প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচি বদলানো উচিত

প্রথম আলো ফাইল ছবি।
প্রথম আলো ফাইল ছবি।

অনেক দিন ধরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বেশির ভাগ শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক মনে করেন, দীর্ঘ সময় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর জন্য উপযোগী নয়। কারণ, দীর্ঘ সময় বিদ্যালয়ে থাকলে শিক্ষার্থীর খিদে পায়, শরীর দুর্বল হয়, পড়া মনে থাকে না। কর্তৃপক্ষ বলে, তাদের দুপুরের খাবার (মিড-ডে মিল) দেওয়া হোক। শিক্ষক বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনেক বিবাহিত নারী শিক্ষক আছেন, তাঁদের সন্তান আছে। তাঁদের পক্ষে সংসার সামলিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে বিদ্যালয়ে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে। কর্তৃপক্ষ তাঁদের বলে, যাঁরা পারেন না, তাঁদের চাকরি করার প্রয়োজন নেই। কিছু শিক্ষক মনে করেন, শিশুকে জ্ঞানীগুণী বানাতে হলে শিক্ষকদের কর্মঘণ্টা আরও বাড়ানো উচিত। কিছু কর্মকর্তা মনে করেন, ফাঁকিবাজ শিক্ষকদের দৌড়ের ওপর রাখা উচিত। তাই বিদ্যালয়ের সময় বাড়ানোর বিকল্প নেই।

বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রতিদিন ছয়টি আবশ্যকীয় বিষয় (বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়, প্রাথমিক বিজ্ঞান, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা) ছাড়াও সমাবেশ, কাব স্কাউট, শরীরচর্চা, সংগীত, চারুকারু শেখানো হয়। প্রতিদিন একটানা এসব বিষয় শিশুর জন্য বোঝাস্বরূপ। শরীরেও বোঝা বাড়ছে। কারণ, প্রতিটি শিশুকে ছয়টি বই, ছয়টি খাতা (ন্যূনতম ৪টি) পেনসিল বক্স, টিফিন বক্স, পানির বোতলসহ ভারী ব্যাগ পিঠে বয়ে নিতে হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো শিশু তার ওজনের ১০ ভাগের বেশি বস্তু বহন করলে তার হাঁটু, মেরুদণ্ড, ঘাড়, হৃৎপিণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দীর্ঘ সময় পেরিয়ে শিশু শিক্ষার্থীরা যখন ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীর-মন নিয়ে ঘরে ফেরে, সেখানেও ওদের দুদণ্ড বিশ্রাম নেই। কেউ কোচিং, কেউ একাডেমি, কেউ নাচের স্কুলে দৌড়ায়। সন্ধ্যাবেলা অথবা সন্ধ্যার পরে ঘরে এসে আবার পড়া।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, যেসব শিশু ছোটবেলায় বেশি চাপে থাকে, তারা বড় হয়ে বাস্তব পরিবেশ-পরিস্থিতির চাপ মানিয়ে নিতে সমস্যায় পড়ে। বিদ্যালয়ে বই–খাতার ভার আছে, শিক্ষকের শাসন আছে, কিন্তু খেলার মাঠ নেই। গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র পরিবারের শিশুরা মা-বাবাকে বিভিন্ন কাজে সাহায্য করে থাকে। যেমন: কৃষিকাজ, বাজার করা, রান্নার কাজ, কুটিরশিল্প তৈরি, দোকানের হিসাব রাখা ইত্যাদি। দীর্ঘ সময় বিদ্যালয়ে থাকতে হলে তারা তাদের পরিবারকে এই সহযোগিতাটুকু করতে পারবে না। গরমের দিনগুলো বড় হওয়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে দুপুরবেলায় ভ্যাপসা গরমে শিশুদের খুব কষ্ট হয়। আবার শীতের সময় দিন ছোট থাকায় শিশুদের ঠান্ডা লাগে। স্কুল শেষে বাড়ি যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়।

এবার শিক্ষকদের বিষয়ে কিছু বলি। শিক্ষকদের স্কুলে দীর্ঘ সময় কথা বলতে হয়। যদিও এখন শিখন শেখানো কার্যাবলি শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক, তারপরও মূল কাজ এবং নির্দেশনা শিক্ষকদেরই করতে হয়। ফলে বেশি কথাও বলতে হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বে কণ্ঠনালি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে থাকেন বেশির ভাগ শিক্ষক। মায়ের মতো মমতা ও স্নেহ দিয়ে শিশু শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদানে সহযোগিতা করেন নারী শিক্ষকেরা। দেখা যায় অন্য মায়েদের শিশুকে শিক্ষা দিতে গিয়ে শিক্ষক তাঁর নিজ সন্তানকে সময় দিতে পারেন না।

ফলে তারা বঞ্চিত হয় মা-বাবার কাছ থেকে খুব মূল্যবান সময়গুলো থেকে। এই বঞ্চনা শিশুদের মানসিক সমস্যার কারণ হয়। এর অনেক বাস্তব উদাহরণ আমাদের কাছে আছে। আমাদের দেশে যানজট এবং সড়ক দুর্ঘটনা একটি বড় সমস্যা। বিদ্যালয়ের সময় কমালে এ থেকেও কিছুটা নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে।

তাহলে কেমন সময়সূচি আমাদের শিশু শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের জন্য ভালো হবে? সকাল ১০টা থেকে বেলা ৩টা পর্যন্ত করা যায়। প্রাক্-প্রাথমিক শ্রেণি সকাল ১০টা থেকে ১১টা ৩০ মিনিট পর্যন্তই যথেষ্ট। যেসব বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৫০–এর নিচে, ওই বিদ্যালয়গুলো এক শিফট এবং ১৫০–এর বেশি হলে দুই শিফট করা যেতে পারে। পঞ্চম শ্রেণির ক্লাস সব বিদ্যালয়ে ১১টা থেকে শুরু করা যায়। প্রতিদিন তারা বাংলা, ইংরেজি ও গণিত পড়বে। অন্য বিষয়গুলো দুই দিন করে পড়বে। বিরতি ৩০ মিনিট যথেষ্ট। বৃহস্পতিবার হাফ স্কুলের দরকার নেই।

আন্তরিকতা, সততা ও আনন্দের সঙ্গে পাঠদান করলে এই সময়ের মধ্যেই প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের পাঠদানে সফল হওয়া সম্ভব। অন্যথায় সময় বাড়ালেও কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ করা দুষ্কর হয়ে পড়বে।

তাসনীম চৌধুরী: প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও প্রথম আলোর পাঠক