'খলিফা' বাগদাদি কোথায়?

আইসিল বা ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্ট নামে পরিচিত ‘খেলাফত’-এর শেষ ঠিকানাও মুছে যেতে বসেছে এই সপ্তাহে। আরবিভাষী মধ্যপ্রাচ্যে আইসিল ‘দায়েশ’ নামে পরিচিত। ইরাক সীমান্তের লাগোয়া সিরিয়ার বাগহুজ শহরে শেষ প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করেছিল দায়েশ যোদ্ধারা। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে সিরিয়ার আসাদবিরোধী এসডিএফ (সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্স) এই শহর দখলের মধ্য দিয়ে দুনিয়াজুড়ে বহুল আলোচিত আইসিল খেলাফতের অবসান ঘটাতে চলেছে শিগগির। ইতিমধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলার চার বছর পেরিয়ে গেছে এবং ইরাক ও সিরিয়ায় প্রায় ৩২ হাজার দফায় বিমান আক্রমণ হয়েছে। বহু শহর ও জনপদ ধ্বংস হয়েছে দায়েশ তাড়ানোর নামে।

মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশের টিভি চ্যানেলগুলোয় বাগহুজ অভিযানের লাইভ কাভারেজ চলছে এখন। ইউটিউবে প্রতিদিনকার যুদ্ধাবস্থার ভিডিও চিত্রও মিলছে। সর্বশেষ ৪০০ থেকে ৫০০ দায়েশ যোদ্ধা পরিবারসহ আত্মসমর্পণ বা মৃত্যুর অপেক্ষায় আছে সেখানে। তবে এসডিএফের হাতে এসব গেরিলার আত্মসমর্পণের মধ্যেও খেলাফতের ‘আমির’ আল-বাগদাদির সন্ধান মেলেনি। ৪৬ বছর বয়সী, সাদ্দাম ইউনিভার্সিটির এককালের পিএইচডিধারী, স্থানীয় খ্যাতনামা ফুটবলার বাগদাদি নিখোঁজ। তাঁর সবেধন একটা মাত্র ছবি ২০১৪ সালের জুলাইয়ে মসুলের আল-নুরি মসজিদে নিজেকে ‘খলিফা’ হিসেবে ঘোষণাকালে তোলা হয়েছিল। এসডিএফ বা মধ্যপ্রাচ্যের অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের কেউই সঠিকভাবে হদিস দিতে পারছেন নাÑবাগদাদি এখন কোথায়?

কোথাও এক দিনের বেশি থাকেন না যিনি
২০১৪ সালে আইসিল যখন ‘খেলাফত’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়, তখন একপর্যায়ে তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল ৩৪ হাজার বর্গমাইল এলাকা। পশ্চিম সিরিয়া থেকে পূর্ব ইরাক পর্যন্ত বিশাল এক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে মধ্যপ্রাচ্যের শাসকদের ভীতির মধ্যে ফেলে দিয়েছিল তারা।

ইরাকের মসুলকে রাজধানী ঘোষণা করে পরিচালিত সেই খেলাফতে প্রায় ৮০ লাখ স্থানীয় মানুষকে রাতারাতি বাগদাদিকে খলিফা মানতে হয়। এই স্থানীয়দের কাছে যে ‘খলিফা’ একদা পরিচিত ছিলেন পারিবারিক নাম ইব্রাহিম আল-ভাদ্রি নামে।

২০১৮ সালের শুরুতে ইরাক সরকার তাদের দেশকে দায়েশমুক্ত ঘোষণা করে। ধারণা করা হয়, মসুলের পতনের পর বাগদাদি এসে আশ্রয় নেন সিরিয়ার দেইর-আল-জউর শহরে। ইরাকের গোয়েন্দা মহলে এরূপ কথা প্রচলিত রয়েছে যে বাগদাদি কখনো এক স্থানে এক দিনের বেশি থাকেন না। অল্প কয়েকজন সহযোগীসহ চলাফেরা করেন তিনি, যারা কখনোই নজরদারিযোগ্য ইলেকট্রনিক কোনো ডিভাইস ব্যবহার করে না।

২০১৮ সালের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে হোমস শহরে সিরিয়ার সরকারি বাহিনীর ছোড়া রুশ মিসাইলে বাগদাদির ছেলে হুতাইফা আল-ভাদ্রি মারা যায়। রুশরা একসময় বাগদাদিকে হত্যারও দাবি করেছিল। গত বছর আগস্টে তাঁর ৫৫ মিনিটের এক ভিডিও ভাষণ প্রচারিত হওয়ার পর এ দাবির অসারতা প্রমাণিত হয়। এটা ছিল প্রায় ১০ মাস পর বাগদাদির বেঁচে থাকার একমাত্র ‘প্রমাণ’ এবং এরপর থেকে এরূপ আর কোনো প্রমাণ মেলেনি। ইতিমধ্যে গত প্রায় ছয় মাসে দায়েশ সাম্রাজ্য ছোট হতে হতে বাগহুজে এসে থেমেছে। এই সপ্তাহে সেই বাগহুজও ভেঙে পড়বে বলে অনুমান করা হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই পুরো অঞ্চলের প্রধান কৌতূহল এখন বাগদাদিকে নিয়ে। বিশ্ববাসীও মানুষটির হদিস জানতে উদ্‌গ্রীব।

ট্রাম্পের জন্য বাগদাদিকে খুঁজে পাওয়া জরুরি
যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে বহুবার বলেছেন, বাগদাদি তাঁদের এক ‘প্রধানতম শত্রু’। যে শত্রুর সন্ধানদাতার জন্য বড় অঙ্কের পুরস্কার ঘোষণা করে রেখেছে দেশটি। প্রথমে এই ঘোষণা ১০ মিলিয়ন ডলার ছিল, পরে ২৫ মিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। ওসামা বিন লাদেনের তথ্যের জন্য ঘোষিত অর্থও ছিল একই অঙ্কের।

ওসামার সঙ্গে বাগদাদির রহস্যঘেরা মিল অনেক। প্রথমজন একদা আফগান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের মদদ পেয়েছিলেন আর দ্বিতীয়জন আইসিল গড়ে তোলার আগে যুক্তরাষ্ট্রের হাতেই ২০০৪ সালে বন্দী ছিলেন ১০ মাস। আফগান যুদ্ধে জড়িত হয়ে যুক্তরাষ্ট্র ওসামাকে তৈরি করে আর ইরাকে তাদের আগ্রাসনে বাগদাদির জন্ম হয়। এই দুজনের সর্বশেষ মিল হলো ওসামার অনুসারীদের কার্যক্রম মোকাবিলার নামে আফগানিস্তানে যেতে পেরেছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং বাগদাদিকে মোকাবিলা করতেই ইরাক ছাড়ার দুই বছর পর আবারও সেখানে এবং সিরিয়ায় নামার অজুহাত পায় আমেরিকানরা। ২০১১ সালের মে মাসে ওসামাকে যুক্তরাষ্ট্রই হত্যা করে। কিন্তু বাগদাদি এখন কোথায়? বিশেষত, যখন ওয়াশিংটনে অনেকে মনে করছেন নির্বাচনী ডামাডোল শুরুর আগে ট্রাম্পের ভাবমূর্তির নাটকীয় উন্নতির জন্য বাগদাদিকে ধরার মতো একটা ‘ঘটনা’ খুব প্রয়োজন।

যুদ্ধের শেষ লগ্নেও মিলছে না বাগদাদিকে
এটা বৈশ্বিক সত্য যে বিদেশি আগ্রাসন যেকোনো নিরীহ জাতিকেও সশস্ত্র করে তোলে। একই কারণে খেলাফত ঘোষণার শুরুর দিনগুলোয় ইরাকে পর্যাপ্ত অনুসারী পেতে বাগদাদিকে সমস্যায় পড়তে হয়নি। আবার বাগদাদির অনুসারীদের মধ্যে কীভাবে পশ্চিমা গোয়েন্দারা এজেন্ট ঢুকিয়ে রেখেছিল, তাও ভালোভাবেই বিশ্বের নজরে আসে যখন সিরিয়ার রাক্কায় দায়েশের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত হামলার আগে সেখান থেকে গোপনে এক দায়েশ কমান্ডারকে উদ্ধার করে নিয়ে আসা হয়েছিল ২০১৭ সালের এপ্রিলে। জর্ডানের নাগরিক ওই যোদ্ধা ছিলেন কার্যত ন্যাটোর চর।

এ রকম নানান প্রতিকূলতা সামলেও বাগদাদি এখনো মুক্ত। ধারণা করা হচ্ছে, ইরাক-সিরিয়া সীমান্তে ইফ্রেতিস নদীর তীর ঘেঁষে সর্বশেষ বেঁচে থাকা সহযোদ্ধাদের মধ্যেই আছেন তিনি। বাগহুজে দায়েশের সবচেয়ে নেতৃস্থানীয় এসব সংগঠকের সামনে এখন আত্মসমর্পণ বা মৃত্যু অপেক্ষা করছে। এদের মধ্যেই বাগদাদির থাকার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু যুদ্ধের শেষ লগ্নেও বাগদাদিকে না পাওয়ায় তাঁর অস্তিত্ব নিয়ে রহস্য বাড়ছে ক্রমে।

বাগহুজ সীমান্ত অঞ্চল হওয়ায় বাগদাদির পক্ষে ইরাকে ঢুকে পড়াও সম্ভব। আবার গত সেপ্টেম্বরে সৌদি নাগরিকদের মালিকানাধীন আশরাক আল-আওসাত লিখেছিল, ইরানের জাহিদান শহরের ভেতর দিয়ে বাগদাদি আফগানিস্তানের নানগাহরে চলে এসেছেন। পাকিস্তানের গোয়েন্দাদের সূত্রে আশরাক আল-আওসাত এই প্রতিবেদন ছাপে। ভিন্ন কোনো সূত্র দ্বারা এই সংবাদ সমর্থিত হয়নি। তবে আফগানিস্তান নিশ্চিতভাবেই লুকিয়ে থাকার জন্য একটা ভালো জায়গা।

বাগদাদি আলজেরিয়ার দক্ষিণ-পূর্বের তামানরাসেতে পৌঁছেছেন বলেও একটা সংবাদ রটেছিল গত বছর। তাঁর আহত হওয়ারও বহু সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সময়। এসবই হয়তো দায়েশ যোদ্ধাদের মনোবলে চিড় ধরাতে প্রচারণাযুদ্ধের কৌশল ছিল। আইসিলের বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই আপসহীনভাবে যুদ্ধ করছে কুর্দিরা। কুর্দি গোয়েন্দাপ্রধান লাহুর তালাবানির অনুমানকে তাই এ ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব দিতেই হয়। তাঁর ভাষায়, ‘আমি ৯৯ শতাংশ নিশ্চিত, বাগদাদি জীবিত। কিন্তু কেউই জানে না, তিনি এখন দেখতে কী অবস্থায় আছেন, কোথায় আছেন!’ ২০১৬ সালে প্রধান সহযোগী মোহাম্মদ আল-আদনানিকে হারানোর পর বাগদাদি নিজেকে আরও বেশি গোপনীয়তায় মুড়িয়ে নিয়েছেন।

আইসিল বিশেষজ্ঞ যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিক জবি উরিকের নেতৃত্বে ওয়াশিংটন পোস্টের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখা যায়, খেলাফতের পতন অনিবার্য জেনে বাগদাদি গত বছর থেকে পুরো সংগঠনে কাঠামোগত পরিবর্তন নিয়ে আসতে শুরু করেন। দায়েশ গেরিলাদের বিরুদ্ধে অভিযানে পশ্চিমা শক্তিগুলোর মধ্যে মতদ্বৈধতা এবং ধীরগতির সুযোগে শারীরিক রাষ্ট্রের পরিবর্তে আইসিলকে ক্রমে একটি গোপন ভাবাদর্শিক ও গেরিলা সংগঠনে পরিণত করার কাজ সম্পন্ন হয়। কৌশলগত এই পরিবর্তনের লক্ষ্য ছিল ‘খেলাফতের পতন’ শেষেও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পরবর্তী প্রজন্মের ওপর প্রভাব ধরে রাখা। এই কৌশলের অংশ হিসেবে বাগদাদি প্রচারমাধ্যমে কম হাজির হতে থাকেন। সংগঠনটিকে ঘিরে রহস্যের কালো মেঘ আর গাঢ় হয় মাত্র।

বাগহুজের পর কী
বাগহুজের পতনকে পশ্চিমের সংবাদমাধ্যম ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের বড় এক সামরিক সফলতা হিসেবে দেখালেও এটা সত্য যে দায়েশের সব যোদ্ধাই গ্রেপ্তার বা নিহত হয়নি। মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশেই এর অনেক সেল ‘অক্ষত’ ও ‘ঘুমন্ত’ অবস্থায় রাখা আছে। খেলাফতের কাঠামোগত পতন হলেও এই যোদ্ধারা মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে কাজ করে চলবে। বাগদাদি অধরা থাকা পর্যন্ত তাদের মনোবলেও চিড় ধরার সম্ভাবনা কম। সিরিয়ায় কুর্দিদের হাতে স্ত্রী-পরিজনসহ ইতিমধ্যে আটক শত বিদেশি দায়েশ যোদ্ধার আটক প্রমাণ করছে, বাগদাদির বিশ্ব নেটওয়ার্ক অনেক বড় ও ব্যাপক।

এ পর্যায়ে স্মরণযোগ্য, আল–কায়েদা দুর্বল হওয়ার মাঝেই ইরাকে তার ক্যাডারদের ভেতর থেকে গড়ে উঠেছিল আইসিল। বাগহুজের পতন দায়েশের অভ্যন্তর থেকেই নতুন কোনো নেতার মাধ্যমে নতুন ধারার সংগঠনের জন্ম দিতে পারে। উপরন্তু, দায়েশ যোদ্ধাদের একাংশ ধীরে ধীরে পুরোনো সংগঠন আল-কায়েদায়ও শামিল হতে পারে। বাগহুজের পতনের পর শিগগির কিছু হামলার মাধ্যমে নিশ্চিতভাবেই তারা উপস্থিতির কথাও জানাবে। এরূপ উপস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রেরও দরকার। কারণ, দায়েশে ‘রুখতে’ তাদেরও ইরাক ও সিরিয়ায় ‘ন্যূনতম হলেও’ উপস্থিতি বজায় না রাখলেই নয়! ফলে, বাগহুজের পতন এবং বাগদাদিকে না পাওয়ার মধ্য দিয়ে দায়েশবিরোধী অভিযান শেষ হওয়ার পরিবর্তে আরও জটিল ও বিপজ্জনক এক অধ্যায়ে ঢুকল মাত্র।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক