'৩০ ডিসেম্বরের মতো নির্বাচন চাই না'

কয়েক দিন আগেও সন্দেহ ছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন হবে কি না। এমনকি তফসিল ঘোষণার পরও অনেকে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু গত বুধ ও বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখি, ভোটের উৎসব বেশ জমে উঠেছে। ছোট-বড়, ডান-বাম সব ছাত্রসংগঠন নিজ নিজ প্যানেলের পক্ষে জোর প্রচার চালাচ্ছে। শুধু ছাত্রসংগঠন নয়, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মিলেও একাধিক জোট করেছেন। তাঁরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে ভোট চাইছেন। লিফলেট বিলি করছেন। ছাত্রলীগ ছাড়া কোনো সংগঠন হল সংসদে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল দিতে না পারলেও ডাকসুতে প্যানেলের ছড়াছড়ি। প্যানেলের বাইরেও অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থী আছেন। ভিপি পদে মোট ২১ জন প্রার্থী আর জিএস পদে ১৪ জন। ডাকসুর ইতিহাসে এটাই সর্বোচ্চ সংখ্যা।

আজ ৯ মার্চ। ১১ মার্চ ডাকসু ও হল ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন। ২৮ বছর পর নির্বাচন হচ্ছে বলে প্রার্থী ও ভোটারদের মধ্যে উৎসাহের মাত্রাটা বেশি। শাহবাগ থেকে দক্ষিণের সড়ক ধরে ভাষাশহীদ আবুল বরকতের নামে বসানো অস্থায়ী তোরণ পার হতেই চোখে পড়ল বড় বড় ডিজিটাল ব্যানার। এসব ব্যানারে প্রার্থীর ছবির পাশাপাশি ভোটারদের প্রতি নানা প্রতিশ্রুতি আছে।

কলাভবন, কার্জন হল, বাণিজ্য অনুষদ, টিএসসি—প্রায় সবটা ক্যাম্পাস এখন ব্যানার ও পোস্টারে ছেয়ে গেছে। প্রত্যেক প্রার্থী কিংবা তাঁর অনুসারীরা কাতরকণ্ঠে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে ভোট প্রার্থনা করছেন। নির্বাচিত হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কে কতটা শিক্ষাবান্ধব ও নিরাপদ করবেন, সেসব অঙ্গীকার দিয়ে রেখেছেন সব প্রার্থী। এসব দেখে ছোটবেলায় পড়া ইকরামুদ্দিনের ‘ক্যান্ডিডেট’ রচনাটির কথা মনে পড়ল। গল্পের বিষয়বস্তু এ রকম: ভোটের জন্য প্রার্থী ভোটারের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। বাড়ির মালিক প্রথমে ভিক্ষুক ভেবে ভিক্ষার চাল সাধছেন। আগন্তুক বললেন, আমি ভিক্ষুক নই। তারপর বাড়িওয়ালা ভাবলেন, নিশ্চয়ই তিনি বুজুর্গ ব্যক্তি। তাঁর কাছে দোয়া চাইলেন। তখন আগন্তুক বললেন, আমি বুজুর্গ ব্যক্তি নই। একজন ক্যান্ডিডেট।

ডাকসু নির্বাচনেও এখন ভোটারদের বেশ কদর। নির্বাচনের পর সেই কদর আর থাকবে না। তখন নির্বাচিতরাই শাহেনশাহ বনে যাবেন।

আবাসিক হলগুলোর সামনে দাঁড়ালে মনে হয়, ব্যানারের প্রদর্শনী চলছে। তবে এর ৯০ শতাংশ সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠনটির। বিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলো আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে। ছাত্রলীগের পাল্টা অভিযোগ, বহিরাগতরা প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত কোনো অঘটন ঘটেনি। যেখানে জাতীয় নির্বাচনে বিরোধী দলের প্রার্থীদের অনেকে পালিয়ে ছিলেন, কর্মী-সমর্থকেরা ঘর থেকে বের হলেই গ্রেপ্তার হতেন, সেখানে ডাকসুতে সব ছাত্রসংগঠন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মোটামুটি প্রচার চালাতে পারছেন, এটিও আশার কথা। আলাপকালে একজন শিক্ষক বললেন, ‘গত ১০ বছরে ক্যাম্পাসে অস্বাভাবিক পরিবেশ দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়েছি। এখন স্বাভাবিক পরিবেশকেই অস্বাভাবিক লাগে। সামনের ৪৮ ঘণ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ ছাত্রদল বলেছে, ‘১০ বছর আমরা ক্যাম্পাসছাড়া। ছাত্রলীগের অনুকম্পায় এখন ক্যাম্পাসে আসতে পেরেছি।’ এই অনুকম্পা ও জবরদস্তির সংস্কৃতিটা বদল হওয়া দরকার।

একাডেমিক ভবনে নির্বাচনী প্রচার চালানো নিষেধ। কলাভবনে যখন ক্লাস চলছিল, তখনো মাইক বাজিয়ে একাধিক সংগঠন পরিচিত সভা করছিল। কলা অনুষদের একটি বিভাগের প্রধান অভিযোগের সুরে বললেন, যাঁরা ছাত্রদের নেতৃত্ব দেবেন, আইনের প্রতি তাঁদের শ্রদ্ধাশীল থাকা প্রয়োজন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ১৮টি আবাসিক হল আছে। ছাত্রদের ১৩টি, ছাত্রীদের ৫টি। ছাত্রলীগ ছাড়া কোনো সংগঠনই হলগুলোতে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল দিতে পারেনি। প্রথম আলোর খবর অনুযায়ী, হলের ২৪ শতাংশ পদে (মোট পদ ৫৬টি) কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেছে, সংখ্যাটি ৫৬ নয়, ৪১। তাতেও এক-পঞ্চমাংশ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে না। অর্থাৎ উপজেলা নির্বাচনের মতো তাঁরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবেন। এটিও স্বাভাবিক নয়।

বিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলোর অভিযোগ, ১০ বছর ধরে হলগুলো ছাত্রলীগের দখলে ছিল। সেখানে অন্য কোনো ছাত্রসংগঠনকে হলে যেতে দেওয়া হয়নি। প্রায় প্রতিটি হলে ছাত্রলীগ গণরুম সংস্কৃতি চালু করে সংগঠনের পক্ষে কাজ করতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বাধ্য করেছে। বিষয়টি কয়েকটি ছাত্রসংগঠনের নির্বাচনী অ্যাজেন্ডায়ও এসেছে। গণরুম সংস্কৃতি বাতিল করতে হবে। তবে ছাত্রীদের ৫টি হলের পরিবেশ তুলনামূলক ভালো। সেখানে জবরদস্তি অনেকটা কম।

প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে ছাত্রদলের অবস্থা খুবই নাজুক। ছাত্রীদের পাঁচটি হলের মধ্যে মাত্র একটিতে ভিপি পদে প্রার্থী দিয়েছে তারা। জগন্নাথ হলে কোনো প্রার্থীই দিতে পারেনি। প্রগতিশীল ছাত্র জোটও দু-তিনটি হলের বাইরে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল দিতে পারেনি। এ অবস্থায় হল সংসদের নির্বাচনী ফল অনেকটা অনুমান করা যায়। তবে শুরু থেকে নির্বাচনের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেছেন এ রকম একাধিক সাংবাদিক বলেছেন, ডাকসুর ফল ভিন্নও হতে পারে। তঁাদের মতে, ডাকসুতে ছাত্রলীগের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে মূলত কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী জোটের। কোনো পদে ছাত্রদল ও প্রগতিশীল ছাত্র জোট ও স্বাধিকার স্বতন্ত্র প্যানেলও প্রতিযোগিতায় আসতে পারে। তাঁদের মতে, ছাত্রী ভোট যেদিকে যাবে, ডাকসুতে তারাই জিতবে। আর এ ক্ষেত্রে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন। সে সময় তাঁরা ছাত্রীদের আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন আর ছাত্রলীগ প্রশাসনের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬ হাজার ছাত্রীর অর্ধেকই হলে থাকেন। অন্যদিকে ছাত্রদের বেশির ভাগ বাইরে থেকে পড়াশোনা করেন।

এবারের ডাকসু নির্বাচনে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা নানা দাবি ও প্রতিশ্রুতি নিয়ে মাঠে নেমেছেন। এর মধ্যে কতগুলো আছে অভিন্ন দাবি ও অঙ্গীকার, যেমন শিক্ষার্থীদের জন্য স্বাস্থ্যবিমা চালু, সব শিক্ষা কার্যক্রমে অটোমেশন, বর্ধিত হল ও বিভাগীয় ফি বাতিল, হলের খাবারের মানোন্নয়ন, পরিবহন সুবিধা বৃদ্ধি, নতুন হল নির্মাণ ও পুরোনো হল সংস্কার। এর বাইরে ছাত্রলীগ বলেছে, তারা ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করবে, যেমনটি ছিল গত ১০ বছর। সমালোচকেরা বলেছেন, গত ১০ বছর ক্যাম্পাসে শান্তি ছিল, তবে সেটি একটি ছাত্রসংগঠনের জন্য। ক্যাম্পাসকে সন্ত্রাসমুক্ত করার পাশাপাশি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দাবি সামনে এনেছে ছাত্রদল। প্রগতিশীল ছাত্র জোটের স্লোগান হলো, ‘দ্যাখো, আলো এবং অন্ধকার দুটি পক্ষ, দাঁড়াও, নিজেকে প্রশ্ন করো—কোন পক্ষে যাবে?’ স্বাধিকার স্বতন্ত্র পরিষদের দাবি, ‘৩০ ডিসেম্বরের মতো নির্বাচন চাই না। শিক্ষার্থীরা কারও গোলাম নয়।’ অন্যদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা ভিন্নমতের সহাবস্থানের ওপর জোর দিয়েছেন।

ডাকসু নিয়ে কলাভবনের শিক্ষক লাউঞ্জে কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা হয়। একজন বললেন, নির্বাচন হবে। তবে জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু হবে না। আমি পাল্টা প্রশ্ন করি, তার মানে কি এখানেও ভোটাররা ভোট দিতে পারবেন না? তিনি বললেন, না, ছাত্রছাত্রীরা ভোট দিতে পারবেন। সরকার যখন নিশ্চিত হয়েছে বেশির ভাগ ভোট সরকারি সংগঠনের পক্ষে যাবে, তখনই নির্বাচনের তফসিল হয়েছে। পাশ থেকে আরেকজন বললেন, জাতীয় নির্বাচনের মতো এখানে সবকিছু একতরফা না–ও হতে পারে। ডাকসুতে পদ ভাগাভাগি হবে। হলগুলোর ফল এক রকম হবে। ডাকসুর ফল আরেক রকম।

এই নির্বাচনে সরকারবিরোধী সংগঠন হিসেবে যারা পরিচিত, তারা বহুধাবিভক্ত। এক হতে পারেনি। এমনকি বামেরা আলাদা দুটি প্যানেল দিয়েছে। এই সুযোগটিই সরকারি ছাত্রসংগঠন নেবে, এটাই স্বাভাবিক বলে মন্তব্য করলেন নীল দলের সমর্থক একজন শিক্ষক।

নির্বাচনে যে প্রার্থী বা সংগঠন জয়ী হোক না কেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটিই চাওয়া—নির্বাচনটি ঠিকমতো হোক। ৩০ ডিসেম্বরের মতো নির্বাচন কারও কাম্য নয়। ছাত্রলীগ ছাড়া সব সংগঠনই ভোট গ্রহণের সময় বাড়ানোর দাবি করেছে। তাদের মতে, ভোটের সময় নির্ধারিত আছে সকাল আটটা থেকে বেলা দুইটা। এই সময়ের মধ্যে সীমিত সংখ্যক কেন্দ্রে এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর পক্ষে ভোট দেওয়া বা নেওয়া অসম্ভব। প্রশাসন এখনো সময় বাড়ায়নি। তবে তারা বিকল্প কিছু ভাবছে। সেই ভাবনাটা কি সুষ্ঠু ভোটের পক্ষে যাবে?

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]