প্রশ্নবিদ্ধ ডাকসু নির্বাচন

২৮ বছর পর ডাকসু নির্বাচন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৩ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে যে আশা-উদ্দীপনা জেগেছিল, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের একগুঁয়েমির কারণে সেটি পূরণ হতে পারেনি। দেশবাসী আরেকটি প্রশ্নবিদ্ধ, পক্ষপাতমূলক ও অনিয়মে দীর্ণ নির্বাচন প্রত্যক্ষ করল। এ জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহি করতে হবে।

ডাকসু নির্বাচন নিয়ে শুরু থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আচরণ ছিল একপেশে, পক্ষপাতমূলক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সন্দেহজনক। যেকোনো নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অবাধ করার পূর্বশর্ত হলো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা সবার জন্য মাঠ সমতল করা। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠনটির সব দাবি রক্ষা করলেও প্রতিদ্বন্দ্বী অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের দাবি বরাবরই উপেক্ষা করেছে। বিরোধী ছাত্রসংগঠনগুলো হলের বাইরে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের দাবি করেছিল এই কারণে যে সেখানে ছাত্রলীগের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকায় হল প্রশাসনকে তারা প্রভাবিত করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেটি আমলে নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি। রাতে হলে ব্যালট পেপার না পাঠানো এবং ভোট গ্রহণের সময় বাড়ানোর দাবিও তারা করেছিল। সেসব দাবিও উপেক্ষিত হয়েছে। কর্তৃপক্ষের এ সিদ্ধান্ত যে সঠিক ছিল না, ভোটের দিনে ভোটারদের দীর্ঘ লাইন বা হল থেকে ‘সিল মারা’ ব্যালট পেপার উদ্ধার তারই প্রমাণ। অনেক শিক্ষার্থী দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করেও ভোট দিতে পারেননি বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে।  

কর্তৃপক্ষের পক্ষপাতমূলক আচরণ সত্ত্বেও সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেশবাসী আশা করেছিল, তারা হয়তো ভোট গ্রহণ পর্বটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করবে। এ আশাবাদের কারণ হলো ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাই। তাঁদের হাতেই শিক্ষার্থীদের ভোটের আমানত। ফলে জাতীয় নির্বাচনে যেসব অনিয়ম ও অঘটন ঘটেছে, তার পুনরাবৃত্তি এখানে ঘটবে না।

কিন্তু আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করলাম, কয়েকটি হলের প্রাধ্যক্ষ ব্যালট বাক্স ও ব্যালট পেপার কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়লেন। সোমবার ভোট গ্রহণের আগে বাংলাদেশ–কুয়েত মৈত্রী হলে ছাত্রীদের দাবির মুখে ব্যালট বাক্স খোলা হলে ‘সিল মারা’ একগাদা ব্যালট পেপার পাওয়া যায়। হাতেনাতে এ অনিয়ম ধরা পড়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হলের প্রাধ্যক্ষকে সরিয়ে এবং কয়েক ঘণ্টার জন্য ভোট গ্রহণ স্থগিত রেখে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে। প্রায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে রোকেয়া হলে। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরের উপস্থিতিতে লুকিয়ে রাখা তিনটি বাক্সে সিল না মারা শত শত ব্যালট পেপার উদ্ধার করা হয়। এ পরিস্থিতিতে ছাত্রলীগ ছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বী সব ছাত্রসংগঠন নির্বাচন বর্জনের ডাক দেয় এবং মঙ্গলবার ধর্মঘট পালন করে।

অন্যদিকে সরকার সমর্থক ছাত্রসংগঠনটি ডাকসু ও হল সংসদের অধিকাংশ পদে জয়ী হওয়ার পরও ডাকসুর ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনের নেতা নুরুল হককে মেনে না নিয়ে ভিপি পদে পুনর্নির্বাচনের দাবিতে শুধু বিক্ষোভ নয়, বিজয়ী ভিপির ওপর হামলাও করেছে। আমরা এই ন্যক্কারজনক হামলা ও সন্ত্রাসী ঘটনার নিন্দা জানাই।

দেরিতে হলেও দুই প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনের পক্ষ থেকে বিজয়ী ডাকসুর ভিপি ও জিএসের একযোগে কাজ করা এবং ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ঘোষণা এসেছে। আমরা তাকে স্বাগত জানাই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে দাবি থাকবে, অবিলম্বে ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে তারা সব ধরনের পদক্ষেপ নেবে। একই সঙ্গে নির্বাচনী অনিয়ম ও কেলেঙ্কারির সব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।