মৌজা বীরসিংজুরির গ্রামজীবন

বীরসিংজুরির দক্ষিণে কাশিমপুর, পশ্চিমে সাইলকাইল, পূর্বে গণসিংজুরি এবং উত্তরে বাইলজুরি। শহুরেদের কাছে মানিকগঞ্জ থেকে ৮-১০ কিলোমিটার দূরের ‘গ্রাম’ এটা। ধলেশ্বরীর এককালের চরাঞ্চল। গ্রামবাসীর কাছে বীরসিংজুরি একটা ‘মৌজা’মাত্র। দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে এক কিলোমিটার করে হবে। স্থানীয় লোকজনের গর্বিত দাবি, মানিকগঞ্জের প্রথম বিএ তারকবন্ধু অধিকারী এই মৌজার সন্তান। তবে বীরসিংজুরির বর্তমান চিত্রটি গর্ব করার মতো নয়। ক্রমে স্থবির গ্রামসমাজের মূর্ত এক প্রতীক যেন এই মৌজা। অর্থনৈতিক টানাপোড়েন আর রাজনৈতিক হতাশার মধ্যেই উঁকি দিচ্ছে মাদকের আসন্ন ব্যাপকতার ইঙ্গিত।

শিল্প বা ব্যবসা বাড়েনি

অতীত চরাঞ্চল বলে বীরসিংজুরিতে প্রাচীন বৃক্ষের দেখা মেলে কম। বর্ষায় বিলগুলো টইটম্বুর হয়ে যায়। সে কারণেই বিলের পাড় ঘেঁষে বসতিগুলো গড়া হয়েছে উঁচু উঁচু করে। উপজেলা ছুঁয়ে জেলায় পৌঁছানোর সড়ক আছে ভালোমতো। আছে বিদ্যুৎও। এই দুই ক্ষেত্রে গত এক যুগে ভালো উন্নতি হয়েছে। ছেলেমেয়েরা সহজেই স্কুলে যেতে পারে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে এখানে। মক্তবও আছে একটি। তবে সরকারি হাইস্কুল নেই।

যেমনটি আশা করা হয়েছিল—বিদ্যুৎ আর পাকা সড়ক ব্যবসায় বা শিল্পের কোনো সম্ভাবনা নিয়ে আসেনি। এনজিওগুলোও ‘সুদি ব্যবসা’র বাইরে উদ্যোক্তা তৈরি করতে সক্ষম হয়নি। গতানুগতিক মুদি ও কাপড়ের দোকানের সঙ্গে গ্রামের বড় বাজারটিতে কেবল শ্যালো মেশিন সারাই এবং লেদ মেশিনের দুটি স্থাপনা পাওয়া গেল। বড় একটা রাইস মিলও নেই, যা এখানে খুব দরকার।

মধ্য মার্চে ‘অটো’তে চড়ে গ্রামের পথে ঢুকতেই দেখা গেল—শীতের সরিষা তোলার পর মার্চে বিলগুলোতে রোপা আমন শ্যালোর পানি খেয়ে খেয়ে কেবল একটু বড় হচ্ছে। প্রায় এক হাজার ‘খানা’ আছে এই মৌজায়। তার মধ্যে রাজবংশী, নমশূদ্র, শীল মিলে প্রায় ২০ ঘর হিন্দু পরিবারও আছে। তাদের মধ্যে কায়স্থ পরিবার দুটি আর্থিকভাবে খানিকটা সবল।

সামগ্রিকভাবে এই মৌজায় ভূমিহীনতা কম। বড় জোতদারও কম। অধিকাংশেরই কমবেশি কিছু জমি আছে। প্রায় ১০ ভাগ পরিবারের ১৫ বিঘা পর্যন্ত জমি আছে। তবে যাদের জমি আছে তারা আবাদ করছে কম। যদিও পুরো মৌজায় সংখ্যাগরিষ্ঠ পরিবারই কৃষিকে আঁকড়ে ধরেই বাঁচার চেষ্টায় আছে। আবাদ হচ্ছে মূলত ‘কট’-এ নেওয়া জমিতে। বিঘাপ্রতি ৫ হাজারে বছরজুড়ে জমি পাওয়া যায়। জমির ক্রয়-বিক্রয় কম। দামও পড়তিমুখী। শতাংশপ্রতি ২২ থেকে ২৫ হাজারে জমি মেলে।

