বদলের জন্য চাই উদ্ভাবন

ভাবি সমান, গড়ি চৌকস, বদলাই নতুনে—স্লোগান সামনে রেখে এবার পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ১৯০৮ সালে নিউইয়র্কে নারীরা পথে নেমেছিলেন, তাঁরা দাবি তুলেছিলেন কাজের সময় কমিয়ে আনার, ভালো বেতনের আর ভোট দেওয়ার অধিকারের। পরের বছর, ১৯০৯ সালে আমেরিকার সোশ্যালিস্ট পার্টি দিনটিকে জাতীয় নারী দিবস হিসেবে পালন করে। ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে ১৭ দেশের ১০০ নারীর এক সম্মেলনে ক্লারা জেটকিন দিনটাকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার ডাক দেন। ১৯১১ সালে নারী দিবস পালিত হয়। বিবিসি তাই বলছে, এ বছর নারী দিবসের ১০৮তম বার্ষিকী। জাতিসংঘ ১৯৭৫ সাল থেকে নারী দিবস পালন করে আসছে।

এবারের স্লোগানে সমানভাবে ভাবার কথা আছে। নারী-পুরুষ সমান, এই ভাবনাটা যেমন থাকবে, তেমনি নারী আর পুরুষও সমানভাবে ভাববে, সেই আহ্বানটাও এর মধ্যে আছে। ইংরেজি কথাটা এমন—থিংক ইকুয়াল, বিল্ড স্মার্ট, ইনোভেট ফর চেঞ্জ। স্মার্ট কথাটার নানা ব্যঞ্জনা আছে। বুদ্ধিমানকে স্মার্ট বলা হয়, আবার আমাদের হাতের মোবাইল ফোনটাও স্মার্ট হতে পারে। এখন তো স্মার্ট টিভি, স্মার্ট বাড়ি, স্মার্ট মেশিন—কত কিছুই আমাদের চারপাশে। বিল্ড স্মার্ট কথাটার মধ্যে কি সেই আহ্বানও আছে? পরের দফাতে তা খানিকটা পরিষ্কার হয়। ইনোভেট ফর চেঞ্জ। নতুন কিছু উদ্ভাবন করো পরিবর্তনের জন্য।

নারী-পুরুষের সমতার জন্য নতুন বুদ্ধি, নতুন চিন্তা, নতুন প্রযুক্তি, স্মার্ট উপায় উদ্ভাবনের ডাক এবারের নারী দিবস দিচ্ছে। একেকটা নতুন আবিষ্কার একেকটা নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। আমরা জানি, উৎপাদনযন্ত্র বদলে দিতে পারে উৎপাদন পদ্ধতি। তা থেকে বদলে যেতে পারে উৎপাদন সম্পর্ক। যেমন কোনো বিশ্লেষক বলেন, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির আবিষ্কার নারীকে মুক্তির পথে অনেকটাই এগিয়ে নিয়েছে।

তেমনিভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদির প্রয়োগ আগামী ২০ বছর পরে দুনিয়াটাকে যে কোথায় নিয়ে যাবে, তা আমরা ভাবতেও পারছি না। কারখানায় যদি শ্রমিকই না লাগে, শ্রমশোষণই বা হবে কী করে! আবার পৃথিবীর সব সম্পদ অল্প কয়েকজন মানুষের কাছে চলে যাচ্ছে। তাঁরা যদি সব কলকারখানা ব্যবসা-বাণিজ্যের মালিক হন, আর প্রযুক্তি যদি মানুষের শ্রম ছাড়াই তাঁদের সেই কলকারখানা, ব্যবসা চালিয়ে নিয়ে যায়, তাহলে পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কোনো কাজই থাকবে না। সে হবে এক নতুন বিশ্বব্যবস্থা, যেখানে কোটি মানুষের কোনো অর্থনৈতিক উপযোগিতা থাকবে না। সোজা কথায়, তারা বেকার থাকবে। সোজা কথায় তাদের কোনো আয় থাকবে না। ভয়াবহ ব্যাপার হবে।

তেমনি প্রযুক্তি তো মানুষকে মুক্তিও দিতে পারে। ধরা যাক, আজকে কুড়িগ্রামের চরে যে নারী আছেন, তাঁর স্বামী কাজের সন্ধানে গেছেন চট্টগ্রামে, হয়তো জাহাজভাঙার কাজ করছেন। নারীটির টাকা দরকার। এক নিমেষেই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে টাকা পৌঁছে যাচ্ছে কুড়িগ্রামে।

এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের স্লোগানে এই নতুন উদ্ভাবনের কথা বলা আছে। যে আসুন, আমরা নারী-পুরুষের সমতাবিধানের জন্য স্মার্ট উদ্ভাবনে মনোনিবেশ করি। জাতিসংঘের চিন্তার মধ্যে এটাও আছে যে প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, গণিত ইত্যাদিতে নারীর অংশগ্রহণ কম। এটা ভবিষ্যতে বৈষম্য বাড়িয়ে দেবে।

আর আছে এসডিজি। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০। ২০৩০ সালের মধ্যে সব ছেলে আর মেয়ে বিনা পয়সায় প্রাথমিক এবং জুনিয়র পর্যায়ের শিক্ষা লাভ করবে। শিক্ষাটা হবে মানসম্মত শিক্ষা।

২০৩০ সালের মধ্যে নারী-পুরুষ সব শিশুই স্কুলে যাওয়ার আগেই প্রি–প্রাইমারি শিক্ষা পাবে, যত্ন পাবে, তাদের বিকাশ হবে, যাতে তারা স্কুলে যাওয়ার উপযুক্ততা অর্জন করতে পারে। নারী ও বালিকাদের বিরুদ্ধে সব রকমের, সব ধরনের বৈষম্যের অবসান ঘটবে। ঘরে-বাইরে নারীর বিরুদ্ধে সব ধরনের সহিংসতার অবসান ঘটবে। নারী পাচার, যৌন শোষণ, নির্যাতন চিরতরে বন্ধ হবে। জোর করে বিয়ে দেওয়া, শিশুবিবাহ, বাল্যবিবাহ, মেয়েদের খতনার মতো কুপ্রথাগুলোর চির অবসান ঘটানো হবে।

বাংলাদেশ নানা ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা সৃষ্টিতে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আমাদের মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে বেশি করে স্কুলে যায়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী নারী, আমাদের স্পিকার নারী। আমাদের মেয়েদের ফুটবল দল, ক্রিকেট দল ভালো করছে। এসবই আদর্শ উদাহরণ। গার্মেন্টস সেক্টরে লাখ লাখ নারী কাজ করছেন। তাঁরা দল বেঁধে কারখানায় যান, বাড়ি ফেরেন।

কিন্তু তুলনা করলে দেখা যায়, আমাদের সমাজটা আসলে পুরুষশাসিত। ধরা যাক, আমাদের জাতীয় সংসদে নারী-পুরুষের ভারসাম্য নেই। আমাদের মন্ত্রিপরিষদে নারী-পুরুষের সংখ্যা সমান নয়। আমেরিকার মতো দেশই এখনো একজন নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করতে পারেনি। আমাদের দেশে দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক একজন নারী, এটা খুব একটা দেখা যায় না।

অন্যদিকে নারী তো নানা রকমের সহিংসতার শিকার। কী পরিবারের ভেতরে, কী রাস্তাঘাটে! ইভ টিজিং একটা সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছিল। ধর্ষণ, যৌন হয়রানি খুবই বড় সমস্যা হয়ে আছে। অ্যাসিড–সন্ত্রাস কমে গেছে, কিন্তু তার অবসান ঘটেনি। মি টু আন্দোলনে আমরা দেখেছি, দেশে দেশে নারীদের কত হয়রানি, যুদ্ধ–সংগ্রামের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। এখনো যুদ্ধে নারী শিশুরাই সবচেয়ে অসহায়। রেপ এখনো যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা নারীদের কতজনই না ধর্ষণের শিকার হয়ে এসেছেন!

