প্রত্যাবাসনের চুক্তি কি ব্যর্থ হয়ে গেল?

মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির পরেও নানা অজুহাতে দেশটি রোহিঙ্গাদের ফেরতের ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে টালবাহানা করছে
মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির পরেও নানা অজুহাতে দেশটি রোহিঙ্গাদের ফেরতের ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে টালবাহানা করছে

সম্প্রতি রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশের তরফে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলোচনা সংবাদমাধ্যমে এসেছে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ঢাকায় এক বিতর্ক অনুষ্ঠানের অতিথি হিসেবে যা বলেছেন, তার সারকথা হলো, মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির পরও নানা অজুহাতে দেশটি রোহিঙ্গাদের ফেরতের ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে টালবাহানা করছে। সম্প্রতি একই কথা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে জানিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব। বলেছেন, বাংলাদেশ এ নিয়ে হতাশ ও ক্ষুব্ধ। প্রায় একই সময়ে সংবাদমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, নিরাপত্তা পরিষদের কার্যকর চাপ ছাড়া মিয়ানমারকে বাগে আনা যাবে না।

বাংলাদেশের এই অবস্থান প্রশ্ন তুলে দিয়েছে, আমরা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে যে চুক্তি করেছিলাম, তাহলে কি সেটি ব্যর্থ হয়ে গেল? মিয়ানমারের
সঙ্গে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যখন ‘দ্বিপক্ষীয়’ চুক্তিটি করেছিল, তখন এই শঙ্কাই ছিল যে চুক্তিটি আসলে বাস্তবায়ন করা যাবে কি না। রোহিঙ্গা
ইস্যুর মতো একটি স্পর্শকাতর ও আঞ্চলিক নিরাপত্তাজনিত বিষয়কে কী কারণে আমরা দ্বিপক্ষীয় চুক্তি দিয়ে সমাধান করতে গিয়েছিলাম, তার
সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা আমাদের জানা তাই এখন আরও জরুরি হয়ে পড়েছে।

১৯৭৮ সালে প্রথম যখন জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে দলে দলে রোহিঙ্গারা সীমান্ত পেরিয়ে এসেছিল, তখন বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর হাতে জিম্মি। সেই সময় রোহিঙ্গাদের মুসলিম পরিচয় সামনে এনে তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার সব আয়োজন সম্পন্ন করেছিল বিএনপি। ১৯৯০-৯১ সালে আবারও দলে দলে রোহিঙ্গারা আসে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সব সময় রোহিঙ্গা প্রশ্নে আমাদের দেশের মৌলবাদী রাজনৈতিক শক্তিগুলো তাদের ধর্মীয় পরিচয় সামনে এনে মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। দলে দলে তারা এসেছে, আমাদের কক্সবাজার এলাকায় থাকছে।

মহাজোট সরকার নিরাপত্তাজনিত কারণ ও সন্ত্রাসবাদবিরোধী ভাবনা থেকেই রোহিঙ্গা সংকটকে চিরতরে নির্মূলের জন্য উদ্যোগী হয়। এর ফলে মিয়ানমারের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকের পর ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করে, শরণার্থী শিবিরে বসবাস করা রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। ২০১১ সালের ১৬ অক্টোবর মিয়ানমারের নতুন সরকার নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে স্বীকৃতি জানায়। কিন্তু আমরা দেখলাম, ২০১২ সালে আবার রাখাইন রাজ্যে দাঙ্গা শুরু হলো। আন্তর্জাতিকভাবেই এটি এখন জাতিগত নিধন হিসেবে স্বীকৃত। তার মানে স্পষ্টত মিয়ানমার সরকার এই কাজ উদ্দেশ্যমূলকভাবেই করে।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্য বলছে, ২০১৭ সালের আগস্টে মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে ২৭ হাজার রোহিঙ্গা রাখাইনে জাতিগত নিধনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। মাত্র এক মাসের মধ্যেই সেই সংখ্যা ৫ লাখ ছাড়িয়ে যায়। বাংলাদেশ শুধু মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দেয় এবং তা বিশ্বে প্রশংসিতও হয়। কিন্তু এর জন্য যে নিরাপত্তাঝুঁকি তৈরি হতে পারে, সে ব্যাপারে খোদ প্রধানমন্ত্রীও সচেতন ছিলেন। এর প্রমাণ, রোহিঙ্গা সংকট শুরুর এক মাসের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভাষণে সংকট সমাধানের জন্য সুনির্দিষ্ট সুপারিশ তুলে ধরেন। তাঁর প্রথম সুপারিশে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের বৈষম্যমূলক আইন, নীতি ও চর্চার বিলোপ চান। তাঁর দ্বিতীয় সুপারিশ, মিয়ানমারকে অবশ্যই বিশ্বাস তৈরি, সুরক্ষা ও অধিকারের নিশ্চয়তা এবং সব রোহিঙ্গার জন্য নাগরিকত্বের পথ সৃষ্টির মাধ্যমে সহায়ক পরিবেশ গঠন করতে হবে। সব বেসামরিক লোকজনকে রক্ষায় যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে মিয়ানমারের ভেতর ‘সেফ জোন’ তৈরি করতে হবে। তৃতীয় সুপারিশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশেষ করে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং মিশনের সুপারিশগুলোর আলোকে জবাবদিহি ও বিচারের ব্যবস্থা করে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংস অপরাধ রোধ করতে হবে। তাঁর এই সুপারিশ স্পষ্টতই মিয়ানমার ইস্যুতে বাংলাদেশের ভাবনাকে পুরোপুরি তুলে ধরে। বিশেষ করে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশলটি কাজ করতে শুরু করেছিল বলেই মনে হচ্ছিল।

