দরজায় ঘুমাচ্ছে কুকুর। কুকুর রাত জাগে বলে তাকে দিনে ঘুমাতে হয়। নির্বাচন কেন্দ্রকেই সে বেছে নিয়েছে নির্জনতার জন্য। টিভি চ্যানেলের কল্যাণে দেশবাসী এ দৃশ্য দেখেছে।

নির্বাচনবিষয়ক সর্বোচ্চ কর্তা বলেছেন, কম ভোটারের দায় নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নয়। অতি উত্তম কথা। অবশ্যই ইসির কর্মকর্তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসতে পারেন না। তবে তাঁর নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় মানুষের আস্থা নেই—সে জন্য তিনি লজ্জিত নন। দেশবাসীর কাছে তাঁর জবাবদিহির প্রয়োজন নেই।

বাংলাদেশের কর্মকর্তারা জবাবদিহিকে থোড়াই কেয়ার করেন। তবে সারা দিনের কাজের পর সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে রাতে খাবার টেবিলে পরিবারের সদস্যদের কেউ কি জানতে চান না—ব্যাপারটা কেমন হলো? তখন তো সেখানে মিডিয়ার লোক থাকেন না, তাঁরা তখন কী জবাব দেন?

কোনো কোনো যুক্তিবাদী বলেছেন, উপনির্বাচন বলে ভোটারদের আগ্রহ কম। আরেকজন বলেছেন, মেয়াদ কম বলে ভোটারের উপস্থিতি কম। এসব বয়ানকে আমরা শিরোধার্য করতাম, যদি জাতির ইতিহাসে এই নির্বাচনই প্রথম উপনির্বাচন হতো। গত ৭০ বছরে অসংখ্য উপনির্বাচন হয়েছে। তার কোনো কোনোটিতে ভোট বেশি পড়েছে অথবা সরকারি দল পরাজিত হয়েছে।

একটি ঠুনকো মামলা ঠুকে দিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপনির্বাচনটি আটকে দেওয়ার সময়ই মানুষের মধ্যে সন্দেহ দেখা দেয়। ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনের পর সরকার, নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের আত্মবিশ্বাস সুদৃঢ় হওয়ায় অতি দ্রুত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও ডাকসুর নির্বাচনের এন্তেজাম করা হয়।

মানুষ সবচেয়ে অবাক হয়েছে সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের কোনো ভূমিকা না থাকায়। যা করার নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনই করে বলে দলীয় নেতা-কর্মীদের এখন আর কিছুই করার নেই। অর্থাৎ তাঁদের কোনো দাম নেই দলের কাছেও। রাজনৈতিক দলের যদি রাজনীতি থাকত, তাহলে তাঁদের দাম থাকত। এ অবস্থাটা দলের জন্য ক্ষতিকর এ কারণে যে নির্বাচনের সময় যখন তাঁদের প্রয়োজন নেই, দল যেদিন সংকটে পড়বে, সেদিনও তাঁরা নেতাদের পাশে থাকবেন না। বর্তমান ব্যবস্থায় শুধু যে ভোটাররা হতাশ, তা-ই নয়, অল্প কিছু সুবিধাবাদী ছাড়া দলের নেতা-কর্মীরাও হতাশ।

যেকোনো নির্বাচনই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও প্রাণবন্ত হওয়ার কথা। তা না হয়ে যদি ইউজিন আয়োনেস্কো ও স্যামুয়েল বেকেটের অ্যাবসার্ড নাটক মঞ্চস্থ করার মতো হয়, দর্শক হিসেবে জনগণ ক্লান্ত ও হতাশ না হয়ে পারে না। শুধু তা-ই নয়। এজাতীয় নির্বাচন মঞ্চায়নে যোগ্য বিজয়ী প্রার্থীও বিব্রত হন। ভোটারদের কাছে তাঁর কোনো দাম থাকে না।

বিরোধী দলের নেতাদের ভুলের খেসারত বিরোধী দল দেবে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন তারা যে যুক্তিতেই বর্জন করে, বাস্তবতা হলো, ঘোষণা দিয়েই বর্জন করেছিল। ঠিক-বেঠিক যা-ই হোক, এখন মানুষ বলছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেও তারা ভুল করেছে। তবে ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রমাণ করল, ২০১৪-তে বর্জন না করলে ১৫-২০টির বেশি আসন তাদের ভাগ্যে জুটত না।

সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রদর্শনের একটা অপূর্ব সুযোগ এসেছিল এবার; ক্ষমতাসীনদের অধীনেও যে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে, তা প্রমাণ করার সুযোগ। সেই সুযোগটা সরকার হারিয়েছে। একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দল যদি ৭০-৮০টি আসন পেত, তাহলে নির্বাচনে কারচুপি বা অনিয়ম হয়েছে এমন অভিযোগ করার সুযোগ অনেকটাই কমে যেত। উল্টো দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করার জন্য বিরোধী নেতাদের ধিক্কার দেওয়া হতো। অন্যদিকে বিদেশি কূটনীতিকদের নিয়ে ঘন ঘন লাঞ্চ ও ডিনার করা বন্ধ হতো।

সরকারের এতটা আগ্রাসী না হওয়াই ভালো ছিল। মানুষের সঙ্গে কথা বলে যা বুঝতে পেরেছি তা হলো, মানুষ স্থিতিশীল সরকারই পছন্দ করে। এখন যারা বিরোধী দলে, তাদের যোগ্যতা-দক্ষতাও মানুষ জানে। সরকারের পরিবর্তনই যে মানুষ চায়, তা নয়; মানুষ যা চেয়েছে তা হলো সংসদে সত্যিকারের একটি শক্ত বিরোধী দলের উপস্থিতি। পাতানো বিরোধী দলের চেয়ে একদলীয় সংসদই-বা মন্দ কী। বিরোধী দলকে স্বাভাবিক নির্বাচনী প্রচারণায় বাধা দেওয়াটা অনুচিত হয়েছে।

জাতীয় নির্বাচনে অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটায় তার প্রভাব যেকোনো নির্বাচনে পড়তে বাধ্য। শুধু স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নয়, পেশাজীবীদের নির্বাহী পরিষদ নির্বাচনে, শিক্ষক সমিতি নির্বাচনে, ট্রেড ইউনিয়ন নির্বাচনে, দোকান মালিক সমিতি নির্বাচনে, ফ্ল্যাটবাড়ির মালিকদের নির্বাচনে, বিশেষভাবে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে তো বটেই। পেশাজীবী নির্বাচনে যে পক্ষের পরাজিত হওয়ার আশঙ্কা, তারা কোনো অজুহাতে একটা মামলা ঠুকে দেয়। আদালত থেকে একটা স্থগিতাদেশ এনে অনির্দিষ্টকাল নির্বাচন বন্ধ রাখে। অবশ্য সেটাও ভালো, কারচুপির বা ভোটারবিহীন নির্বাচনের চেয়ে।

বাঙালি জাতি গঠনে এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় একাত্তর-পূর্ববর্তী সময়ে আমাদের পূর্বপুরুষেরা যে সীমাহীন ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাঁদের সব সাধনাই কি ব্যর্থ? কী প্রয়োজন ছিল তাঁদের আত্মত্যাগের? তা ছাড়া একাত্তরে দেশের ভেতরে এবং কলকাতায় থিয়েটার রোডে দেশের জন্য যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁরা কি গণতান্ত্রিক অধিকার চেয়ে ভুল করেছিলেন?

মানুষ সর্বৈব অন্যায়ের প্রতিকার দুইভাবে করে। একটি গান্ধীবাদী অহিংস অপ্রতিরোধী অসহযোগ, আরেকটি সহিংস। ভোটের দিন ভোট দিতে না যাওয়া অহিংস প্রতিবাদ। গণতন্ত্র ও নির্বাচনী ব্যবস্থায় এর চেয়ে বেশি আর কী হতে পারে? দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের কোনো কেন্দ্রেই যদি একজন ভোটারও না যান এবং তারপরও যদি ৮২ শতাংশ ভোট পেয়ে ২৯৭ আসনে কোনো দল বিজয়ী হয়, কার কী বলার থাকবে?

কবির গানের ভাষায় বলতে পারি—পথের শেষ কোথায়, কী আছে শেষে?

সৈয়দ আবুল মকসুদ: লেখক ও গবেষক