সবচেয়ে বড় সমস্যা আমাদের মনে। আমরা এখনো নারী আর পুরুষকে সমানভাবে দেখি না। সেই জন্যই থিংক ইক্যুয়াল, ভাবি সমান, এই কথাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। নিশ্চয়ই নারী আর পুরুষ দুইটা সত্তা, কিন্তু কেউ কারও চেয়ে বড় বা ছোট নয়; দুজনেই সমান। আমেরিকার মতো দেশে নারীদের ভোটাধিকার ছিল না সেই দিনও। এখনো একই পদে কাজ করে নারীর বেতন পুরুষের চেয়ে কম। আর বলা হয়ে থাকে, কাচের ছাদের কথা, গ্লাস সিলিং। একটা পর্যায়ের পরে আর নারীকে ওপরে উঠতে দেওয়া হয় না।

নোবেল পুরস্কার এ পর্যন্ত পেয়েছেন ৮৫৩ জন পুরুষ আর ৫১ জন নারী।

আমাদের সাহিত্যে, আমাদের চলচ্চিত্রে, আমাদের বাগধারায় পুরুষাধিপত্যের চিহ্ন পরতে পরতে রয়ে গেছে। জীবনানন্দ দাশের মতো কবি বলেছেন, পৃথিবীর পথে–পথে সুন্দরীরা মূর্খ সসম্মানে শুনিল আধেক কথা, এই সব বধির নিশ্চল সোনার পিত্তল মূর্তি...নারী আর পুরুষ নিয়েই আমাদের পৃথিবী। সবাই মিলে আমরা ভালো থাকব, অথবা খারাপ থাকব। হাতে হাত রেখে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই চলতে হবে। ইতিবাচক বৈষম্য বা কোটারও দরকার পড়বে। একটা সময় হয়তো আর আলাদা করে নারী দিবসের দরকার পড়বে না।

আমি একটা বই লিখেছি এবার—সফল যদি হতে চাও। অনেক সফল মানুষের জীবনের উদাহরণ দিয়েছি সেই বইয়ে। একটা বাচ্চা মেয়ে এসে আমাকে বলল, আপনার সফল মানুষদের মধ্যে একজনও নারী নেই কেন? আমি ভীষণ লজ্জা পেলাম। এবং বুঝলাম, আমার নিজের লেন্সেই সমস্যা আছে। আর কারও কথা না বললেও, বেগম রোকেয়ার কথা আমি বাদ দিলাম কীভাবে?

রংপুরের পায়রাবন্দে এক বালিকা একা একা রাত জেগে পড়াশোনা করে। তার বাড়িতে বাংলা কথা বলা পাপ, ইংরেজি তো মহাপাপ। বালিকা পড়ে, পাশে নিদ্রিত ভাইয়ের ঘুমে যাতে ব্যাঘাত না ঘটে, সে জন্য প্রদীপের চিমনিতে একটা কার্ড দিয়ে রাখে। সেই মেয়ে এমন বাংলা শিখল, এমন ইংরেজি শিখল, যে বড় হয়ে তিনি লিখে ফেললেন অবরোধবাসিনী, মতিচূর, সুলতানার স্বপ্ন; লিখলেন সুলতানা’স ড্রিম। স্কুল বানালেন। ছাত্রী পেতেন না। বাড়ি বাড়ি গিয়ে হাতে-পায়ে ধরে ছাত্রী আনতেন।

একজন নারী আলোকিত হয়ে আলোকিত করে তুললেন একটা গোটা দেশকে। বেগম রোকেয়াই তো আমাদের শেখাচ্ছেন—ভাবি সমান, হই চৌকস, বদলাই নতুনে।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক