'প্রহসনের নির্বাচনেই' জিতল ছাত্রলীগ!

ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ক্ষোভের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ছবি: দীপু মালাকার
ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের ক্ষোভের মুখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ছবি: দীপু মালাকার

গতকাল সোমবার বেলা তিনটায় ভিপি প্রার্থী ও কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নুর যখন জানতে পারেন, রোকেয়া হলে ব্যালট বাক্স–কেলেঙ্কারি ঘটেছে, তখন সেখানে ছুটে যান। তখন তিনি সুস্থ মানুষ। কিন্তু কিছুক্ষণ পর সতীর্থরা তাঁকে হল থেকে নিয়ে এলেন পাঁজাকোলা করে। ব্যালট বাক্স কেলেঙ্কারি ধরেছিলেন রোকেয়া হলের ছাত্রীরাই। হলে ব্যালটভর্তি নয়টি বাক্স আনা হলেও তিনটি লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। এ নিয়ে ঘটে হুলুস্থুল কাণ্ড।

সাধারণ ছাত্রীরা ওই তিনটি ব্যালট বাক্স ভেঙে লুকিয়ে রাখা ব্যালট বের করে আনলে ছাত্রলীগের সমর্থকেরা ক্ষুব্ধ হয়ে নুরুল হকের ওপর চড়াও হয়। এতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে সতীর্থরা তাঁকে ধরে বাইরে নিয়ে আসেন এবং চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করান। রাতে টক শোতে সাবেক এক ছাত্রনেতা জোরগলায় বললেন, তাঁকে কেউ মারেনি। কেউ না মারলে নুরুল হক কি এমনি এমনি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন?

গতকাল দিবাগত রাত সোয়া তিনটায় ডাকসুর ফলাফল ঘোষণা করা হলে দেখা যায়, ভিপি পদে নুরুল হক বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছেন। ২৫টি পদের মধ্যে জিএসসহ ২৩টি পেয়েছে ছাত্রলীগ। আর ভিপিসহ দুটি পেয়েছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। ডাকসুর নির্বাচিত ভিপি নুরুল হক এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কেউ তাঁকে দেখতে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। ফলাফল ঘোষণার আগেই ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে উল্লাস প্রকাশ করছিল এবং বিরোধীদের এই বলে ভর্ৎসনা করেছিল যে সাধারণ ছাত্ররা তাদের প্রত্যাখ্যানের লজ্জায় নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন।

কিন্তু রাতে যখন উপাচার্য ভিপি পদে নুরুল হককে নির্বাচিত ঘোষণা করলেন, তখন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ‘ভুয়া’ ‘ভুয়া’ বলে চিৎকার দিতে থাকেন। তাঁরা উপাচার্যকে এক ঘণ্টারও বেশি সময় অবরোধ করে রাখেন।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন নুরুল হককে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, নির্বাচন বর্জনের ডাক দেওয়ার পরও তিনি ভিপি পদে নির্বাচিত হয়েছেন। এখন সেই পদ গ্রহণ করবেন কি না? জবাবে তিনি বলেছেন, তাঁর প্যানেলের অন্যান্য নেতার সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবেন। আমরা মনে করি, এত অঘটনের পরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা যে রায় দিয়েছেন, তার প্রতি সম্মান জানানো উচিত। নির্বাচনটি সুষ্ঠু হলে হয়তো নুরুল হক, এক নন, তাঁর ও স্বতন্ত্র প্যানেলের অনেক প্রার্থী জয়ী হতেন।

এই নির্বাচনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেসব আচরণ করেছে, তা অত্যন্ত লজ্জাজনক। ছাত্রলীগ বাদে প্রায় সব প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রসংগঠন নির্বাচন পিছয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছিল। প্রশাসন আমলে নেয়নি। তারা হলের বাইরে ভোটগ্রহণের দাবি করেছিল। প্রশাসন কর্ণপাত করেনি। তারা ভোট গ্রহণের সময় সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা করার দাবি জানিয়েছিল। প্রশাসন পূর্বনির্ধারিত আটটা-দুইটাই বহাল রাখে।

এরপর ভোটারের দিন সকালেই দেখা গেলে বাংলাদেশ–কুয়েত মৈত্রী হলে ব্যালট–কেলেঙ্কারি। বাক্স খুললে পাওয়া যায় সিল মারা ব্যালট পেপার। এরপর রোকেয়া হল ও কবি সুফিয়া কামাল হলেও একই ‘অনিয়ম’ ধরা পড়ে। আগেই খবর বের হয়েছিল, যে সংগঠন মেয়েদের ভোট বেশি পাবে, তারাই ডাকসুতে জয়ী হবে। কোটা আন্দোলনের সময় মেয়েরা বেশি সোচ্চার ছিলেন। ছাত্রলীগের হাতে অনেক ছাত্রী সে সময় নিগৃহীত হয়েছিলেন। ফলে, মেয়েদের হলের ভোট নিয়ে ছাত্রলীগের মধ্যে শঙ্কা ছিল। অন্যদিকে, ছেলেদের হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও অনেক শিক্ষার্থী ভোট দিতে পারেননি। এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো জবাব দিতে পারেনি।

উপাচার্য আখতারুজ্জামান বলেছেন, নির্বাচন উৎসবমুখর পরিবেশে হয়েছে। কুয়েত মৈত্রী হলে অনিয়ম ধরা পড়ার পর তাঁরা প্রাধ্যক্ষকে সরিয়ে দিয়েছেন। তবে প্রধান নির্বাচন কর্মকর্তা অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান স্বীকার করেছেন, নির্বচনে যে অনিয়ম হয়েছে, তাতে তিনি বিব্রত। রোকেয়া হল ও কবি সুফিয়া কামাল হলের ঘটনায় সেখানকার প্রশাসনের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি, বরং রোকেয়া হলের প্রাধ্যক্ষ ভিপি প্রার্থী নুরুল হকসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধ মামলা করেছেন। ফল ঘোষণার পর সেই ছাত্রলীগই তাদের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে। একেই বলে ‘যার জন্য করি চুরি, সেই বলে চোর’। আজ মঙ্গলবার সকালে ছাত্রলীগের কর্মী ও সমর্থকেরা ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিচ্ছেন, ‘প্রহসনের নির্বাচন মানি না, মানব না’। তাঁরা নুরুল হকের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছিলেন।

ডাকসুর নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক (জিএস) গোলাম রাব্বানীর ভাষ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ধর্মভিত্তিক দল বা শিবিরের রাজনীতি থেকে মুক্ত। নুরুল হক জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। কিন্তু নুরুল হক যখন ভিপি প্রার্থী হলেন, তখন ছাত্রলীগের কেউ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনেননি। তাঁরা বলেননি, ‘নুরুল হক প্রার্থী হলে আমরা নির্বাচন করব না।’ এখন ছাত্রদের ভোটে নুরুল হক বিজয়ী হওয়ার পর কেন এই প্রশ্ন? তাহলে কি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন একটি প্রহসনের নির্বাচন করল? আর প্রহসনের নির্বাচনেই জিতল ছাত্রলীগ!

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]