কিন্তু এই সময়ের মধ্যেই একটা বড় ছন্দপতন ঘটে। অনেকটা তড়িঘড়ি করে ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা-ঢল শুরুর তিন মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে প্রত্যাবাসন–সংক্রান্ত দ্বিপক্ষীয় চুক্তি করে বসে। গোলমালটা বাধে সেখানেই। দ্বিপক্ষীয় সেই চুক্তিতে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরে আসা সাত-আট লাখ রোহিঙ্গার বিষয়টি একমাত্র বিবেচনাযোগ্য। তার আগে নানা সময়ে বাংলাদেশে আসা তিন-চার লাখ রোহিঙ্গার রাখাইনে ফিরে যাওয়া আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। আবার সেখানেও যুক্ত করা হয়, রোহিঙ্গারা যদি স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে চায়, তাহলেই প্রত্যাবাসন করা হবে। কার্যত এই চুক্তির সব সুবিধা মিয়ানমারের পক্ষে গেছে। অথচ এটি এমন একটি সময় ছিল, যখন প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিকভাবে এই ইস্যুতে মিয়ানমারের ওপর একটি কার্যকর চাপ তৈরির বাস্তবতা সৃষ্টি হয়েছিল।

সমস্যার শুরু থেকেই মিয়ানমার সব সময় অভিযোগের আঙুল বাংলাদেশের দিকে তুলেছে। রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত—এ কথা বলে আন্তর্জাতিক সমাজের মনোযোগ কাড়তে চেষ্টা করেছে। মিয়ানমার বরাবর রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিষয়ে সব অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে। এমনকি আন্তর্জাতিক আদালত, ফ্যাক্ট-ফাইন্ডিং কমিটির অভিযোগ, জাতিসংঘের অভিযোগ, মানবাধিকার কমিশন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, তুরস্ক এবং বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে, অস্বীকার করেছে। দায় চাপিয়েছে ‘আরসা’ নামের এক সংগঠনের ওপর। কিন্তু যখন আমাদের কাছে ছবি, তথ্য, প্রমাণ এমনকি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর উচ্চকিত প্রতিবেদন মিয়ানমারকে চাপে ফেলল, তখন আমরা ভুল পথে পা বাড়ালাম। এমনকি সেই চুক্তি নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যার পথেও যায়নি।

গলদ থাকল রোহিঙ্গাদের নাম নিবন্ধন প্রক্রিয়ায়ও। প্রথম দফায় জাতিসংঘের ইউএনএইচসিআরকে সংযুক্ত না করে এই কাজ শুরু করা হয়। দ্বিতীয় দফায় তাদের সঙ্গে নিয়েও মিয়ানমারের আপত্তিতে নতুন করে আবার আঙুলের ছাপসহ আরও কিছু তথ্য একত্র করে নিবন্ধন তালিকা করা হয়। তাহলে প্রথমেই কেন সংশ্লিষ্ট এই দুই পক্ষকে অঙ্গীভূত করা হয়নি? আট হাজারের মতো ফিরে যেতে ইচ্ছুক রোহিঙ্গা নাগরিকের তালিকা মিয়ানমারকে প্রথমে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মাত্র পাঁচ হাজারের মতো লোককে ফেরত নিতে সম্মত হয় তারা। বাকি লোকদের কোন যুক্তিতে মিয়ানমার গ্রহণ করতে রাজি নয়, সেই প্রশ্নটি কেন আমরা জোরেশোরে করতে পারলাম না? দীর্ঘ সময়ের পুরোনো এই সমস্যা সমাধানে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কেন অনুধাবন করতে ব্যর্থ হলো? এ তো অনভিজ্ঞতার সমস্যা নয়। তাহলে এর পেছনে কী কারণ ছিল? আমরা কাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছিলাম, সেই প্রশ্নের সমাধান আজ জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভুলে গেলে চলবে না, বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় দুই দেশের সম্পর্কের অন্যতম ভিত্তি হয়ে উঠেছে অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা। মিয়ানমারের সঙ্গে সেই সম্পর্ক বিনির্মাণের সুযোগ আমরা হারিয়েছি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অদূরদর্শী সিদ্ধান্তে। ২০০১ সালের পর ভারতের কাছে গ্যাস রপ্তানির জন্য মিয়ানমার বাংলাদেশকে সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছিল। বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ হয়ে পাইপলাইনে ভারতে গ্যাস পাঠাবে মিয়ানমার। সেই গ্যাস বাংলাদেশও ব্যবহার করতে পারবে বলে আশ্বস্ত করেছিল দেশটি। ভারতও এই প্রস্তাবে পুরোপুরি সম্মত ছিল। কিন্তু তৎকালীন সরকার এই সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তি রচনা করতে ব্যর্থ হয়। যার ফলে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের হাতে এ মুহূর্তে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট কার্যকর কোনো উপকরণ নেই।

এমন একটি পরিস্থিতিতে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। তারও আগে সেই দ্বিপক্ষীয় চুক্তির ব্যর্থতা খতিয়ে দেখতে হবে। নিজেদের সমস্যার সমাধানকে প্রাধান্য দিয়ে নতুন করে কূটনৈতিক উদ্যোগ এগিয়ে নিতে হবে। আমাদের প্রতিবেশীসহ বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রগুলোকে কার্যকরভাবে বোঝাতে হবে যে আজকের এই রোহিঙ্গা সংকট যদি আমরা স্থায়ীভাবে সমাধান করতে না পারি, তাহলে এর যে নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি, তা ভূরাজনৈতিকভাবে পুরো অঞ্চলকেই প্রভাবিত করবে ভবিষ্যতে।

ফজলে হোসেন বাদশা: বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও সাংসদ