আঞ্চলিক বৈষম্য কমবে, না বাড়বে?

নতুন সরকার গঠনের পর প্রথম আলো বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ, করণীয় ইত্যাদি বিষয়ে বেশ কিছু লেখা প্রকাশ করেছে। বিশেষজ্ঞদের সেসব লেখায় দেশের অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, প্রযুক্তি, সুশাসনসহ নানা বিষয়ে দিকনির্দেশনা ও পরামর্শ উঠে এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সেলিম রায়হান ‘বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ’ শিরোনামের নিবন্ধে আঞ্চলিক বৈষম্যের কথা খানিকটা তুলে ধরেছেন। এ নিয়ে বিশদ আলোচনা প্রয়োজন। কারণ, যে আঞ্চলিক বৈষম্যের সূত্র ধরে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, স্বাধীন দেশে তা দূর হয়নি।

পাকিস্তান আমলে ছিল ‘এক দেশ দুই অর্থনীতি’, আর স্বাধীন বাংলাদেশ আজ বিভক্ত তুলনামূলক সমৃদ্ধ ও পশ্চাৎপদ অঞ্চলে। ভৌগোলিকভাবে বলা হচ্ছে পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল। পূর্বাঞ্চলের ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট বিভাগে দারিদ্র্য তুলনামূলকভাবে কম; আর পশ্চিমাঞ্চলের রংপুর, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, খুলনা ও বরিশাল বিভাগে বেশি। একসময় দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের মঙ্গা নিয়ে অনেক আলোচনা হতো। সেই মঙ্গা দূর হয়েছে বটে, দারিদ্র্য
এখনো প্রকট।

আঞ্চলিক বৈষম্যের বিষয়টি আলোচনায় আসে ২০০৭-০৮–এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়। বিশ্বব্যাংক ২০০৮ সালের প্রতিবেদনে পূর্ব-পশ্চিম বিভাজনের কথা উল্লেখ করে। সেখানে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির মূল দুটো মেরু ঢাকা ও চট্টগ্রাম পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। এই দূর মেরুর প্রবৃদ্ধির সুফল থেকে পশ্চিমাঞ্চল বঞ্চিত হয়েছে যমুনা ও পদ্মা নদীর দ্বারা সৃষ্ট ভৌগোলিক বিভেদের কারণে। (সাজ্জাদ জহির, প্রথম আলো, ১৬ জানুয়ারি ২০১০)। ২০০৮ সালের ৮ সেপ্টেম্বর দেশের উন্নয়ন ও বৈষম্য নিয়ে প্রথম আলোও বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। শিরোনাম ছিল ‘আঞ্চলিক বৈষম্যে বাংলাদেশ বিভক্ত/ পূর্বাঞ্চল এগিয়ে, পশ্চিমাঞ্চল পিছিয়ে’।

দিনবদলের স্লোগান নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার এক বছর পর ২০১০-১১ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর আলোচনায় আঞ্চলিক বৈষম্যের বিষয়টি ওঠে। জাতীয় অর্থনীতি ও আঞ্চলিক অর্থনীতির মধ্যে রাষ্ট্র কোনটিকে প্রাধান্য দেবে? এ নিয়ে পরপর দুদিন সংসদে তুমুল বিতর্ক হয়। মইন উদ্দীন খান বাদল বলেন, ‘বাজেটে সব আছে, শুধু চট্টগ্রাম নেই। কিন্তু চট্টগ্রামের উন্নয়ন বাংলাদেশের উন্নয়ন।’ সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘জিডিপির ৩০ শতাংশ আসে ঢাকার অধিবাসীদের কাছ থেকে, ৫০ শতাংশ কর দেয় ঢাকার মানুষ। সুতরাং ঢাকার গুরুত্ব অপরিসীম।’ টি আই ফজলে রাব্বী বলেন, ‘উত্তরাঞ্চল দেখলে মনে হয়, উত্তর বাংলা যেন বাংলার অংশ নয়।’ টিপু মুনশি বলেন, ‘ঢাকা থেকে ৫০ ভাগ রাজস্ব আসে, আর চট্টগ্রাম দাবি করে তাদের ৩০ ভাগ আয় যুক্ত হয় বাজেটে। তাহলে বাকি দেশের উন্নয়ন আর কীভাবে হবে?’ (প্রথম আলো, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১০)।

জাতীয় অর্থনীতিতে আঞ্চলিক বৈষম্য আছে—এই সত্য স্বীকার করে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বলা হয়, ‘বিশেষ কর্মসূচির অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশে দুই ধরনের নির্দিষ্ট অঞ্চল বেরিয়ে আসে, একটি পশ্চাৎপদ অঞ্চল এবং অপরটি তুলনামূলকভাবে সমৃদ্ধ অঞ্চল। পদ্ধতি যা–ই হোক না কেন, বাংলাদেশে ১৫ থেকে ২০টি জেলাকে সহজেই পশ্চাৎপদ জেলা হিসেবে শ্রেণিভুক্ত করা যায়’ (সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, অধ্যায় ৪, পৃষ্ঠা ১৬২)। তারপর আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র প্রণয়ন করা হলো, পৃথক তহবিল গঠনের প্রস্তাব উঠল, কিন্তু আঞ্চলিক বৈষম্য কমল না; বরং দিন দিন তা বেড়েই চলেছে। অবশ্য নির্মাণাধীন পদ্মা সেতুকে ঘিরে দেশের দক্ষিণাঞ্চল এখন উন্নয়নমুখী।

সরকারি দলের নেতারা কয়েক বছর ধরে বলে আসছেন, পদ্মা সেতু হলে ‘দক্ষিণাঞ্চল হবে সিঙ্গাপুর’। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় পশ্চাৎপদ অঞ্চলের অগ্রগতি পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, ‘একটি বিশেষ দৃষ্টান্ত হিসেবে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা মেয়াদে পশ্চাৎপদ অঞ্চলের সমস্যা সমাধানে সরকারের উদ্বেগের প্রতিফলন ঘটেছে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নে সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে। পদ্মা সেতু চালু হলে আঞ্চলিক জিডিপি প্রায় ১ শতাংশ বাড়বে, মোংলা বন্দরের ভাগ্যে পুনরুজ্জীবন ঘটবে এবং দেশের দক্ষিণাঞ্চলে দারিদ্র্য দ্রুত কমে যাবে’ (সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, অধ্যায় ৪, পৃষ্ঠা ১৬৯)। দক্ষিণাঞ্চলের জন্য পদ্মা সেতু অবশ্যই আশাজাগানিয়া উদ্যোগ; কিন্তু উত্তরাঞ্চলের মানুষের আশা জাগবে কী নিয়ে?

২০১৭ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ আয়-ব্যয় জরিপের তথ্য হলো, যেখানে সারা দেশে দারিদ্র্যের গড় হার ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ, সেখানে রংপুর বিভাগের দারিদ্র্যের হার ৪২ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৭ দশমিক ২ শতাংশ। জেলাওয়ারি দারিদ্র্য হারের শীর্ষ ১০ জেলার মধ্যে ৫টিই রংপুর বিভাগের। ৭০ দশমিক ৮ শতাংশ নিয়ে দারিদ্র্যের শীর্ষে আছে কুড়িগ্রাম জেলা। এই তালিকায় আরও আছে রংপুর, দিনাজপুর, গাইবান্ধা ও লালমনিরহাট। এর মধ্যে দারিদ্র্যের হার দিনাজপুরে ৬৪ দশমিক ৩ শতাংশ, গাইবান্ধায় ৪৬ দশমিক ৭ শতাংশ, রংপুরে ৪৩ দশমিক ৮ শতাংশ এবং লালমনিরহাটে ৪২ শতাংশ। (প্রথম আলো, ১৯ অক্টোবর ২০১৭)।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) কয়েক মাস আগে সতর্ক করেছে, দেশে সমহারে সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে না। উন্নয়নে বৈষম্য প্রকট। সব উন্নয়ন এখন ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক। মোট দেশজ উৎপাদনের ৬০ শতাংশের ভার ঢাকা ও চট্টগ্রামের ওপর। উদ্বেগ আরও বাড়ে, যখন বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে দরিদ্র এলাকায় দারিদ্র্য বৃদ্ধির ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ২০১৪ সালে আয়-ব্যয় জরিপে দেশের দারিদ্র্যপীড়িত জেলার তালিকায় দিনাজপুর ছিল না। কিন্তু এটি এবার দেশের দ্বিতীয় দারিদ্র্যের শীর্ষ জেলা। আর দারিদ্র্যের শীর্ষে অবস্থানকারী জেলা কুড়িগ্রাম নিজেই নিজের রেকর্ড ভেঙে চলেছে।

এ অবস্থায় আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করতে নতুন সরকারের বড় পরিকল্পনা প্রয়োজন। সরকারের কর্মপরিকল্পনাই বলে দেবে, আগামী দিনগুলোতে বৈষম্য কমবে, না বাড়বে। যে আঞ্চলিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শহীদ হয়েছেন ৩০ লাখ মানুষ, তা দূর করার সর্বাত্মক উদ্যোগ নতুন সরকারকে নিতে হবে।

জহির রায়হান: একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সংবাদকর্মী
[email protected]