নতুন ইউরোপীয় রেনেসাঁর ডাক

রয়টার্স ফাইল ছবি।
রয়টার্স ফাইল ছবি।

সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে ইউরোপীয় রেনেসাঁর সৃষ্টি হয়েছিল। চতুর্দশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী—৪০০ বছর ধরে ইউরোপের মানুষ মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে প্রবেশ করেছিল। সেই সময় কলা, সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞান, সংগীত প্রভৃতির নবজাগরণ ঘটেছিল; তবে ইউরোপীয় রেনেসাঁর মূল বক্তব্য ছিল মানবিকতা।

আজ আবার তিন শতাব্দী পর ইউরোপে নতুন রেনেসাঁর ডাক শোনা যাচ্ছে। কারণ, আজ ইউরোপে মানবিকতা বিপন্ন।

প্রায় ৭০ বছর আগে ইউরোপের ২৮টি দেশ মিলে সাম্য ও সৌহার্দ্যের যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গড়ে উঠেছিল, সেখানে এখন তিক্ততা ও ভেদাভেদ। ব্রিটিশদের ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ বা ব্রেক্সিট, ইউরোপজুড়ে উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রভাব বৃদ্ধি, বর্ণবাদী তৎপরতা, দীর্ঘদিনের বন্ধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অসহযোগিতা ইত্যাদি নানা কারণে ইউরোপীয় ইউনিয়নে সাম্য, সৌহার্দ্য ও মানবিকতার সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। আগামী ২৩ থেকে ২৬ মে আসন্ন ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচন সামনে রেখে অতি জাতীয়তাবাদীদের উত্থান রুখতে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ নতুন ইউরোপীয় রেনেসাঁর
ডাক দিয়েছেন।

৫ মার্চ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ২৮টি পত্রপত্রিকায় এমানুয়েল মাখোঁর একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। সে লেখায় তিনি আবেগপূর্ণ ভাষায় আবারও ইউরোপীয় রেনেসাঁ বা ইউরোপীয় পুনর্জাগরণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন; ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্তমান পরিস্থিতি নতুন করে মূল্যায়ন ও সংস্কারের বিষয়ে এ বছরেই সম্মেলনের প্রস্তাব করেছেন। তিনি ইউরোপীয় জনগণকে তাদের সম্প্রীতি-সহযোগিতার ঐতিহ্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে মন্তব্য করেছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপ এতটা সংকটের মুখোমুখি হয়নি, এতে ইউরোপীয় রেনেসাঁর মূল আদর্শই হুমকির মুখে পড়েছে। তিনি ইউরোপের জনসাধারণকে সতর্ক করে দিয়ে লিখেছেন, ইউরোপের অতি জাতীয়তাবাদী দলগুলো শরণার্থী, অভিবাসন, কর্মসংস্থান প্রভৃতি বিষয় নিয়ে অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক করছে এবং বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। এই কৌশলে তারা সাধারণ মানুষের সমর্থন পাওয়ার চেষ্টা করছে।

ব্রেক্সিট প্রক্রিয়া চুক্তিবিহীন অবস্থায় শেষ হবে, সময় বাড়বে, তা নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি। এ বিষয়ে জার্মান প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্ক ভাল্টার স্টাইনমায়ার বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন ইউরোপের দ্বিতীয় প্রজন্মের মানুষের কাছে এক দেশ এক মহাদেশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, তখন যুক্তরাজ্যের এই বেরিয়ে যাওয়া দুঃখজনক। ব্রেক্সিটের ঘটনা ইউরোপের ডানপন্থী রক্ষণশীলদের হাতকেই শুধু শক্তিশালী করবে।

ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার নীতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ৭০ বছর ধরেই অব্যাহত ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক লেনদেন ও বাণিজ্যের শর্তাবলি পরিবর্তন, ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি, বৈশ্বিক জলবায়ু চুক্তি থেকে সরে যাওয়া, ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি অস্বীকার প্রভৃতি নিয়ে মতভেদ শুরু হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ক্ষয়িষ্ণু জোট ও সময়ের বিবর্তনে তা ভেঙে পড়বে বলে মন্তব্য করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিরাগভাজন হয়েছেন। ফ্রান্সের হলুদ জ্যাকেট আন্দোলন আপাতদৃষ্টিতে শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন মনে হলেও এর পেছনে রয়েছে ফ্রান্সের অতি জাতীয়তাবাদী কট্টর ডানপন্থী ন্যাশনাল ফ্রন্টের নেত্রী লো পেনের সমর্থক ও নৈরাজ্যবাদীরা। ইউরোপীয় ঐক্যের বিরোধী, কট্টর জাতীয়তাবাদী বা নব্য নাৎসিপন্থী দলগুলো কোথাও কোথাও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, তারা শক্তি বৃদ্ধির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

অর্থনৈতিক সংকট হলেই যে উগ্র লোকরঞ্জনবাদের প্রাদুর্ভাব হবে, এ ধারণা বদলে গেছে। অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ম্ভর দেশগুলোতেও এর প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। এখনকার ইউরোপের জাতীয়তাবাদী নেতারা জনপ্রিয়তা পাচ্ছেন সাংস্কৃতিক বৈসাদৃশ্য, জাতিসত্তা, অভিবাসী, সন্ত্রাসবাদ ও ইসলাম ধর্মের ধুয়া তুলে। তবে এর সঙ্গে লোকরঞ্জনবাদের প্রবক্তারা দেশভেদে স্থানীয় ইস্যুগুলোও যুক্ত করছেন। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈশ্বিক বিষয়টি উড়িয়ে দিয়ে প্রগতিবিরোধী এই দলগুলোর দেশ চালানোর অযোগ্য হয়েও জনগণের সংকীর্ণ আবেগ উসকে দেওয়ার চেষ্টা করছে।

ইউরোপের এই উগ্র জাতীয়তাবাদী দলগুলোকে রুখতে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনের আগে এমানুয়েল মাখোঁ ইউরোপের নাগরিকদের কাছে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিজের ভাবনা তুলে ধরেছেন। তিনি ইউরোপীয় রীতিনীতি নিয়ে নাগরিক সংলাপ জরুরি বলে মনে করছেন। ইউরোপের সঠিক পথে চলার ক্ষেত্রে সংলাপ হতে হবে জাতীয়, আঞ্চলিক ও স্থানীয় বিষয়গুলো নিয়ে। তিনি ইউরোপে নতুন করে পুনর্জাগরণের জন্য সবাইকে সঙ্গে নিয়ে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে যাওয়ার তাগিদ দিয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন শান্তি, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরও জাতীয়তাবাদী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীরা নানা রকম হুমকি দিচ্ছে, যা ইউরোপ মহাদেশের শান্তি, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তারা এই মহাদেশের ঐতিহ্য ও সভ্যতাকে অতীত অন্ধকার যুগের দিকে নিয়ে যেতে সচেষ্ট।

এমানুয়েল মাখোঁ ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি আরও আস্থা স্থাপন এবং সম্প্রীতি-সহযোগিতা বাড়াতে আগ্রহ-উদ্দীপনা সৃষ্টির জন্য সবাইকে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি আরও লিখেছেন, ইউরোপ শুধু একটি বাজার নয়, ইউরোপের মানুষের মানবাধিকার, শ্রমিক অধিকার ও পরিবেশ সংরক্ষণের সর্বজনীন স্বার্থে নতুন করে যাত্রার সময় এসেছে। তিনি ইউরোপীয় গণতন্ত্র সুরক্ষা এজেন্সি গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন।

আশার বিষয়, ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টুস্ক, জার্মানির সামাজিক গণতান্ত্রিক দলের নেতা মার্টিন শুলৎজসহ অনেক ইউরোপীয় নেতা ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর নতুন ইউরোপীয় রেনেসাঁর আহ্বানকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। ইউরোপের অনেক মানুষ এখনো উগ্রপন্থীদের তৎপরতার প্রতিবাদ জানাচ্ছে; কখনো কখনো রাস্তায়ও নামছে।

সরাফ আহমেদ: প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি
[email protected]