বই পেলেও বর্ণ চেনে না তারা

রবীন্দ্রনাথ ‘সভাপতির অভিভাষণ’ প্রবন্ধে বলেছিলেন, ‘আমরা যেমন মাতৃক্রোড়ে জন্মেছি, তেমনি মাতৃভাষার ক্রোড়ে আমাদের জন্ম, এই উভয় জননীই আমাদের পক্ষে সজীব ও অপরিহার্য।’ এই ‘সজীব ও অপরিহার্য’ জননীরা যেমন সন্তানকে পরিচর্যা করে বড় করে তোলেন, তেমনি তাঁদেরও পরিচর্যা করা সন্তানের প্রধান কর্তব্য। মাকে বাঁচানোর মতো মাতৃভাষাকে বাঁচানোও তার প্রধান দায়িত্ব। আর যেকোনো ভাষার টেকসই অস্তিত্ব নিশ্চিত করার পূর্বশর্ত হলো তার লেখ্য রূপকে পোক্তভাবে প্রতিষ্ঠা করা।

খুব আনন্দের কথা হলো, আমাদের পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার স্থানীয় ভাষাগুলো বাঁচিয়ে রাখতে সরকার ইতিমধ্যে উদ্যোগ নিয়েছে। কয়েক দশক ধরে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলো যেসব দাবি তুলে আসছিল, সেগুলোর মধ্যে একটি ছিল তাদের মাতৃভাষার মাধ্যমে বিদ্যালয় স্তরে পড়াশোনা শেখার সুযোগ সৃষ্টি করা। সেই দাবি মেনে ২০১৭ সাল থেকে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা—এই তিন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর প্রাক্‌-প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষা শিক্ষার বই দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা হলো এসব বই পাওয়া শিশুর দশা হয়েছে সেই লোকটির মতো, যাকে কোনো প্রশিক্ষক না দিয়েই গাড়ি চালানো শিখতে বলা হয়েছে।

প্রথম আলোয় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, পার্বত্য এলাকায়, বিশেষ করে রাঙামাটিতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা ভাষার পাঠ্যবই দেওয়া হলেও গত তিন বছরে তাদের ভাষা শিক্ষার ফলাফল শূন্য। মাতৃভাষার স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ পড়তে শেখেনি তারা। তাদের মধ্যে অনেকেই এখনো নিজের নাম লিখতে ও পড়তে পারে না। মাতৃভাষার জ্ঞান না থাকায় অভিভাবকেরাও নিজের সন্তানকে এ বিষয়ে বাড়িতে পড়াতে পারছেন না। বিদ্যালয়ে পাঠদান হচ্ছে কি না, তা-ও খোঁজখবর নিতে পারছেন না। তিন বছর আগে রাঙামাটির প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এই কার্যক্রম শুরু হলেও দক্ষ শিক্ষক না থাকায় কর্মসূচি এগোচ্ছে না। মাতৃভাষা শিক্ষায় পরীক্ষা ছাড়াই শিক্ষার্থীরা এক শ্রেণি থেকে আরেক শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হচ্ছে। এ কারণে শিক্ষার্থীদের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। পাঠ্যবই দেওয়া হলেও শিক্ষক-সংকট, অনিয়মিত পাঠদান ও পাঠ্যসূচি না থাকায় শিক্ষার্থীদের ভাষাশিক্ষায় কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। পরীক্ষা ছাড়াই এক শ্রেণি থেকে আরেক শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাতৃভাষা শিক্ষায় আগ্রহ বাড়ছে না।

রাঙামাটি জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে দুই দফায় শিক্ষকদের ১৫ দিন করে মাতৃভাষার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাঁরাই এই শিশুদের পড়ানোর দায়িত্বে আছেন। কিন্তু এত স্বল্প সময়ের প্রশিক্ষণ যে যথেষ্ট নয়, তা বুঝতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয়। এ কারণে পাহাড়ি এলাকার সব শিক্ষককে দীর্ঘমেয়াদি বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার। শিক্ষকেরা প্রশিক্ষিত হলে তাঁরা শিশুদের মাতৃভাষায় লিখতে, পড়তে শেখাতে পারবেন। এই প্রশিক্ষণ দিতে আহামরি কোনো বরাদ্দ দিতে হবে তা-ও নয়। এর জন্য সরকারের সদিচ্ছাই যথেষ্ট।