কৃষির আয়ে নেই সচ্ছলতা

বীরসিংজুরিতে ফসল বলতে মূলত দুটো। যারা সরিষা বোনে—তারাই আমন করে একই জমিতে। আর যারা ভুট্টা বোনে—তারা পরে পাট লাগায়। মরিচ, আলু, পেঁয়াজ হয় অল্প অল্প। এর বাইরে কারও কারও আছে ছোট ছোট নেপিয়ার ঘাসের খেত। গাভি পালনের জন্য বিখ্যাত এই গ্রাম। প্রতিদিন প্রায় ২০০ মণ দুধ হয় এখানে। দাম বছরজুড়ে নানান রকম। ৩৫ থেকে ৬০-এর মধ্যে ওঠানামা করে। ধান আর দুধের ওপরই কৃষিজীবী পরিবারগুলোর ভরসা। তবে কেবল এই দুয়ের ওপর নির্ভর করে আর চলছে না। সার, সেচ ও শ্রমিকের খরচ শেষে ধানেও লাভ নেই আর। গাভি পালনেও খরচ বাড়ছে। ঘরের মধ্যেই নেপিয়ার আর ভুসি খাইয়ে গাভি পালতে হয়। গরু চরানোর জায়গা নেই। দুধের টাকার বড় অংশ খরচ হয়ে যায় গাভির খাবার ও চিকিত্সায়। কৃষির আয়ে বীরসিংজুরিতে সচ্ছল পরিবার নেই। বরং আবাদে ভর্তুকি লাগছে প্রতিবছর। যে পরিবারে কেউ অন্য সূত্রে কিছু আয় করে, তারাই ভর্তুকি দিয়ে চাষ করতে পারছে। এ রকম ৩-৪টি পরিবার আয়রনমুক্ত পানির জন্য বাড়িতে প্রায় ১০ হাজার টাকা খরচ করে টিউবওয়েল বসিয়েছে। কিন্তু বাকি মৌজায় কী হবে, সেটা কেউ জানে না। বিশুদ্ধ পানির সংকট সর্বগ্রাসী।

গ্রামে সরকারি-বেসরকারি চাকুরে বা বিদেশে কেউ আছে—এ রকম খানা ৫০টির মতো। বেসরকারি চাকুরেদের মধ্যে একজন ব্যাংকার এবং সরকারি একজন ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়ি সবাই চেনে। এ রকম কয়েকটি বাড়িতে ইট-সিমেন্টের ঘর চোখে পড়ল। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আছেন ৮-১০ জন। তাঁদের কেউ কেউ পরিকল্পনার কথা জানালেন—‘পেনশনের টাকায় বাড়ি করবেন।’ এ রকম পরিবারগুলোই কেবল ‘স্থিতিশীল’। বাজারে ভালো মাছ-মুরগি তারাই কেনে। বাকিরা উচাটনে আছে। সরকারের বিভিন্ন ভাতা পান প্রায় ৫০ জন। সেসব ‘সুবিধাভোগী’ বাছাই করেন মেম্বর-চেয়ারম্যানরা। এভাবে রাষ্ট্রীয় অর্থ গ্রামে এলেও কৃষি অর্থনীতির জাগরণে তার ছাপ পড়ে সামান্যই।

তারপরও বীরসিংজুরিতে কোনো অপরাধ নেই। নেই চুরি-ডাকাতির ঘটনা। বহুদিন খুন-রাহাজানিও হয় না এখানে। স্বল্প আয়ের পরিবারগুলোতে কেউ কেউ ‘অটো’ বা ভ্যান চালাচ্ছে। কেউ কেউ রিকশা। অকৃষি এসব পেশায় আগের মতো আর অভাব নেই গ্রামে। তবে পুরো মৌজাজুড়ে তরুণদের কর্মসংস্থানের বড় সংকট চলছে। কেউ কেউ সাভার-আশুলিয়ার শিল্পপাড়ায় কাজের চেষ্টা করছে। কয়েকজন গ্রামের বাজার থেকে আরিচা রোড পর্যন্ত হোন্ডা সার্ভিসে শামিল হয়েছে। আছে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার চেষ্টা। অপেক্ষাকৃত ‘মেধাবী’রা সবচেয়ে বেশি হতবিহ্বল অবস্থায় আছে—অস্পষ্ট ভবিষ্যৎ নিয়ে। এদের কাছেই জানা গেল, বুড়োদের কাছে তারা শুনেছে—একদা মাঝরাতে বীরসিংজুরি সরব থাকত তাঁতের শব্দে।

রাজনীতি-সংস্কৃতি-খেলাধুলা বাদ

রাজনীতির বিষয়ে তরুণ, বৃদ্ধ—প্রায় সবারই আগ্রহ দেখা গেল সামান্য। এ মাসেই সেখানে উপজেলা নির্বাচন। কিন্তু কারও এ নিয়ে তেমন উৎসাহ দেখা গেল না। এই অনাগ্রহের কারণও প্রায় সবার জবানিতে এক রকম।

বীরসিংজুরিতে চারজন ভাতাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা আছেন। তাঁদেরই একজন স্থানীয় অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে বিষণ্ন মুখে জানালেন, তরুণেরা কেবল যে রাজনীতির প্রতি অনাগ্রহী, তা নয়—তারা রাজনীতিবিদদের প্রতিও শ্রদ্ধা হারাচ্ছে। গ্রাম তো দূরের কথা, ইউনিয়ন পর্যায়েও রাজনীতির চর্চা হারিয়ে গেছে। বীরসিংজুরি থেকে খেলাধুলাও উঠে গেছে। যদিও এই এলাকার সংসদ সদস্য জাতীয় পর্যায়ের একজন বিখ্যাত খেলোয়াড়। ‘বীণাপাণি স্পোর্টিং ক্লাব’ নামে একটা সুপরিচিত সংস্থাও ছিল এককালে এখানে। খেলাধুলার পাশাপাশি সংস্কৃতিচর্চারও কোনো সংগঠন আজ আর নেই।

দেশের হালহকিকত নিয়ে স্থানীয় লোকজনের জানার ক্ষুধাও কমছে। বীরসিংজুরিতে সংবাদপত্র পাঠক আছে মাত্র দু-তিনজন। তবে চায়ের দোকানগুলোতে আগের মতোই এখনো টিভি চলে। কিন্তু এখন ‘খবর’-এর বদলে সবার পছন্দ সিনেমা। পাঁচ টাকায় একটা চা নিয়ে—ভারতীয় রঙিন সিনেমার কল্পিত কাহিনির মধ্যেই কিছুক্ষণ বুঁদ হয়ে থাকে বীরসিংজুরির সাদাকালো মানুষ। জিডিপি আর প্রবৃদ্ধির হিসাবে গড়া শহুরে অর্থনীতিশাস্ত্র তাঁদের জীবনধারাকে কীভাবে নথিবদ্ধ করছে—এ নিয়ে সামান্যই আগ্রহ তাদের।

জরিপ অধিদপ্তরের একটি সূত্রমতে, বাংলাদেশে মৌজা আছে ৬০ হাজারের কিছু বেশি। বীরসিংজুরি সেই তালিকার একটি মাত্র। নিশ্চয়ই সব মৌজার চিত্র এক রকম নয়। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মৌজায় যদি বীরসিংজুরির মতো সমাজচিত্রের কিছুটাও দেখা মেলে, তাহলে আমাদের অর্থনৈতিক লক্ষ্য পুনর্ভাবনা চাইছে। কারণ, কৃষি অর্থনীতি চাঙা না হলে কর্মসংস্থান চিত্র পাল্টাচ্ছে না।

সপ্তম পঞ্চবার্ষিক (২০১৫-২০১৯) পরিকল্পনায় রাষ্ট্র চেয়েছিল (নির্বাহী সারসংক্ষেপ) শিল্প ও সেবার পাশাপাশি কৃষির ‘অর্থবহ প্রবৃদ্ধি’, যাতে ‘অধিকাংশ ছদ্ম বেকারসহ অতিরিক্ত শ্রমশক্তির লাভজনক কর্মসংস্থান নিশ্চিত হয়।’ পাঁচ বছর মেয়াদি নতুন আরেক দফা পথচলার আগে নিশ্চিতভাবেই গ্রামীণ জনপদের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে পুনরায় গভীর তদন্ত দরকার।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক