২০১১-১২ সালের কোনো এক সময়; চট্টগ্রাম যেতে হবে ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সের (ইউআইটিএস) সিন্ডিকেট সভায়, যার আমি সরকার মনোনীত প্রতিনিধি। যাহোক, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা পিএইচপি গ্রুপের চেয়ারম্যান সুফি মিজানুর রহমানের সঙ্গে আগে কোনো দিন দেখা হয়নি। করপোরেট ভবনে তাঁর অফিসে প্রথম দেখা। টেবিলের দুপাশে রাখা বইয়ের স্তূপের মধ্যে নাতিদীর্ঘ মানুষটিকে বেশ ছোটই লাগছিল। প্রথম দর্শনেই সহাস্যে হাত বাড়িয়ে বুকে টেনে নিলেন। আমি বেশ অবাক, একজন মানুষকে আগে কখনো দেখিনি, তাঁকে কীভাবে আমি এত দ্রুত একেবারেই বুকে জড়িয়ে ধরব! তারপর যতই তাঁর সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হলো, ততই তাঁর আন্তরিকতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠল। কোনো কিছুতেই কৃত্রিমতা নেই। একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র উদ্বোধনের পালা; সবাই জড়ো হচ্ছি। আমি মনে মনে ভাবছি এমন বিনয়ী মাটির মানুষ নিশ্চয়ই নিজে উদ্বোধন না করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণ অধ্যাপককে দিয়েই কাজটি করাবেন। তিনি একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে মা বলে সম্বোধন করে কাছে ডাকলেন এবং তাঁকে দিয়ে উদ্বোধন করালেন। আমি নির্বাক! সিন্ডিকেট সভায় তিনি সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণীতে সভার সিদ্ধান্তের গুরুত্বের কথা বললেন। তবে বিনয়ের সঙ্গে এ কথাও জানালেন যে এ দেশের ছেলেমেয়েরা তুলনামূলকভাবে যাতে কম খরচে পড়তে পারে, এ জন্যই এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তাই ছাত্রদের বেতন বৃদ্ধি করতে হলে অবশ্যই যেন তাঁর মতামত নেওয়া হয়। বাংলাদেশে যেখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা অন্য যেকোনো ব্যবসার থেকে কম লোভনীয় নয়, যার দরুন যারা জীবনেও পড়ালেখার ধারেকাছে নেই তারাও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন পাওয়ার জন্য এত তৎপর, সেখানে ছাত্রদের বেতন বৃদ্ধির আপত্তি!
উপরন্তু শুনেছি, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য এখনো পিএইচপি গ্রুপকে অনুদান দিতে হয়। সে ক্ষেত্রে বেতন বৃদ্ধিতে অনীহায় অবশ্যই তাঁর শিক্ষানুরাগেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। সদালাপী, নিরহংকার মানুষটি সুবক্তাও বটেন; তা–ও আবার বিভিন্ন ভাষায়। বাংলা, ইংরেজি কিংবা ফারসি—সমান দক্ষতায় সাবলীলভাবে দীর্ঘক্ষণ মানবতার বাণী শোনাতে পারেন। যখন কথাগুলো উচ্চারণ করেন, তখন মনে হয় কোনো কৃত্রিমতা নেই। তাঁর ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষিত। নাতি-নাতনিদেরও ভালো মানুষ হওয়ার প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। আমাদের সামনে নিয়ে এলেন এবং তারা অনেক নীতিকথা প্রাণ দিয়ে উচ্চারণ করল। রাতে গজলের আসর বসল। যাঁরা গাইলেন, তাঁদের যোগ্য সম্মানী দিলেন। এভাবে বাংলাদেশে গজলের সংস্কৃতিকে উৎসাহিত করছেন সুফি মিজানুর রহমান।
অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াড কমিটির মাধ্যমে আমরা ছেলেমেয়েদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াডে অংশ গ্রহণের জন্য পাঠাই। সুফি ভাই অর্থায়নের সমস্যা অনুধাবন করে বেশ কয়েক বছর তার অর্থায়ন করেন। মুক্তহস্তে দান করেন। সবাইকে জানাতে ভোলেন না যে তিনি ১০০ টাকা মাসিক বেতনে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন এবং সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মও গ্রহণ করেননি। তাঁর জীবনের ইতিহাস সাধারণ মানুষ থেকে অসাধারণ হয়ে ওঠার ইতিহাস, যা সবাইকে উদ্বুদ্ধ করবে। ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রদূতকে বিদায় সম্ভাষণ জানাতে গুলশানে একটি হোটেলে বড় আয়োজন করেছেন। সেখানে বিদায়ী রাষ্ট্রদূত এবং সম্ভবত মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রদূত তাঁকে রীতিমতো পিতা বলে সম্বোধন করলেন। একটি দেশের এটা যে কত বড় প্রাপ্তি, একজন মানুষ অন্য দেশের একাধিক রাষ্ট্রদূতের কাছ থেকে সম্মান পেয়েছেন। সেই সম্মানটি আমাদের দেশের। তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে নিয়ে আসেন লব্ধপ্রতিষ্ঠ অনন্য সব ব্যক্তিত্বকে।
একবার নিয়ে এলেন ভারতের রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্বুদ্ধ করার এ রকম প্রচেষ্টার কোনো জুড়ি নেই। ২০১৪ সালের এমন একটা সময়ে আধুনিক মালয়েশিয়ার স্থপতি মাহাথির মোহাম্মদকে নিয়ে এলেন, যখন বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যথেষ্ট অবনতি হয়েছিল, সর্বত্র ছিল অনিশ্চয়তা। কিন্তু নিশ্চয়ই সুফি মিজানুর রহমানের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব হয়নি প্রায় ৯০ বছর বয়সী এই নেতার। সুফি সাহেবের বক্তব্য এতই হৃদয়গ্রাহী, শক্তিশালী। ওই সময়ে মাহাথির মোহাম্মদের আগমন নিশ্চয়ই আমাদের দেশের ভাবমূর্তিতে একটি বড় অবদান রেখেছে। ২০টির বেশি কোম্পানিসমৃদ্ধ গ্রুপের নাম দিয়েছেন পিএইচপি-শান্তি, সুখ-সমৃদ্ধির ইংরেজি শব্দের আদ্যক্ষর দিয়ে। তাঁর কোনো এক কোম্পানির একজন কর্মকর্তা দৃষ্টিশক্তি হারালেন। তাঁকে অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে, তাঁর চলাচলকে নির্বিঘ্ন করে চাকরিতে বহাল রেখেছেন।
আজ ১২ মার্চ তাঁর ৭৬তম জন্মদিন। জন্মদিনে আমি তাঁকে অভিনন্দন জানাই। কামনা করি, তিনি আরও অনেক বছর শান্তি, সুখ ও সমৃদ্ধির আদর্শে দেশের মানুষকে উজ্জীবিত করে আমাদের দেশ গড়ায় বড় অবদান রাখবেন।
মোহাম্মদ কায়কোবাদ: বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক ও ফেলো, বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্সেস