শিক্ষার অধিকার ও গণতন্ত্রের সম্পর্ক অবিচ্ছিন্ন

আগামীকাল ডাকসু নির্বাচন। ২৮ বছর পর এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অনেক কিছুই ঘটেছে গত কয়েক বছরে; অনশন, মামলা-হামলা, আদালত তো আছেই, আরও আছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিভিন্ন ধরনের আচরণ—সব ছাত্রসংগঠনের প্রায় সব দাবি অগ্রাহ্য করে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের কথাই শেষ বক্তব্যে পরিণত হয়েছে। সব সংগঠন এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা একাডেমিক ভবনে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের দাবি করেছিলেন, দাবি করেছিলেন যেন ভোটের সময় বাড়িয়ে দেওয়া হয়। এই সব দাবি উপেক্ষিত হয়েছে। কেননা, প্রশাসন যেনতেন প্রকারে নির্বাচন করতে উৎসাহী, তাতে প্রার্থী হিসেবে ছাত্রসংগঠনগুলো অংশ নিলেই হলো, নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে হলো কি না, সেটা বিবেচ্য নয় বলেই মনে হয়েছে। এ ধরনের আচরণ গত ৩০ ডিসেম্বরের জাতীয় ‘নির্বাচন’ এবং নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাকেই মনে করিয়ে দেয়।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এই সব আচরণের সঙ্গে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে নির্বাচনের দিন সংবাদ সংগ্রহে বিধিনিষেধ। বলা হয়েছে যে নির্বাচনের দিন গণমাধ্যমকর্মীরা অনুমতি ছাড়া কোনো ভোটকেন্দ্রে যেতে পারবেন না; রিটার্নিং কর্মকর্তার অনুমতি সাপেক্ষে তাঁরা কেবল ভোটকেন্দ্রের, অর্থাৎ হলের গেস্টরুম পর্যন্ত যেতে পারবেন। তবে আগে থেকে পরিচয়পত্র নেওয়া না থাকলে সেটাও তাঁরা পারবেন না। এই সব নিষেধাজ্ঞার মধ্যে আছে ভোটকেন্দ্র থেকে সরাসরি সম্প্রচারের নিষেধাজ্ঞা। দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতার উদাহরণ হিসেবে যেখানে ৩০টির বেশি টেলিভিশন চ্যানেল থাকার কথা গর্বের সঙ্গে প্রচার করা হয়, সেখানে প্রায় ৪৩ হাজার ভোটারের একটি নির্বাচন, যার কেন্দ্র হচ্ছে ১৮টি হল, সেখানে টেলিভিশন মাধ্যমের সর্বোচ্চ চারটি ইউনিট এবং প্রিন্ট মিডিয়ার দুজন সাংবাদিককে পরিচয়পত্র দেওয়া হবে বলে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তকে তথ্য নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ছাড়া আর কীভাবে ব্যাখ্যা করা যাতে পারে? ডিজিটাল বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভোটকেন্দ্রে মোবাইল ফোনসহ সব ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত যে কাউকেই বিস্মিত করবে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্ত কি নির্বাচনের সময়ের সম্ভাব্য কোনো ধরনের ‘অনিয়মের’ প্রমাণ না রাখার চিন্তা থেকে তৈরি হয়েছে?

নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই এ ধরনের বাধাবিঘ্ন সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উৎসাহ নিয়ে এই নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হয়েছেন; বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন ও স্বতন্ত্রভাবে শিক্ষার্থীরা তাতে প্রার্থী হয়েছেন। তার কারণ ২৮ বছরের ব্যবধানে নির্বাচন এবং এই প্রত্যাশা যে বিরাজনৈতিকীকরণের যে প্রক্রিয়ার মধ্যে দেশকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে, সেই বৃত্তচক্র থেকে বেরোনোর একটা পথের সন্ধান হয়তো পাওয়া যাবে। এই নির্বাচনে ইতিমধ্যেই অনেক কিছু ঘটেছে, যা অভূতপূর্ব। যেমন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়েছেন কমপক্ষে ৩৫ জন। অভিযোগ আছে, স্বতন্ত্র প্রার্থী হতে আগ্রহী বা মনোনয়ন জমা দেওয়ার পরে অনেককেই বাধ্য হয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের কর্মীদের ভয়ভীতির মুখে।

এই নির্বাচনে ভোটারদের ৬০ শতাংশ আবাসিক শিক্ষার্থী, বাকি ৪০ শতাংশ হচ্ছে অনাবাসিক। আবাসিক শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশকে ছাত্রাবাসে জায়গা পাওয়ার পূর্বশর্ত হিসেবেই একটি দলের আধিপত্য মেনে নিতে হয়েছে। এ অবস্থার সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে তথাকথিত গণরুমের বাসিন্দারা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলোতে ‘গণরুম’ বলে একটি অমানবিক, বেআইনি এবং যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অবমাননাকর ব্যবস্থা বহাল আছে, সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ জানে, সেখানে শিক্ষার্থীরা কীভাবে জীবন যাপন করেন, তা–ও জানে। বছর দুয়েক আগে একটি গণমাধ্যমে এগুলোকে সিরিয়ার শরণার্থী শিবিরের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ এসব না জানার যে ভান করে, তাকে বর্ণনা করার কোনো উপযুক্ত শব্দ আমি খুঁজে পাইনি। সেই অবস্থার ব্যাপারে কোনো রকম পদক্ষেপ না নিয়ে, সেই বিষয়ে কোনো রকম উচ্চবাচ্য না করেই যে নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হলো, তার ফলাফল কী হতে পারে—সেটা কি কর্তৃপক্ষ জানে না? সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, ১৮টি ছাত্রাবাসে যে ৮১টি গণরুম আছে, সেখানে থাকেন আড়াই হাজার শিক্ষার্থী, আরেক হিসাবে এই সংখ্যা সোয়া তিন হাজার।

এই শিক্ষার্থীদের সরকারি ছাত্রসংগঠনের হয়ে প্রচারে অংশ নিতে হয়েছে, অথচ প্রশাসন এ নিয়ে এক দীর্ঘ শীত নিদ্রায় থাকল। এই নির্বাচনে যদি এই শিক্ষার্থীরা যারা তাঁদের ‘আশ্রয়’ দিয়েছে, সেই সংগঠনের বিরুদ্ধেই ভোট দেন, তবে তাঁদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা কি কর্তৃপক্ষ দিতে পারবে, নাকি দিতে চাইবে? কর্তৃপক্ষ বিস্মৃত হলেও সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের বারান্দায় থাকা এবং প্রায় রাতে ছাত্রলীগের ‘গেস্টরুম’ কর্মসূচিতে যাওয়ার কারণে ঠান্ডায় আক্রান্ত হয়ে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে মৃত্যুবরণকারী হাফিজুর রহমানের কথা আমাদের মনে আছে। কেউ জেনেশুনে হাফিজুর রহমানের দুর্ভাগ্য বরণ করতে চাইবেন না।

গত ১০ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের যে কর্তৃত্ব বহাল রয়েছে, সেই অবস্থাকে না বদলে দিয়ে নির্বাচনের আগের কয়েক দিনের ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান’ স্বাভাবিকতার ইঙ্গিত দেয় না। অন্য সংগঠনের কথা বাদই দিলাম, সাধারণ শিক্ষার্থীরাও কী এই সহাবস্থানের ‘সুবিধা’ পেয়েছেন? তা মনে হয় না। ছাত্রদের কোনো হলেই যে কোনো স্বতন্ত্র প্যানেল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না, যখন ছাত্রীদের পাঁচটি হলের প্রতিটিতেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বতন্ত্র প্যানেল রয়েছে, তখন বোঝা যায় সহাবস্থান শব্দটার অর্থ সীমিত।

অনাবাসিক শিক্ষার্থীরা ভোট দেওয়ার জন্য আসবেন আশা করা যায়, কিন্তু পথে বা ভোটকেন্দ্রে তাঁদের নিরাপত্তার কী ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে করে তাঁরা কোনো ধরনের চাপের মুখে পড়বেন না? কর্তৃপক্ষ নিশ্চয় বলবে, প্রত্যেকের আলাদা নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যবস্থা তারা নিতে পারে না। সেই দায়িত্ব অংশত পালন করতে পারেন গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকেরা। তাঁরা সেটা করবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় হয়, কিন্তু তার পথও কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে দিয়েছে সংবাদ সংগ্রহে বাধানিষেধ জারি করে।

এই সব প্রতিকূলতা সত্ত্বেও ডাকসু নির্বাচনের গুরুত্বকে ছোট করা যাবে না। ডাকসু কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংসদ নয়। নিঃসন্দেহে শিক্ষার্থীরা চান যে তাঁদের প্রতিদিনের যেসব সমস্যা আছে, সেগুলো সমাধানের কাজে নিয়োজিত হবেন তাঁদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। ক্যাফেটেরিয়ার খাবারের মান থেকে শুরু করে লাইব্রেরির বইয়ের ব্যবস্থা করা। অবশ্যই ডাকসু এবং হল সংসদের দায়িত্ব হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়াজীবনে প্রাণসঞ্চার করা। কিন্তু ডাকসুর ইতিহাস ও তার অবস্থান ডাকসুর ওপরে, তার চেয়েও বড় দায়িত্ব অর্পণ করে তা হলো—শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নেতৃত্ব দেওয়া। সেই অধিকার দেশের রাজনীতির বাইরে নয়।

মনে রাখতে হবে, শিক্ষার অধিকারের সংগ্রাম এবং গণতন্ত্রের সম্পর্ক অবিচ্ছিন্ন, এর মধ্যে চীনের প্রাচীর তুলে দিয়ে আলাদা করা যাবে না। সম্ভবত এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হচ্ছে হলের গণরুমগুলো। এই মানবেতর ব্যবস্থা যেমন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতার কারণে টিকে আছে, তেমনি টিকে আছে জাতীয় রাজনীতি, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নিরঙ্কুশ আধিপত্যের কারণে। একটি বাদ দিয়ে আরেকটি মোকাবিলা করা যাবে বলে মনে করার কারণ নেই। এই দুইকে আলাদা করার চেষ্টা বিরাজনৈতিকীকরণের প্রক্রিয়ার বৃত্তচক্রকেই সাহায্য করবে, সেই চক্র থেকে বেরোনোর পথের সন্ধান করার যে সামান্য সুযোগ ডাকসু নির্বাচন তৈরি করেছে, তার বাস্তবায়নের সম্ভাবনা তিরোহিত হবে।

দেশে গোটা নির্বাচনব্যবস্থার ওপরে যখন আস্থা অবসিত হয়েছে, রাজনীতিকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে, সেই সময়ে ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভূমিকা যা হওয়া দরকার ছিল, তা হয়নি। সে কারণেই ডাকসু নির্বাচনে যাঁরা অংশ নিচ্ছেন সাংগঠনিকভাবে এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে, এই নির্বাচনে সব শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ এবং তাঁদের অধিকার কী করে রক্ষা করবেন, সে বিষয়ে প্রস্তুতি রাখা দরকার। এর অন্যথা হলে তাঁরা কী ভূমিকা নেবেন, সেই বিষয়টিও নির্বাচনের আগেই বিবেচনায় নেওয়া ও ঠিক করে রাখা উচিত।

আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর