পাকিস্তানে ভারতের 'চীন সমস্যা'

পুলওয়ামায় আধা সামরিক বাহিনীর কনভয়ে সন্ত্রাসী হামলার জের ধরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে, তার শান্তিপূর্ণ অবসান হবে—এমনটি যে কেউ আশা করতে পারেন। কিন্তু এই উত্তেজনার অবসান হওয়ার পর আরেকটি সংকটের ওপর অনিবার্যভাবে সবার দৃষ্টি পড়বে। সেই সংকটটির নাম ‘চীন’। জম্মু-কাশ্মীরের পুলওয়ামায় হামলার পর পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠন জইশ-ই–মুহাম্মদকে চীনের মদদ দেওয়ার প্রশ্নটি আবার সামনে চলে এসেছে। হামলার পরপরই সন্ত্রাসী সংগঠনটি তার দায় স্বীকার করে। ২১ বছরের এক তরুণ প্রায় ৩৫০ কেজি ওজনের বিস্ফোরক নিয়ে ৭৮ জন জওয়ানকে বহনকারী একটি সামরিক যানে আত্মঘাতী হামলা চালান। হামলায় হামলাকারী ও ৪০ জন জওয়ান নিহত হন। এই হামলাকে জইশ–ই–মুহাম্মদ তাদের অন্যতম সাফল্য হিসেবে দেখছে।

জইশ-ই-মুহাম্মদের প্রধান মাওলানা মাসুদ আজহারকে জড়িয়ে ভারতের একটি অবমাননাকর ইতিহাস আছে। মাসুদ আজহার একসময় ভারতের জেলে বন্দী ছিলেন। ১৯৯৯ সালে আফগানিস্তানে তালেবানের শাসনামলে পাকিস্তানের কিছু সন্ত্রাসী কান্দাহার থেকে ভারতীয় যাত্রী বহনকারী একটি বিমান ছিনতাই করেছিল। সন্ত্রাসীরা যাত্রীদের মুক্তিপণ হিসেবে মাসুদ আজহারের মুক্তি চেয়েছিল। যাত্রীদের অক্ষত অবস্থায় ফিরে পাওয়ার বদলে তখন ভারত মাসুদ আজহারকে মুক্তি দিয়েছিল। মাসুদ আজহারের সঙ্গে ভারতকে এমন আরেকজনকে ছাড়তে হয়েছিল, যিনি মার্কিন সাংবাদিক ড্যানিয়েল পার্লের হত্যায় জড়িত ছিলেন। জইশ-ই-মুহাম্মদ ২০১৬ সালে উরি এলাকায় সেনা ঘাঁটিতে হামলা চালিয়ে ১৯ সেনাকে হত্যা করেছিল, যার বদলা হিসেবে ভারত পাকিস্তানে ঢুকে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ করেছিল।

পাকিস্তান যদিও তার ভূখণ্ডে কিছু কট্টর ইসলামপন্থী সন্ত্রাসীর সঙ্গে (বিশেষ করে কথিত পাকিস্তানি তালেবানের সঙ্গে, যারা পাকিস্তান সরকারকে উৎখাত করতে চায়) লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, তবু কৌশলগত কারণে সেই পাকিস্তানই ভারত, ইরান ও আফগানিস্তানকে লক্ষ্য করে হামলা চালানো বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনকে অর্থ, প্রশিক্ষণ, অস্ত্র এবং অন্যান্য দিক দিয়ে মদদ দিয়ে যাচ্ছে।

পাকিস্তানের ভাওয়ালপুর ও বালাকোটে (যেখানে ভারত ২৬ ফেব্রুয়ারি বিমান হামলা চালিয়েছে) মাসুদ আজহার এবং জইশ-ই-মুহাম্মদের সদস্যরা প্রকাশ্যে সশস্ত্র সন্ত্রাসী শিবির পরিচালনা করে থাকেন। মাসুদ আজহার পাকিস্তানের সর্বত্রই স্বাধীনভাবে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে বয়ান করেন। ২০০৮ সালে মুম্বাইয়ে হামলা চালিয়ে ১৬৬ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছিল যে লস্কর-ই-তাইয়েবা, তার প্রধান হাফিজ সাঈদও একইভাবে প্রকাশ্যে স্বাধীনভাবে বিভিন্ন সভায় বক্তব্য দিয়ে থাকেন। ভারত সরকার জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে মাসুদ আজহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের চেষ্টা করে যাচ্ছে। এটি করতে পারলে মাসুদ আজহারের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হবে এবং পাকিস্তানের বাইরে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হবে। তিন–তিনবার এই প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে তোলা হয়েছে। কিন্তু ১৫ সদস্যের ১৪ সদস্য রাজি থাকলেও পাকিস্তানের মিত্র চীন প্রতিবারই এই প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে।

চীনের এই ভেটো দেওয়ার কারণ আন্দাজ করা শক্ত কিছু নয়। চীন সব সময়ই নিজেকে পাকিস্তানের ‘সার্বক্ষণিক বন্ধু’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে, যেটিকে চীনের ভারতবিরোধিতা হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। চীনের প্রস্তাবিত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্প নির্মীয়মাণ চায়না–পাকিস্তান ইকোনমিক করিডরের (সিপিইসি) সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এই বিআরআই পাকিস্তানের বেলুচিস্তান উপকূলের গোয়াদার বন্দরের সঙ্গে চীনের পশ্চিমাঞ্চলকে যুক্ত করবে। এ কারণে বিআরআইয়ের জন্য পাকিস্তান চীনের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৬ হাজার ৬০০ কোটি ডলারের সিপিইসি প্রকল্পটি শেষ হলে এটিই হবে বাইরের কোনো দেশে চীনের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন প্রকল্প। এর মাধ্যমে উপসাগরীয় দেশগুলোতে চীনের পণ্য আনা–নেওয়ার খরচ অর্ধেকেরও নিচে নেমে আসবে। এই প্রকল্প চীনের জন্য শুধু যে মর্যাদার বিষয় তা–ই নয়, এটি অর্থনৈতিকভাবেও তার জন্য সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ। ধারণা করা যায়, এই প্রকল্পের গুরুত্বের জন্যই চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক তৈরি হয়েছে।

পুলওয়ামা হামলার বিষয়ে বিশ্বব্যাপী যে নিন্দা হয়েছে, তাতে চীন আনুষ্ঠানিকতা রক্ষার মতো করে শামিল হয়েছে। তবে চীন সরকার আবারও স্পষ্ট করেছে, মাসুদ আজহারকে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে তারা তাড়াহুড়া করতে রাজি নয়।

আগামী এপ্রিলেই ভারতে জাতীয় নির্বাচন। সে কারণে স্বাভাবিকভাবেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জইশ-ই-মুহাম্মদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে দেশবাসীর চাপে আছেন। হামলার পরপরই মোদি বলেছেন, ‘ভারতের মানুষ ক্ষোভে ফুঁসছে। আমরা অবশ্যই এর দাঁতভাঙা জবাব দেব।’ এরপরই ভারত হামলা চালায়। ভারতের একটি জেটকে পাকিস্তানিরা গুলি করে ভূপাতিত করে এবং এর পাইলট পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়েন। ওই পাইলটকে পাকিস্তান ফিরিয়ে দেওয়ায় পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়েছে। দুটি দেশই যুদ্ধের খুব কাছাকাছি গেলেও ভারত ভালো করে বুঝতে পারছে, তার সামনে প্রধান বিকল্প হলো কূটনৈতিক প্রক্রিয়া।

সন্ত্রাসে মদদ দেওয়ার অভিযোগে পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ‘একঘরে’ করে ফেলার ভারতীয় চেষ্টা বারবারই চীন ব্যর্থ করে দিয়েছে। অন্য দেশগুলোও দ্বিপক্ষীয় স্বার্থের কারণে পাকিস্তানকে বয়কট করতে পারছে না। আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে, বিশেষ করে তালেবানের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে পাকিস্তানকে যুক্তরাষ্ট্রের দরকার। এ কারণে ওয়াশিংটনও ইসলামাবাদকে খুব একটা চাপে রাখতে পারছে না।

পাকিস্তানের মাথার ওপর থেকে চীনের ছত্রচ্ছায়া সরিয়ে নেওয়ার জন্য ভারত নতুন করে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিরোধী দলে থাকার সময় নরেন্দ্র মোদি চীনের সঙ্গে ভারত সরকারের সম্পর্কোন্নয়নের বিরোধিতা করতেন। সেই মোদি গত বছর চীন সফর করে দেশটির অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। তাতে অবশ্য চীন তার অবস্থান থেকে মোটেও সরে আসেনি। নিউক্লিয়ার সাপ্লায়ার্স গ্রুপে ভারতের প্রবেশ ঠেকানোর জন্য দেশটি এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর দিয়ে চীনের সিপিইসি প্রকল্প এগিয়ে নেওয়া ঠেকাতেও পারছেন না মোদি।

গত বছর ভারতের সংসদের পররাষ্ট্রবিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটি (আমি ওই কমিটির সভাপতি) ইন্দো-চীন সম্পর্ক নিয়ে একটি প্রতিবেদন পেশ করেছিল। সেই প্রতিবেদনে মোদি সরকারকে চীনের স্পর্শকাতর কর্মকাণ্ডের বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে এবং চীনের বিষয়ে ‘শ্রদ্ধাপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি’ অনুসরণ না করতে বলা হয়েছে। দিন যত যাচ্ছে ওই প্রতিবেদনের বক্তব্যের সত্যতা তত বেশি সত্য হয়ে ধরা দিচ্ছে।

ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

শশী থারুর ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী