জননিরাপত্তা না থাকলে উন্নয়ন অর্থহীন

আমরা প্রতিনিয়তই মুখস্থ করছি দেশের উন্নয়ন ফর্দ। গর্বে বুক অনেকখানিই চওড়া হয়ে যায়, যখন শুনি বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে এবং বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ শক্তিশালী জায়গাগুলো থেকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশ বেশ বাহবাও কুড়িয়েছে। উন্নয়ন হচ্ছে, সবাই দেখছে। সবার হাতে হাতে মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট–সেবা চলছে শহর-গ্রামে-গঞ্জে। পাতাল ট্রেন চলবে সামনেই। রাস্তায় অনেক গাড়ি। উৎসব-পার্বণে অনেক কেনাকাটা করা হচ্ছে। ২০১৮ সালে প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশের মানুষের বার্ষিক মাথাপিছু আয় এখন ১ হাজার ৭৫১ মার্কিন ডলার। এর অর্থ, বাংলাদেশের একজন মানুষ বছরে গড়ে ১ লাখ ৪৩ হাজার ৭৮৯ টাকা আয় করেন। কিন্তু যে জায়গাটার উন্নয়ন এখনো হয়নি, সেটি হলো মানুষের জীবনের মূল্যায়ন।

বাংলাদেশে বেশ কিছু জায়গায় সরকারি উন্নয়নের আঁচড় পড়লেও জননিরাপত্তা বিষয়টিতে যে কোনো ধরনের পরিবর্তন আসেনি, তা পরপর কয়েকটি বড়সড় দুর্যোগ ভালোভাবেই আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে। আমরা সবাই যখন এই উন্নয়ন তকমায় বুঁদ হয়ে আছি, তখন সরকারের এই উন্নয়ন–বন্দনাকে তুড়ি মেরে একে একে আমাদের সংগ্রামী জীবনে উঁকি দেয় বিপর্যয়গুলো, এক দিনেই উড়ে যায় ১০০-র ওপর জীবন। কখনো কখনো এর সংখ্যা আরও বেড়ে হাজারে পৌঁছায়। যেমন হয়েছিল রানা প্লাজায়। এগুলো যেন উন্নয়নের পাখায় ঘুরে বেড়ানো এক একটি ফাঁদ আর আমরা সেখানে আটকে আছি। সেই ফাঁদেরই একটি—চকবাজারের অগ্নিকাণ্ড। জানান দিয়ে গেল সবচেয়ে মূল্যবান কথাটি: জননিরাপত্তাই উন্নয়নের প্রধান শর্ত হওয়া প্রয়োজন। একের পর এক মানবিক বিপর্যয় একটি বিষয়কেই সামনে আনছে আর তা হলো দেশ ডিজিটালাইজড হলেও, সব তথ্য হাতের মুঠায় এলেও, জীবনই শুধু হাত ফসকে পড়ে যায়। কারণ, এখানে মানুষের জীবনের মূল্য নেই।

পুরান ঢাকার অবস্থা কি সরকারের অজানা ছিল? ঢাকা দক্ষিণের মেয়রের জানার বাইরে ছিল? না, ছিল না। নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পর তৈরি হওয়া তদন্ত কমিটির রিপোর্টের সুপারিশগুলো তাদের কাছে ছিল। তারপরও তাদের কাছে মানুষের জীবন গুরুত্ব পায়নি। এর বাইরে বেশ কয়েক বছর ধরেই পুরান ঢাকায় ভূমিকম্প ও অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি নিয়ে অনেক গবেষণা রিপোর্টও প্রকাশিত হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস ইউনিভার্সিটির সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ও আরবান অ্যান্ড রিজিওনাল প্ল্যানিং বিভাগের যৌথ উদ্যোগে পুরান ঢাকার ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের ৩৫০টি ভবনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সেখানকার প্রায় ৮০ শতাংশ বাড়িতে অগ্নিকাণ্ড ঘটতে পারে, এমন সব উপকরণ মজুত রয়েছে (দৈনিক বণিক বার্তা, ২৪ ফেব্রুয়ারি)। আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, রাজধানীর লালবাগ ফায়ার স্টেশন ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত আগুন নেভানোর ৮০টি ডাক (কল) পেয়েছিলেন। তার ৭৪ শতাংশই ছিল প্লাস্টিকের কারখানা, গুদাম ও দোকানের। এর মধ্যে প্লাস্টিকের কারখানা প্রায় ৪৮ শতাংশ। গড়ে প্রতি মাসেই একটি প্লাস্টিকের কারখানায় আগুন লাগে। আর এখানকার ৭০ শতাংশের বেশি আবাসিক ভবনের নিচে কারখানা অথবা গুদাম ভাড়া দেওয়া হয়েছে (প্রথম আলো, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯) এর মধ্যে ৫০ শতাংশ বাড়ির নিচেই রয়েছে রাসায়নিকের গুদাম। এসব তথ্য নতুন নয়, সরকারি ভান্ডারে এবং নগর ভবনে নিশ্চিতভাবেই রয়েছে। কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

২০১৩ সালে দেশকাঁপানো রানা প্লাজা ধসে নিহত হয়েছিলেন প্রায় ১ হাজার ২০০ শ্রমিক। এর বাইরে যাঁরা বেঁচে গেছেন, তাঁদের অনেকেই জীবন্মৃত হয়েই আছেন। তবু এখন পর্যন্ত প্রতিটি কারখানায় শ্রমিকের নিরাপত্তার বিষয়গুলো নিশ্চিত করা হয়নি।

আসলে আমরা কী ধরনের উন্নয়ন চাই, কাদের জন্য কী ধরনের উন্নয়ন দরকার? এই বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা তাত্ত্বিকভাবে এগোলেও কাজ কিছু হয় না। তাই মানুষের উন্নয়ন ধারণা কী, সেটি সরকারকে বুঝতে হবে সবার আগে। যে উন্নয়ন জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে না, তা অর্থহীন।

 কয়েক বছর আগে আমি পার্বত্য চট্টগ্রামের রোয়াংছড়ির এক দুর্গম এলাকা খুমিপাড়ায় গিয়েছিলাম। প্রায় চারটি পাহাড় পাড়ি দিয়ে যেতে হয়েছিল সেই গ্রামে। আমি এক খুমি বন্ধুকে বলেছিলাম, রাস্তা নেই এখানে আসার, তোমাদের কষ্ট হয় না। তখন সে বলেছিল, তারা সেখানে রাস্তাঘাট চায় না। রাস্তাঘাট হলেই সেখানে অন্যদের যাতায়াত শুরু হবে, তাদের জীবন আর তাদের থাকবে না। তাই জননিরাপত্তার মতো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি যদি উন্নয়ন মাপার নিক্তিতে না আনা যায়, তাহলে এই উন্নয়ন কার জন্য?

জোবাইদা নাসরীন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক
[email protected]