একজন সাধারণ যাত্রীর উদ্বেগ

বিভিন্ন কাজে বিদেশে যেতে হয় আমাকে। ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দর ব্যবহার করতে হয়। অভ্যন্তরীণ ভ্রমণে ব্যবহার করতে হয় অন্য বিমানবন্দরগুলোও। বিমানবন্দর নিয়ে অন্য অনেকের মতো আমারও নানা ধরনের অভিজ্ঞতা আছে। দুটি অভিজ্ঞতার কথা বলি আগে।

ঘটনা এক:

২০১৬ সালে মিয়ানমার যাচ্ছি বেড়াতে। ইয়াঙ্গুন এয়ারপোর্টে আমার স্ত্রীকে থামিয়ে দেয় হ্যান্ড লাগেজ চেক করার জায়গায়। তাদের স্ক্যান মেশিনে কিছু একটা ধরা পড়েছে। তারা বলে, ‘তোমার হ্যান্ডব্যাগে একটা ধারালো জিনিস রয়েছে?’ আমার স্ত্রী অবাক, ‘না তো!’ সিকিউরিটির লোকজন নিশ্চিত, হ্যান্ডব্যাগে আছে সেটা। তাঁদের নির্দেশে আমার স্ত্রী ব্যাগ আঁতিপাঁতি করে খুঁজে পায় ব্রাউন পেপারে মোড়ানো কাগজ কাটা যন্ত্রের ব্লেড। সে কয়েক দিন আগে কিনেছিল তা নিউমার্কেট থেকে। ভুলে আর ব্যাগ থেকে সরায়নি। সে কিছুটা অপ্রস্তুত। কিন্তু তার চেয়ে বেশি অবাক। আমাকে প্রশ্ন করে, ঢাকা এয়ারপোর্টে তো মেশিনের ভেতর দিয়েই গেল ব্যাগ, তাহলে ধরা পড়ল না কেন সেখানে?

ঘটনা দুই:

কয়েক বছর আগের কথা। সিলেট থেকে ফিরব ঢাকায়। বিমানবন্দরের ভেতরে ঢোকার লাইনে দাঁড়াতেই আমাকে চিনে যান নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা। তিনি আমার টক শোর মহাভক্ত। পারলে মাথায় করে আমাকে ভিআইপি লাউঞ্জে নিয়ে যান। কিন্তু তার আগে আমার শরীর পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন। হাতে সেই যন্ত্রটা নিয়ে বিব্রত হাসি দেন তাঁর একজন কর্মচারী। দূর থেকে আমার শরীরের সমান্তরালে তা একটু আন্দোলিত করে তিনি বলেন, ‘স্যার যান!’

ওপরের দুটি ঘটনা নেতিবাচক। ইতিবাচক অনেক ঘটনাও ঘটে বিমানবন্দরে। বেশ কয়েকবার আমার শরীর বা হ্যান্ডব্যাগ তল্লাশি করে তাঁরা ভুলে রাখা ম্যাচ বা লাইটার খুঁজে পেয়েছেন, আমি লজ্জিত হয়েছি। অনেক দিনই শরীর তল্লাশি করা বা স্ক্যান মেশিনে তীক্ষ্ণ নজর থাকা কর্মচারীদের দেখে খুব পেশাদার মনে হয়েছে।

কিন্তু এসব গুণগান গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বিচ্যুতিগুলো। আমার গাড়ির চালক প্রতিদিন ঠিকমতো গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যান বিভিন্ন জায়গায়। এটি কোনো সংবাদ হতে পারে না। কারণ, এর জন্য তিনি বেতন নেন, এটিই তাঁর দায়িত্ব। কিন্তু তিনি যদি একবারও গাড়ি তুলে দেন কারও ওপর, শুধু সেটাই গুরুত্বপূর্ণ হবে, সংবাদ হবে। ঠিক একইভাবে বিমানবন্দরে এক দিনও যদি নিরাপত্তার ঘাটতি হয়, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ, নিরাপদ অন্য শত দিন নয়। কারণ, এর সঙ্গে জড়িত বহু মানুষের জীবনের প্রশ্ন, আরও অনেক গুণ বেশি মানুষের নিরাপত্তাবোধ, দেশের সম্মান ও অর্থনীতি।

এসব কথা আমাদের বলতে হচ্ছে দেশের প্রধান বিমানবন্দরে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা দেখে। মাত্র গত দুই সপ্তাহে উদ্বেগজনক তিনটি ঘটনা ঘটেছে সেখানে। বিমানবন্দরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা মানুষজন তা ধামাচাপা দেওয়ার বা লঘু করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাতে উদ্বেগ আরও বাড়ছে অনেকের।

দুই.

প্রথম ঘটনাটি বহুল আলোচিত বাংলাদেশ বিমানের একটি উড়োজাহাজ ছিনতাইচেষ্টার। এই ঘটনার সম্ভবত সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য বর্ণনা দিয়েছেন একটি বেসরকারি ব্যাংকের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত ম্যানেজিং ডিরেক্টর কাজী মশিউর রহমান (ডেইলি স্টার, ২৮ ফেব্রুয়ারি)। হাত বাড়ালে ছোঁয়া যায় এমন দূরত্ব
থেকে তিনি দেখেছেন ছিনতাইকারীর সব কর্মকাণ্ড। তাঁর বিবরণে এটি স্পষ্ট যে ছিনতাইকারী বিমানের ভেতর একটি হ্যান্ডগান বা পিস্তল, লাইটার ও বিস্ফোরকের মতো দেখতে কিছু নিয়ে ঢুকেছিল। সেই পিস্তল দিয়ে সে গুলি ছুড়েছিল, সেই গুলি উড়োজাহাজের টয়লেটের দরজা ভেদ করেছিল এবং গানপাউডারের গন্ধ কেবিনে ছড়িয়ে পড়েছিল। এবং সে লাইটার জ্বালিয়ে বিমানে বিস্ফোরণ ঘটানোর ভাবভঙ্গি করেছিল।

বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনা সম্পর্কে নানা পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছে সরকারের বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ। তাদের কেউ কেউ পিস্তলকে বর্ণনা করেছে খেলনা পিস্তল হিসেবে। কিন্তু খেলনা পিস্তলের গুলি কীভাবে টয়লেটের দরজা ভেদ করল, সে ব্যাখ্যা কেউ দেয়নি। খেলনা পিস্তলের গুলি প্লাস্টিকের তৈরি হয়, আসল গুলির মতো এর অগ্রভাগে লোহা বা স্টিলের কোটিং থাকে না। আর সেটি যদি খেলনা পিস্তলও হয়, একদম পিস্তলের মতো দেখা যায় এমন খেলনা পিস্তল আর লাইটার নিয়ে সে বিমানের ভেতর ঢুকতে পারল কীভাবে?

এই ঘটনার পর নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পুরোধা ইলিয়াস কাঞ্চন ভুলে নিজের লাইসেন্স করা পিস্তলসহ ঢুকে গেছেন শাহজালালের অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দরের প্রথম নিরাপত্তা স্তর পার হয়ে। ব্যাগ স্ক্যানারে ও নিরাপত্তা তল্লাশিতে ধরা পড়েনি এটা। ৮ মার্চ মামুন আলী নামে আরেক যাত্রী এভাবে আগ্নেয়াস্ত্রসহ ঢুকেছেন, অভ্যন্তরীণ টার্মিনালের প্রথম গেটের আর্চওয়েতে তাঁর শরীর পরীক্ষা করে বিষয়টি ধরতে পারেননি আনসার সদস্য। দুজনই বলেছেন, তাঁরা নিজেরাই পরে আগ্নেয়াস্ত্র জমা দিয়েছেন।

বিমানবন্দর এভিয়েশন সিকিউরিটির পরিচালক ক্ষিপ্ত হয়ে ইলিয়াস কাঞ্চনকে মিথ্যাবাদী বলেছেন, আরও ক্ষিপ্ত হয়ে মামুন আলীকে দেশের ভাবমূর্তি নষ্টকারী বলেছেন। কিন্তু এটি তিনিও অস্বীকার করতে পারেননি যে প্রথম স্ক্যান মেশিন ও তল্লাশি ধরতে পারেনি তাঁদের পিস্তল।

প্রথম স্তরের মতো সমস্যা রয়েছে দ্বিতীয় স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থাতেও। এর প্রমাণ আমরা পেয়েছি ছিনতাইকারীর আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের বিমানের ভেতর ঢুকে যাওয়ার ঘটনায়।

তিন.

আমরা এসব ঘটনার খবর পড়ে উদ্বিগ্ন হই। বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থার দুর্বলতার বিষয়ে নিজেদের দুটি অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়েছি এই
লেখার শুরুতে। নিকটজনদের মুখেও এমন অভিজ্ঞতার বিবরণ শুনেছি। ফলে বিশ্বাস করি কাজী মশিউর আর ইলিয়াস কাঞ্চনদের বিবরণ সঠিক। দেশের বিমানবন্দরগুলোতে নিরাপত্তাব্যবস্থায় গুরুতর সমস্যা আছে।

আমি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ নই। নিজের সাধারণ বিবেচনাবোধ থেকে মনে হচ্ছে, সমস্যাটা দুই জায়গায় হতে পারে। এক, মেশিনে। দুই, মেশিন চালানো মানুষে। আমাদের দেশে সরকারি খরচে নিম্নমানের জিনিস কেনা এবং নষ্ট হলে তা পুরো মেরামত না করেই কাজ চালানোর বহু সংবাদ আমরা পাই। দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত এই দেশে স্ক্যান মেশিন, আর্চওয়েসহ নিরাপত্তাসামগ্রীর ক্ষেত্রে এমন হচ্ছে না, এর নিশ্চয়তা কোথায়?

অন্যদিকে, এ দেশে সরকারি নিয়োগে স্বজনপ্রীতি, অঞ্চলপ্রীতি ও দুর্নীতি এতই ব্যাপক যে বিমানবন্দরে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োগপ্রাপ্তদের ক্ষেত্রেও তা অবশ্য সম্ভব। হয়তো এমন নিয়োগ কিছু হলেও হয়েছে, হয়তো তাঁদের ঠিকমতো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। হয়তো প্রশিক্ষণের পরও তদারকি বা জবাবদিহির অভাবে তাঁরা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেন না। স্ক্যান মেশিনে দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় পাশের মানুষের সঙ্গে কথা বলতে বা নিজের
মোবাইল স্ক্রিনে কাউকে কাউকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি আমি নিজে। কমই ঘটে এসব, কিন্তু ১০০ জনের মধ্যে পাঁচজন এমন হলে বা পাঁচবার এমন ব্যত্যয় হলে সেটাই ভয়াবহ হতে পারে। হয়তো তা–ই হচ্ছে বিমানবন্দরে।

বিমানবন্দরে এ ধরনের ব্যত্যয়ের জন্য আমরা নিম্নপদের কর্মচারীদের মাঝেমধ্যে বরখাস্ত হতে দেখি। আশ্চর্য লাগে আমার। এত বড় ঘটনায় উন্নত বিচারবুদ্ধির কোনো দেশে মন্ত্রী পদত্যাগ করে ফেলেন। আর এ দেশে এসব ভয়াবহ ঘটনার পর বিমানবন্দরে খোদ নিরাপত্তাপ্রধানের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিকে কোনো দায় নিতে হলো না!

এমন ঢিলেঢালা জবাবদিহি থাকলে আমরা স্বস্তি পাব কীভাবে? আমাদের না হয় নানা ধরনের ভয়ভীতি দেখিয়ে চুপ করানো যাবে। কিন্তু বিদেশিদের? নিরাপত্তা ঘাটতির অভিযোগ তুলে অস্ট্রেলিয়া ২০১৫ সালে ও যুক্তরাজ্য ২০১৬ সালে বাংলাদেশ থেকে সরাসরি কার্গো পরিবহনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। তারপরও আমাদের শিক্ষা হয়েছে কি? শিক্ষা নেওয়ার কোনো দায় কারও আছে কি, এই অদ্ভুত দেশে?

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক