একজন মাহবুবুল হকের খোঁজে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বহুল আলোচিত যে ডাকসু নির্বাচনটি বানচাল হয়ে গিয়েছিল, তাতে ভিপি পদে সম্ভাব্য বিজয়ী মনে করা হচ্ছিল আ ফ ম মাহবুবুল হককে। সে সময়কার ছাত্ররাজনীতির জীবন্ত কিংবদন্তি ছিলেন মাহবুবুল হক। শেষ জীবনে বাসদের একাংশ পরিচালনা করতেন। রাজনৈতিকভাবে পার করছিলেন প্রতিকূল সময়। সে রকম দিনগুলোতেই ঢাকার ফকিরাপুলে দলীয় ছোট্ট এক অফিসে একদিন তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তিয়াত্তরে ‘ভিপি’ হতে না পেরে তাঁর কোনো খেদ আছে কি না।

মাহবুবুল হকের উত্তর ছিল অবাক হওয়ার মতো। বলেছিলেন, ‘একদম কোনো আফসোস হয়নি। ক্যাম্পাসে আগে-পরে আমরাই প্রবলভাবে শিক্ষার্থীদের আকাঙ্ক্ষার নেতৃত্ব দিচ্ছিলাম। ওই ঘটনায় দেশব্যাপী শিক্ষাঙ্গনে আমাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক আরও জীবন্ত হয়ে ওঠে। নির্বাচন হওয়ার চেয়েও না হওয়া যেন বেশি কিছু দিয়েছিল ক্যাম্পাসকে।’

মাহবুবুল হকের এই অনুভূতির বার্তা স্পষ্ট। ক্যাম্পাসে নির্বাচিত নেতৃত্বের চেয়েও জরুরি হলো শিক্ষার্থীদের প্রাণবন্ত সক্রিয়তা। শিক্ষার্থীদের মতামত ও যৌক্তিক চাওয়া-পাওয়ার প্রকাশ হতে হবে বাধাহীন। তারুণ্যের ক্ষমতায়নের জন্য ব্যাপকভিত্তিক ‘ক্যাম্পাস ডেমোক্রেসি’ খুব জরুরি আজ। অন্তত ১৯৯০ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যার প্রবল রেশ ছিল।

আত্মমর্যাদার পরিবেশ ফেরাতে প্রতিনিধিত্বের পাশাপাশি দরকার স্বাধীনতা
বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় বরাবরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) জন্য কিছু প্রশ্নহীন প্রশংসা সংরক্ষিত থাকে। সেই ডাকসুর নির্বাচন হচ্ছে ২৯ বছর পর। ক্যাম্পাস ঘুরে এই নির্বাচন নিয়ে উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনার ঘাটতিই দেখা গেছে। তবে নিঃসন্দেহে সারা দেশের শিক্ষার্থীরা ১১ মার্চের দিকে নজর রাখছে। কিন্তু এই নির্বাচন বা অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এরূপ প্রতিনিধিত্ব বাছাই কি ক্যাম্পাস গণতন্ত্রের রুদ্ধদ্বার খুলে দিতে পারবে? মধুর ক্যানটিনের টেবিলগুলোতে সে রকম আশাবাদ দেখিনি।

আর্থিক অবস্থানির্বিশেষে প্রায় প্রত্যেক শিক্ষার্থী গভীরভাবে অসন্তুষ্ট। পিঠের ব্যাগটি ছাড়া যেন কিছুই তার নয়। বর্তমান ও ভবিষ্যতের ওপর নিয়ন্ত্রণহীনতায় তারা হতবিহ্বল। পিইসিই থেকে এইচএসসির শিক্ষাজীবনের কষ্টকর চারটি ধাপ যোগ্যতার সঙ্গে পেরিয়ে এসেও প্রতিদিন এই তারুণ্য লড়ছে অনিশ্চয়তার সঙ্গে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের হতাশার দেখা মেলে হামেশা। স্বঘোষিত ‘মোটিভেটর’দের সমাজবিচ্ছিন্ন আশাবাদী কথাবার্তায় এই তরুণেরা প্রতিদিনকার প্রতিবন্ধকতাগুলোর কোনো সমাধান পায় না। কেবল জ্ঞানচর্চার ধারাই নয়, ক্যাম্পাসে সংস্কৃতিচর্চার ধারাতেও এই ধূসর সময়ের ছাপ।

