নারী শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন হোক

আমাদের সব সময় একটা ভয়, ট্রেড ইউনিয়ন মানেই রাস্তা অবরোধ, ভাঙচুর—এই সব! কিন্তু শ্রমিক যদি ন্যায্য মজুরি পান, তাঁর অধিকার যদি নিশ্চিত হয়, তাহলে এই সব ঝামেলা থাকে না। এখন প্রশ্ন হলো, এই ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা কীভাবে নিশ্চিত করা যাবে।

যেমন ধরা যাক দেশের একটি সম্ভাবনাময় শিল্প খাত, পোশাকশিল্পের নারী শ্রমিকদের পরিস্থিতি। তাঁরা কেমন আছেন? এককথায় বলতে হয়, খুব ভালো নেই। সেটা যে শুধু বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা, প্রতিনিয়ত হুমকি-ধমকি, ছাঁটাইয়ের ভয়—এসব কারণেই নয়। এই দুর্ভোগ তো নিত্যদিনের। তার চেয়েও বড় সমস্যা হলো, ঘরে-বাইরে শারীরিক নির্যাতনের হুমকি।

এ তো গেল এক দিক। কিন্তু আরেকটি সমস্যার দিক হচ্ছে তাঁদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সমস্যা। আইন আছে। বিধিমালা আরও কঠোর। এসব মেনে চললে নারী কর্মীদের সমস্যা অনেক কমে যাওয়ার কথা। যেসব কারখানা একটু উন্নত ও কমপ্লায়েন্ট, অর্থাৎ নিয়মকানুন মেনে চলে, সেখানে সমস্যা কম। কিন্তু সমস্যা হলো ছোট কারখানাগুলো নিয়ে। ওরা নিয়মকানুনের ধার ধারে না। অথচ প্রচলিত সাধারণ শ্রম আইনেও অনেক সুবিধা নারী কর্মীদের পাওয়ার কথা। সেখানে বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে।

৭ মার্চ প্রথম আলো ও নেদারল্যান্ডসের উন্নয়ন সংস্থা এসএনভি আয়োজিত গোলটেবিল বৈঠকে এই বিষয়গুলো আলোচিত হয়। আন্তর্জাতিক নারী দিবস সামনে রেখে এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করা হয়। আলোচনায় অনেক বিষয় গুরুত্ব পায়। যেমন একটি সমস্যা দেখুন। একজন নারী কর্মী মাসিকের সময় প্রতি মাসে তিন-চার দিন পুরোদমে কাজ করতে পারেন না। এ সময় তাঁদের দরকার স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি ন্যাপকিন। কখনো হয়তো চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়। কিন্তু কারখানার কঠোর নিয়মকানুন অনেক ক্ষেত্রে এই সুযোগ দেয় না।

শ্রমিক ও বিশেষভাবে নারী কর্মীদের জন্য কারখানাতেই চিকিৎসক থাকার কথা। কিন্তু কয়টা কারখানা এই নিয়ম মেনে চলে? আবার বাইরের হাসপাতালে যাওয়ার জন্য যে কয়েক ঘণ্টা ছুটি দরকার, সেটাও অনেক কারখানা দেয় না। সন্ধ্যায় কাজের পর হাসপাতালে সেবা পাওয়া যায় না। বেসরকারি ক্লিনিকে যেতে হয়। সেখানে অনেক টাকা লাগে। এসব সমস্যা সমাধানের উপায় বের করা এবং শ্রম আইন ও নীতিমালার বাস্তবায়ন বিষয়ে এসএনভি কাজ করছে। একা সরকারের পক্ষে সবকিছু করা সম্ভব নয়, সেটা ওরাও বলছে। সে জন্য দরকার বেসরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা। মালিকপক্ষের ভূমিকা তো মূল হিসাবে থাকবেই। বিজিএমইএ সেই দায়িত্ব পালন করছে। সেই সঙ্গে দরকার শ্রমিকদেরও সহযোগিতা। এই চার পক্ষ মিলে কাজ করলে অনেক সমস্যার সমাধান সম্ভব। কারণ, এখানে সচেতনতার অভাবও একটা বড় সমস্যা। তাই সবার সঙ্গে সব সময় মতবিনিময়ের একটি স্থায়ী প্ল্যাটফর্ম থাকা দরকার।

এসএনভি শ্রমিকদের স্বাস্থ্যবিমার ব্যবস্থা করার উদ্যোগ নিয়েছে। দুটি বেসরকারি বিমা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছে। কারখানার শ্রমিক সামান্য কিছু দেবেন। মালিকপক্ষও কিস্তির টাকা দেবে। কোনো শ্রমিক অসুস্থ হলে তিনি চিকিৎসা ব্যয়ের জন্য একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা পাবেন। এটা একটা মডেল হিসেবে দাঁড় করানোর উদ্যোগ নিয়েছে এসএনভি।

আমাদের গোলটেবিল বৈঠকের খবর পরদিন ৮ মার্চ প্রথম আলোয় প্রকাশিত হলে রাশেদা খানম ফোন করে আমকে বলেন, তাঁরা মালিকপক্ষের অ্যাসোসিয়েশন থেকে শ্রমিকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি পিকার্ড বাংলাদেশ লিমিটেডের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক পদে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁকে আমরা রিনা আপা বলেই জানি। ছাত্রজীবনে খেটে খাওয়া মানুষের জীবন-জীবিকা-অধিকার নিয়ে আমরা আন্দোলন করেছি। এখন কর্মজীবনের শেষ প্রান্তে এসেও যতটুকু সুযোগ পাওয়া, তার সদ্ব্যবহার করছেন। শ্রমিক, বিশেষত নারী শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য তিনি সব সময় সচেতন।

তাঁর প্রতিষ্ঠানটি যদিও পোশাকশিল্পের নয়, লেদার গুডস ও পাদুকাশিল্পের প্রতিষ্ঠান। এই শিল্পমালিকদের অ্যাসোসিয়েশন গত বছর থেকে তাদের সদস্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য কমপ্লায়েন্সের নির্ধারিত শর্তের বাইরেও শ্রমিকদের জন্য কিছু করণীয় নির্ধারণ করেছে। যেমন শ্রমিকদের যক্ষ্মা রোগের পরীক্ষা করে প্রয়োজনে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা। নারী শ্রমিকদের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবস্থা। চোখের পরীক্ষা ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা। বিমার বিশেষ ব্যবস্থা ইত্যাদি।

পোশাকশিল্প খাতেও অনেক প্রতিষ্ঠানে এ রকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নারী শ্রমিকদের জন্য বিশেষ চিকিৎসাব্যবস্থা। মাতৃত্বকালীন ছুটি। এমনকি কোনো কোনো কারখানায় শিশু যত্নকেন্দ্র ও কাজের সময়ের মধ্যেই মা যেন শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন, সে ব্যবস্থাও রয়েছে। এগুলো নিশ্চয়ই আমরা পোশাকশিল্প খাতে মডেল হিসেবে সারা দেশে প্রচার করতে পারি। একজন শ্রমিক তাঁর কাজের ক্ষেত্রে এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেলে তাঁর কর্মদক্ষতা বাড়ে। তিনি আরও মনোযোগ দিয়ে কাজ করেন। উৎপাদন বাড়ে। মালিকের মুনাফাও বাড়ে। একই সঙ্গে শ্রমিকও আনন্দের সঙ্গে কাজ করেন। বিষয়টি আমরা এখনো সব শিল্পকারখানায় প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। এটা আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

সেদিন গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথি ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মুজিবুল হক। তিনি বলেন, নারী শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন হোক। তাহলে নারীদের অধিকারের বিষয়টি নিয়ে শুধু আন্দোলন নয়, সচেতনতা সৃষ্টির কাজটিও হবে। তাঁর কথাটি ভেবে দেখার মতো। কারণ, পোশাকশিল্পে নারী শ্রমিকেরা অনেক ক্ষেত্রে বঞ্চিত। একটি সুস্থ ট্রেড ইউনিয়ন অবস্থার আমূল পরিবর্তন আনতে পারে। কারণ, পোশাকশিল্পে বিপুলসংখ্যক নারী কাজ করেন। তাঁরা প্রথা ভেঙে ঘরের বাইরে এসেছেন। তাঁরাও যে পুরুষের পাশাপাশি সমমানের কাজ করতে পারেন, বরং একটু বেশি ভালো কাজ করতে পারেন, সেটা আমাদের দেশে এই পোশাকশিল্পের শ্রমিকেরাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন।

আগামী ২০২১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর। আর মাত্র দুই বছর বাকি। এর মধ্যে দেশের ৫০ বছরে যদি আমাদের পোশাকশিল্প খাত ৫০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারে, তাহলে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার বিপ্লবী রূপান্তর ঘটবে।

আর এ জন্য চাই এই খাতে নারী শ্রমিকদের প্রজননস্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা এবং একই সঙ্গে তাঁদের ন্যায্য বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা।

আব্দুল কাইয়ুম: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক
[email protected]