ব্যবসায় বাংলাদেশের নারীদের ভবিষ্যৎ যেখানে

লৈঙ্গিক সমতা শুধু নারীদের বিষয়ই নয়, এটি একটি ব্যবসাসংক্রান্ত বিষয়ও বটে। ম্যাককিঞ্জি গ্লোবাল ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের নারীরা কর্মক্ষেত্রে সমান সুযোগ পেলে যে অতিরিক্ত জিডিপি অর্জিত হবে, তা জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার প্রতিবছরের মোট অর্থনীতির আয়তনের সমান। কিন্তু অর্থনৈতিক অর্জনের বাইরেও নারী নেতৃত্ব সমাজের জন্য পরিবর্তন ও অগ্রগতির অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

বাংলাদেশের মেয়ে নুসরাত আক্তার লোপার কথাই ধরা যাক। রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে ওঠার কারণে উচ্চাকাঙ্ক্ষা থাকা সত্ত্বেও পড়াশোনা ও ডিগ্রি অর্জনের জন্য তাঁকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করার পর তিনি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু লোপার মা-বাবা এতে আপত্তি করেন। কারণ, তাঁদের মতে, বাড়ির বাইরে গিয়ে চাকরি করা মেয়েদের কাজ নয়।

একজন দক্ষ ক্লথ ডিজাইনার হিসেবে লোপা তাঁর ব্যবসার পরিসর বৃদ্ধি করে পণ্যগুলো বেশিসংখ্যক গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ফেসবুকের ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের ওপর কোর্স করার সিদ্ধান্ত নেন। মাত্র ১ হাজার ২০০ টাকা মূলধন নিয়ে যাত্রা শুরু করে তিনি একপর্যায়ে লক্ষ করলেন, তাঁর পণ্যের চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে তাঁর পণ্য বিশ্বের ১২টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এ বছর মোট তিন কোটি টাকার ব্যবসায়িক লেনদেন হবে বলে তিনি আশা করেন। এ পর্যন্ত তিনি সাতজনের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান করেছেন।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে নুসরাত আক্তার লোপার মতো নারীদের অর্জন উদ্‌যাপন করার পাশাপাশি তাঁরা এখনো কী কী বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন, সেগুলো চিহ্নিত করা এবং লৈঙ্গিক সমতার পথ খুঁজে বের করা আমাদের দায়িত্ব।

পুরুষ এবং নারী ব্যবসায়ীদের অভিজ্ঞতা ও চাহিদার পার্থক্য আরও স্পষ্টভাবে বোঝার জন্য ফেসবুক, বিশ্বব্যাংক এবং ওইসিডির সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বিশ্বজুড়ে ফেসবুকের ৯০ মিলিয়নের বেশি ক্ষুদ্র ব্যবসার ওপর জরিপ চালিয়ে ফিউচার অব বিজনেস রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে। এটি এসএমবি পরিচালিত বৃহৎ পরিসরের বৈশ্বিক জরিপগুলোর মধ্যে অন্যতম।

সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী ফেসবুকে বাংলাদেশের নারী ব্যবসায়ীরা এখনো বিনিয়োগসংক্রান্ত সমস্যায় পড়েন। পাঁচজন নারী ব্যবসায়ীর মধ্যে মাত্র একজনের ব্যাংক লোন বা ঋণ নেওয়ার সুবিধা রয়েছে। আমরা জানি, সমগ্র এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের নারী উদ্যোক্তারা এই সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকেন। বাহ্যিক বিনিয়োগ উৎস পাওয়ার ক্ষেত্রে অসুবিধার সম্মুখীন হওয়ার পাশাপাশি পেশাগত ও পারিবারিক চাহিদাগুলোর ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য তাঁদের প্রায়ই দ্বিগুণ কাজ করতে হয়। পুরুষদের চেয়ে নারীদের বাড়ির বাইরে গিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করার সম্ভাবনা কম, যার ফলে তাঁরা ব্যবসায়িক বৃদ্ধি ও ক্রমোন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় নেটওয়ার্ক তৈরির সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন।

তবু আশাবাদী হওয়ার অনেক কারণ আছে। ডিজিটাল প্রযুক্তির সহজলভ্য সুবিধার কারণে কর্মক্ষেত্রে সমতা তৈরি হচ্ছে। এটি নারী উদ্যোক্তাদের একটি নতুন প্রজন্ম সৃষ্টি করেছে, এমনকি এক-নারীকেন্দ্রিক ক্ষুদ্র বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করছে, যেগুলো ব্যবসা সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে যোগাযোগ ও কমিউনিটিকে ব্যবহারের সুবিধা পাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ফেসবুকে ক্ষুদ্র ব্যবসার একটি বড় অংশের মালিকানা ও পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন নারীরা। জরিপকৃত ৯৫টি দেশে আমরা দেখেছি যে ফেসবুকে ক্ষুদ্র ব্যবসার মালিকানা বা পরিচালনায় থাকা প্রতি ১০ জন ব্যক্তির ৪ জনই নারী (৩৯ শতাংশ)।

বাংলাদেশে ব্যবসার ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অবদানের কথা উল্লেখ করা ফেসবুকের নারী ব্যবসায়ীদের সংখ্যা পুরুষ ব্যবসায়ীদের তুলনায় বেশি। প্রতি ১০ জন নারীর মধ্যে ৯ জনই বলেছেন যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তাঁদের ব্যবসায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। আমাদের প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তারা কমিউনিটি এবং পরামর্শকদের মাধ্যমেও উপকৃত হয়েছেন। প্রতি ৪ জনের ৩ জন তাঁদের রোল মডেল থাকার কথা উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া ১০ জনের মধ্যে ৬ জন বলেছেন, তাঁদের রোল মডেল একজন নারী।

যোগাযোগ এবং পরামর্শ প্রায়ই স্বপ্ন দেখা ও বাস্তবায়নের মধ্যে পার্থক্য তৈরি করে দেয়। এ জন্য আমরা ‘হ্যাশট্যাগ শি মিনস বিজনেস’ উদ্যোগটিতে বিনিয়োগ চালিয়ে যাচ্ছি। এটি একটি বিশ্বব্যাপী উদ্যোগ, যা নারীদের তাঁদের ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করে। এই কর্মসূচির মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা, পরামর্শ, ট্রেনিং এবং পরামর্শদাতা ও সমপর্যায়ের ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত কমিউনিটির সহযোগিতা প্রদান করা হয়। এ পর্যন্ত আমরা ১ লাখ ৩৬ হাজারের বেশি নারীকে প্রশিক্ষিত করেছি এবং ২৪টি দেশে আমরা আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।

আমাদের প্ল্যাটফর্মে নারী নেতৃত্বাধীন ব্যবসাগুলোকে বিকশিত হতে দেখে এবং তাঁদের অগ্রযাত্রার গল্পের অংশীদার হতে পেরে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। যখন নারী উদ্যোক্তারা সফল হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ, প্রযুক্তি ও দক্ষতা অর্জনের সুবিধা পাবেন, তখন তাঁরা অর্জিত জ্ঞান ভাগ করে নেওয়ার পাশাপাশি সম্মিলিতভাবে ব্যবসার ভবিষ্যৎ গড়তেও সক্ষম হবেন।

আঁখি দাস: ফেসবুক দক্ষিণ এশিয়ার পলিসি ডিরেক্টর