আলাপ-আলোচনায় মনে হয়েছে, ক্যাম্পাসগুলোয় এ মুহূর্তে শিক্ষার্থীদের বড় সমস্যা কর্তৃত্ববাদী পরিবেশ। থাকার সমস্যা, খাওয়ার সমস্যা, স্বাধীনভাবে চলাচল ও মতপ্রকাশের সমস্যা নিয়ে কথা বলতে ভীত বোধ করেন ছাত্রছাত্রীরা। সবার মুখে মুখে ‘গেস্টরুম’ নামক প্রায় স্থায়ী এক নিপীড়ক কাঠামোর কথা শোনা গেল। বিশ্ববিদ্যালয় ও হল প্রশাসন শিক্ষার্থীদের থাকা-খাওয়ার স্বচ্ছন্দ পরিবেশের সুরাহা করতে পারছে না। কীভাবে এসবের সমাধান সম্ভব, সেই বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মতামত প্রদানেরও সুযোগ নেই। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভরকেন্দ্রগুলো ঔপনিবেশিক ধাঁচেই চলছে। ল্যাব, সেমিনার রুম ইত্যাদি ব্যবহারেও নিয়মকানুনের বাঁধন বড় বেশি শক্ত।

ক্লাস ও পরীক্ষাপদ্ধতির বিষয়েও শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অনেক মতামত আছে। সেগুলো বলার কোনো জায়গা নেই তাদের। উন্নত বিশ্বে শিক্ষকদের মূল্যায়নের যে ব্যবস্থা থাকে, বাংলাদেশে তা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন সমগ্র ক্যাম্পাস-প্রশাসনে জবাবদিহিকে গুরুত্বহীন করে রেখেছে। শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের জীবন্ত যোগসূত্রেও কালে কালে টান পড়েছে অনেক।

এই পরিস্থিতির অবসানে বিদ্যমান ছাত্রসংগঠনগুলো অনেকাংশে ব্যর্থ বহুকাল। অনেক সংগঠন এই পরিস্থিতির অংশীদারও বটে। এরূপ হতাশাকে বাড়তি ওজন দিয়েছে কর্মসংস্থানের সংকট।

এ অবস্থায় তরুণ-তরুণীরা ক্রমে নিজেদের ঘুটিয়ে নিচ্ছে, যা তাদের বয়সের সঙ্গে একদম বেমানান। ক্যাম্পাসগুলোয় তাই প্রাণের জাগরণ জরুরি আজ। প্রতিনিধিত্বের নির্বাচন সেখানে দরকার বটে, তবে কেবল তাতে চলতি গভীর ক্ষত সারবে না। আত্মমর্যাদার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে প্রতিনিধিত্বের পাশাপাশি জরুরি স্বাধীনতা। অধিকার নিয়ে কথা বলার ভীতিহীন পরিসর চাইছে খুদে-প্রাণ-সকল। ফলে, শুধু ডাকসু-রাকসু দিয়ে আর হবে না। তবে অবশ্যই এই প্রতিনিধিত্বশীল ফোরামগুলো লাগবে। প্রয়োজন এগুলোর বিধিবিধানের গণতন্ত্রায়ণও। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ডাকসু-চাকসু-ইকসুর পাশাপাশি আসলে খুঁজছে কর্তৃত্ববাদী অভ্যন্তরীণ পরিবেশ-পরিস্থিতি পাল্টানোর মতো রেনেসাঁস। শুধু নির্বাচন ক্যাম্পাসে গুণগত পরিবর্তন আনতে সক্ষম—এরূপ আশাবাদ তাই খুবই বিপজ্জনক। বরং পরিস্থিতির বদলাতে ‘ক্যাম্পাস ডেমোক্রেসি’র দীর্ঘমেয়াদি চর্চা জরুরি। নির্বাচন কেবল তার ক্ষুদ্র এক উপাদান মাত্র; তাও যদি সুষ্ঠুভাবে হয়!

বহুদিন দেশের প্রচারমাধ্যমে লিখিয়েরা ডাকসুর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরছেন। কিন্তু ক্যাম্পাসগুলোয় গণতান্ত্রিক পরিবেশের ঘাটতি জাতীয় জীবনে যেসব পরিবর্তন এনেছে, সেগুলো নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীরা কথা বলেন সামান্যই।

বাংলাদেশে আজ সুদূর গ্রাম থেকে রাজধানী এবং পরিবার থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত অংশীদারত্বমূলক মনোভাবের যে ঘাটতি, পুরুষতান্ত্রিকতার যে আধিক্য, কেন্দ্রমুখী সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ার যে জয়জয়কার, তার প্রধান এক উৎস প্রায় নিসাড় ক্যাম্পাসগুলো। উচ্চশিক্ষাঙ্গন থেকেই তরুণ-তরুণীরা অংশীদারত্বমূলক সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া ও বিকেন্দ্রীকরণের ধারণা পায়। এখানকার হলজীবন থেকেই তারা স্বশাসিত ও সম্মিলিত এক জীবনবোধের দীক্ষা শেখে। সেসব চর্চার ঘাটতি আমাদের জাতীয় জীবনের রাজনৈতিক-অর্থনীতিই পাল্টে দিচ্ছে। এই পরিস্থিতির পুনর্গঠন তাই জাতীয় এক কর্তব্য।

‘ক্ষমতা’র রাজনীতির খুঁটি নয়, শিক্ষার্থীর ক্ষমতায়ন গুরুত্ব পাওয়া উচিত
কেউ কেউ ডাকসু-রাকসু-চাকসুর ভোট চেয়েছিলেন এই যুক্তিতেও যে জাতীয় রাজনীতি ক্রমে ব্যবসায়ীদের দখলে চলে যাচ্ছে। তরুণদের মধ্য থেকে নেতৃত্ব বিকশিত হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশের প্রকৃত প্রয়োজনটি এই ব্যাখ্যায় আড়ালে পড়ে। বাংলাদেশে আজ আসলে নতুন নেতৃত্ব নেয়, নতুন রাজনৈতিক-দার্শনিক ধারণা প্রয়োজন। সেটার জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় প্রাণের জাগরণ দরকার। ডাকসু-ইকসু-রাকসু কতটা জাতীয় প্রয়োজন মেটাতে পারবে, তার চেয়ে গভীর ভাবনা প্রয়োজন এই সংস্থাগুলো আদৌ খোদ বিশ্ববিদ্যালয়কে নতুন কিছু দিতে আর সক্ষম কি না?

ডাকসু নির্বাচনকে টেনে এনে বিশ্ববিদ্যালয়কে জাতীয় রাজনীতির এক্সটেনশন হিসেবে ভাবা অতি পুরোনো অপ্রয়োজনীয় কৌশল। বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘ক্ষমতা’র রাজনীতির খুঁটি না ভেবে সমগ্র শিক্ষার্থীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নটিই গুরুত্ব পাওয়া উচিত। স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচনী আলোচনার মধ্যে এখন নবীন শিক্ষার্থীদের মনে ভাবনা তৈরি হয়েছে—নির্বাচিত ডাকসু হলে হলে মহাপরাক্রমশালী ‘বড় ভাই’দের নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম কি না, যেখানে সিটের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে মিছিলে যেতে হবে না। একটি নতুন রাকসু কি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট বরাদ্দের বর্তমান ধরন পাল্টাতে পারবে? আরেকটি নতুন ইকসু কি এই নিশ্চয়তা দিতে পারবে যে বিভাগগুলোর সিদ্ধান্তগ্রহণের প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীদের মতামতও নেওয়া হবে?

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রকৃতই গণতান্ত্রিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের জন্য এই বিষয়গুলো জরুরি। শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাই এ মুহূর্তের আরজি তাদের অঙ্গনগুলো গণতান্ত্রিক করে তোলা। ডাকসু নির্বাচনকালে নূরুল হক নূরু, হাবিবা বেনজীর, লিটন নন্দী, রেজানুল হক শোভন, মোস্তাফিজুর রহমানদের সামনে চ্যালেঞ্জটি ঠিক এখানেই। ক্যাম্পাসগুলো তাদের মধ্যে পুরোনো দিনের আ ফ ম মাহবুবুল হকদেরই খুঁজছে, যারা সাহসের সঙ্গে সময়ের প্রত্যাশাকে ধারণ করে আলাপ-আলোচনার একটা নতুন সংস্কৃতি পুনর্নির্মাণে নামবে আবার। তবে স্বশাসিত, মুক্ত তরুণ-তরুণীরাই কেবল সেই নতুন সংস্কৃতির চূড়ান্ত ভিত গড়তে পারে, এখনো যা আমাদের বিদ্যাপীঠে নেই। স্বশাসিত ও মুক্ত তরুণ-তরুণীদের সংখ্যা যত বাড়বে, ততই তারা নিজেরা কর্তৃত্বের ভরকেন্দ্রগুলো চিহ্নিত করতে সক্ষম হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতন্ত্রের ধারা এগিয়ে নিতে পারবে। ডাকসু নির্বাচনের ‘উপলক্ষ’ যেন সমগ্র দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় সেই ‘লক্ষ্যে’ টেনে নিয়ে যায়।

আলতাফ পারভেজ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী