দুর্গম এলাকা ঘোষণা, কিন্তু কার স্বার্থে?

প্রথম আলো ফাইল ছবি।
প্রথম আলো ফাইল ছবি।

সম্প্রতি দেশের হাওর-দ্বীপ-চরের ১৬ উপজেলাকে দুর্গম বিবেচনা করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, যোগাযোগব্যবস্থা, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বিবেচনা করে পার্বত্য এলাকাবহির্ভূত হাওর, দ্বীপ, চর অঞ্চলের ১৬টি উপজেলাকে দুর্গম এলাকা হিসেবে গণ্য করা হবে। উপজেলাগুলো হলো কিশোরগঞ্জের ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম; চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ, কক্সবাজারের কুতুবদিয়া, নোয়াখালীর হাতিয়া, সিরাজগঞ্জের চৌহালী, কুড়িগ্রামের রৌমারী ও রাজীবপুর; পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী, ভোলার মনপুরা। এ ছাড়া সুনামগঞ্জের ধরমপাশা, শাল্লা ও দোয়ারা বাজার এবং হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ ও নেত্রকোনার খালিয়াজুড়ী হাওর-দ্বীপ-চর উপজেলার মধ্যে পড়েছে।

এটা কোনো নতুন ঘোষণা নয়। কয়েক বছর পরপর দুর্গম এলাকার তালিকা হালনাগাদ করা হয়। দুর্গম এলাকা সম্পর্কিত ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৩-এর প্রজ্ঞাপনে ১৩টি জেলার মোট ২২টি উপজেলাকে দুর্গম তালিকাভুক্ত করা হলেও এবারের প্রজ্ঞাপনে (মার্চ ২০১৯) খুলনার কয়রা, কুমিল্লার মেঘনা, নেত্রকোনার দুর্গাপুর, কক্সবাজারের মহেশখালী, সুনামগঞ্জের তাহিরপুর আর বিশ্বম্ভরপুরকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। নিশ্চয় বিবেচকদের চোখে এসব এলাকার যোগাযোগব্যবস্থা, শিক্ষা, চিকিৎসা, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধায় যথেষ্ট পরিমাণে দৃশ্যমান উন্নতি হয়েছে।

কেন এই তালিকা?

প্রান্তিক আর দুর্গম এলাকার বঞ্চিত মানুষকে বিশেষ কোনো সুবিধা দেওয়ার জন্য এই তালিকা নয়। বাংলাদেশের আর পাঁচটা এলাকার মানুষ যে হারে খাজনা, ট্যাক্স, ভ্যাট দেয়, তাদেরও তা-ই দিতে হয়। চাল-ডাল-তেল-নুনের দামে তাদের কোনো রেয়াত দেওয়া হয় না। তবে তাদের যাঁরা শাসন করতে যাবেন, তাঁরা কিছু বাড়তি সুবিধা পাবেন। এসব উপজেলায় সরকারি কর্মকর্তাদের বদলি, পদায়নের ক্ষেত্রে কিছু বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়। যাতায়াত ভাতা, দৈনিক ভাতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সুবিধা পান। তিন বছর নয়, দুই বছরের মাথায় তাঁরা বদলির বায়না ধরতে পারবেন। তাঁদের এই তোয়াজের দরকার আছে। কারণ, দুর্গম এলাকায় কেউ যেতে চান না। সবাই থাকতে চান ঢাকায় কিংবা ঢাকার কাছাকাছি। গ্যাস, রানিং ওয়াটার, ইংলিশ স্কুলের ছায়ার মধ্যে থাকার নিরন্তর চেষ্টা সরকারি-বেসরকারি সব কর্মকর্তার একমাত্র আরাধনা। বদলি ঠেকানো আর করানোর জন্য একদল প্রফেশনাল তৈরি আছে বদলি-বাণিজ্যের কর্ণধার হিসেবে। এসব বাণিজ্যের সঙ্গে লিপ্ত ব্যক্তিদের দর্শনীর পরিমাণ সম্পর্কে একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন চিকিৎসক প্রাণ গোপাল দত্ত। ২০১৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারির এক সভায় তিনি তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের উপস্থিতিতে বলেছিলেন, ‘একজন চিকিৎসক দুই বছর গ্রামে কাজ করার পর তাঁকে আবার ভালো জায়গায় পদায়নের জন্য মাসের পর মাস ধরনা দিতে হয়। এ কাজে তাঁর বেতনের সব টাকাও খরচ হয়ে যাচ্ছে।’ বলা বাহুল্য, মন্ত্রী তাঁকে চ্যালেঞ্জ করেননি। তবে তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন, যদি একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গ্রামে থাকতে পারেন, কৃষি অফিসার থাকতে পারেন, তাহলে একজন চিকিৎসক থাকতে পারবেন না কেন? তিনি বলেছিলেন, দুর্গম অঞ্চলে যেসব চিকিৎসক স্বাস্থ্যসেবা দেবেন, তাঁদের জন্য সরকার বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করবে।

সম্প্রতি ঘোষিত দুর্গম উপজেলাগুলোর মধ্যে চারটি উপজেলার তথ্য তালাশ করে দেখা গেছে, ওই সব উপজেলায় বদলির আদেশ পাওয়ার সঙ্গে সেখানে না যাওয়ার, গেলেও না থাকার, থাকলেও যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ‘সুন্দর জায়গায়’ ফেরত আসার যে গোল্লাছুট চলে, তাতে আর যা-ই হোক প্রান্তিক এলাকায় বসবাসকারী মানুষের সেবা মেলে না। কুতুবদিয়ায় ৩৫ বছরে প্রায় ৩৭ জন ইউএনও গেছেন আর এসেছেন। ‘প্রায়’ শব্দটি লেখার কারণ হচ্ছে, তাঁদের সবাই পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে কাজ করার সুযোগ পাননি। ৩৫ জনের মধ্যে প্রায় তিন হালি, অর্থাৎ ১২ জন ছিলেন অতিরিক্ত দায়িত্বে অথবা ভারপ্রাপ্ত।

ঢাকার সঙ্গে আসা-যাওয়ার যোগাযোগের সুযোগ-সুবিধা অপেক্ষাকৃত সহজ ও সাশ্রয়ী হওয়ার পরও অন্য দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার অবস্থা কুতুবদিয়ার মতোই। সেখানেও গড়ে ৩৫ বছরে একনাগাড়ে এক বছরের বেশি থাকা ইউএনওর সংখ্যা সাত-আটজনের বেশি হবে না। কেউ যেতে রাজি না হওয়ায় অথবা ‘উপযুক্ত ব্যক্তি’ খুঁজে না পাওয়ায় সেখানেও ৩০ জন নির্বাহী কর্মকর্তার মধ্যে ৯-১০ জন ছিলেন ভারপ্রাপ্ত।

ভোলা জেলার মনপুরা উপজেলার ক্ষেত্রেও কোনো ব্যতিক্রম দেখা যায় না। ৩৫ বছরে আট-নয়জন ভারপ্রাপ্ত বা অতিরিক্ত দায়িত্বের নির্বাহী কর্মকর্তাসহ ৩৬ জন নির্বাহী কর্মকর্তাকে মনপুরায় পদায়ন ও বদলি করতে হয়েছে সরকারকে। এঁদের মধ্যে এক মাসের কম সময় থাকা কর্মকর্তাও আছেন। দ্বীপ নয় কিন্তু উপকূলের উপজেলা বরগুনার পাথরঘাটা একই অসুখে ভুগছে।

কিন্তু কেন থাকেন না? রাখার উপায় কি নেই?

একজন তরুণ চিকিৎসক প্রান্তিক উপজেলাগুলোর প্রতি আকর্ষণ বোধ না করার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছিলেন, ‘পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি ছাড়া ডাক্তারদের প্রমোশন হয় না। আবার একটি পোস্টগ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জনের জন্য কমপক্ষে তিন বছরের ট্রেনিং লাগে, প্রধানত সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোথাও থেকে নেওয়া প্রশিক্ষণকে এ ক্ষেত্রে আমলে নেওয়া হয় না। তার মানে আপনি আমাদের উপজেলায় পাঁচ বছর বসিয়ে রাখবেন, এরপর ঘুষ দিয়ে (টাকা দিয়ে) মেডিকেল কলেজে আসব, পরে আরও তিন বছর ট্রেনিং করব, তার এক বছর পর পোস্টগ্র্যাজুয়েশন ভর্তির পরীক্ষা দেব, ভর্তি হতে পারলে গড়ে তিন বছর লেগে যায় পাস করতে। এরপর আমি একটা প্রমোশনের হকদার হব। দয়া করে প্রণোদনার কথা বলে লোক হাসাবেন না। সরকার যদি শুধু উপজেলা বা গ্রামের চাকরির সময়টাকে প্রশিক্ষণ হিসেবে কাউন্ট করে, তাহলে আমাদের গ্রামে বা প্রান্তিক এলাকায় কাজ করতে কোনো আপত্তি থাকবে না।’

নতুন হিসেবে দুর্গম এলাকার সংখ্যা ১৬ হলেও বিএমএর মতে, বাংলাদেশে ৪৮৫টি উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সের মধ্যে ১১৩টি দুর্গম এলাকায় অবস্থিত। এই বিতর্কের একটা মীমাংসার সঙ্গে সঙ্গে মনে রাখতে হবে, কিছু থোক টাকা বিলিয়ে দুর্গম এলাকায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের খুশি মনে যাওয়া, থাকা আর কাজ করার পরিবেশ তৈরি করা যাবে না। দুর্গম বা দূরবর্তী এলাকার পোস্টিংকে শাস্তি নয়; বরং পুরস্কারস্বরূপ গ্রহণের মতো পদ্ধতি গড়ে তুলতে হবে। ক্যারিয়ারের ও পরবর্তী পদোন্নতির জন্য পড়াশোনা আর ডিগ্রি অর্জনের অগ্রাধিকার দেওয়ার ব্যবস্থা রাখলে মানুষ এসব জায়গায় বদলির আদেশের জন্য অপেক্ষা করবেন। যদি তাঁরা নিশ্চিত হন যে কুতুবদিয়ায় বা মনপুরায় তিন বছর মন দিয়ে কাজ করার পর তিনি তাঁদের পছন্দের প্রতিষ্ঠানে গিয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশোনার নিশ্চিত সুযোগ পাবেন এবং তাঁদের পদোন্নতির অপেক্ষাধীন তালিকায় তিন-চার ধাপ ওপরে উঠিয়ে দেওয়া হবে, তাহলে সমস্যার সমাধান হতে পারে।

গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক