'যুদ্ধক্ষেত্র' ভেনেজুয়েলা: ২-০ তে পিছিয়ে ট্রাম্প ফের পুতিনের সামনে

মুখোমুখি ডোনাল্ড ট্রাম্প (বাঁয়ে) ও ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: এএফপি
মুখোমুখি ডোনাল্ড ট্রাম্প (বাঁয়ে) ও ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: এএফপি

আবার মুখোমুখি আমেরিকা–রাশিয়া। গত ডিসেম্বরেই সিরিয়া থেকে পিছুহটার ঘোষণা দেওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্প আবার ভ্লাদিমির পুতিনের মুখোমুখি। এবার ‘যুদ্ধক্ষেত্র’ ভেনেজুয়েলা। লাতিন আমেরিকার এই দেশটির রাজনৈতিক সংকট ঘিরে এমন অবস্থানে ওয়াশিংটন–মস্কো।

সংকটে ভেনেজুয়েলা
ভেনেজুয়েলার চলমান রাজনৈতিক সংকট শুরু গত বছর পার্লামেন্ট নির্বাচনের পর। নির্বাচনে জিতে আরও ছয় বছরের জন্য ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করেন প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরো। কিন্তু মাদুরোর বিরুদ্ধে ব্যাপক ভোট জালিয়াতির অভিযোগ তোলেন বিরোধীরা। নির্বাচনের ফল বর্জনের মাধ্যমে মাদুরোর সরকারকে অবৈধ প্রমাণ করতে চেয়েছেন তাঁরা। একপর্যায়ে বিরোধী নেতারা অভ্যুত্থানচেষ্টার মাধ্যমে অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু করেন। মাদুরো প্রশাসনের অব্যবস্থাপনা, খাদ্যসামগ্রীর ঘাটতি, বিপর্যস্ত অর্থনীতি, বিদ্যুৎ বিপর্যয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ার বিষয়গুলোকে কাজে লাগিয়ে মাদুরোবিরোধী জনমত জোরালো করেন বিরোধী নেতারা। সব মিলিয়ে দেশটি রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল আকার ধারণ করে।

ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরো (বাঁয়ে) ও স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট হুয়ান গুয়াইদো। ছবি: বিবিসি
ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরো (বাঁয়ে) ও স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট হুয়ান গুয়াইদো। ছবি: বিবিসি

মাদুরো গত ১০ জানুয়ারি নতুন মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। এতে সংকট আরও ঘনীভূত হয়। এমন পরিস্থিতিতে গত ২৩ জানুয়ারি মাদুরোবিরোধী নেতা হুয়ান গুয়াইদো নিজেকে ভেনেজুয়েলার অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা দেন। পরদিন তাঁর এই ঘোষণাকে সমর্থন দেয় আমেরিকা। এ ঘোষণা শুধু ঘোষণার মধ্যেই রাখেনি ওয়াশিংটন। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সেই দেশ ছাড়ার জন্য শীর্ষ পর্যায়ের মার্কিন কূটনীতিকদের নির্দেশ দেয় ট্রাম্প প্রশাসন। সর্বশেষ গত সোমবার কারাকাসে থাকা সব পর্যায়ের মার্কিন কূটনীতিককে ফিরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেয় ওয়াশিংটন।

কে কার পক্ষে
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, ভেনেজুয়েলার চলমান সংকটে আমেরিকার সঙ্গে হাত মিলিয়ে ব্রাজিল, কলম্বিয়া, চিলি, পেরু ও আর্জেন্টিনা মাদুরোবিরোধী নেতা গুয়াইদোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও (ইউপি) নতুন করে নির্বাচন দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। বিপরীতে মাদুরোর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে রাশিয়া। রাশিয়ার সঙ্গে রয়েছে মেক্সিকো, চীন ও তুরস্ক। ভেনেজুয়েলাকে নিয়ে প্রকাশ্যেই লড়াইয়ে নেমেছে ওয়াশিংটন ও মস্কো।

মুখোমুখি যুক্তরাষ্ট্র–রাশিয়া
বার্তা সংস্থা এএফপি বলছে, গুয়াইদো নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণার পরদিন ২৪ জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজেই গুয়াইদোর প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেন। ট্রাম্প বলেন, মাদুরোর বিরুদ্ধে সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে ভেনেজুয়েলার জনগণ। গুয়াইদোর ঘোষণার বিরুদ্ধে মাদুরোর যেকোনো পদক্ষেপ ঠেকাতে সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত ওয়াশিংটন। এরপর নড়েচড়ে বসে রাশিয়া। রয়টার্সের খবরে বলা হয়, ২৫ জানুয়ারি রাশিয়া ঘোষণা করে, গুয়াইদোর প্রতি বিভিন্ন দেশের সমর্থন প্রকাশ আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এটা ভেনেজুয়েলায় ‘সরাসরি রক্তপাতের পথ’ তৈরি করবে। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেন, মাদুরোই ভেনেজুয়েলার বৈধ প্রেসিডেন্ট। ভেনেজুয়েলার জনগণই দেশটির ভবিষ্যৎ ঠিক করবে, আর কেউ নয়। ভেনেজুয়েলায় বাইরের কারও ধ্বংসাত্মক পদক্ষেপ একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।

রাশিয়া মাদুরোর প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেই চুপ থাকেনি। ভেনেজুয়েলার টালমাটাল পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করারও ব্যবস্থা নিয়েছে। রয়টার্স বলছে, রাশিয়া থেকে গোপনে সামরিক টিম ঢুকেছে ভেনেজুয়েলায়। তারা মাদুরোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।

কেন মুখোমুখি
কিন্তু কেন এই বিপরীতমুখী অবস্থান রাশিয়া–আমেরিকার? ভেনেজুয়েলার সঙ্গে রাশিয়ার উষ্ণ সম্পর্ক নতুন নয়। মাদুরোর পূর্বসূরি প্রয়াত হুগো চাভেজ আমেরিকার কট্টর সমালোচক ছিলেন; যা তাঁকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রাশিয়ার মিত্র হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে। মস্কোভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রাশিয়ান ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স কাউন্সিলের আন্দ্রে কুর্তোনভের ভাষায়, ‘এ সম্পর্ক প্রতীকীভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এর মানে হলো আমরা একা নই, আরও অনেকে আছেন, যাঁরা আমেরিকা ও পশ্চিমা নীতির সমালোচনা করেন।’ আসলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভেনেজুয়েলা–রাশিয়া অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ হয়েছে। ভেনেজুয়েলায় রাশিয়ার অস্ত্র বিক্রি বেড়েছে, রাশিয়ার দেওয়া ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। শুধু তা–ই নয়, গত ডিসেম্বরে মাদুরোর প্রতি সমর্থন প্রকাশ করতে রুশ দুটি যুদ্ধবিমান ওড়ানো হয় ভেনেজুয়েলার আকাশে। বিবিসি বলছে, ঋণ ও সহায়তা মিলিয়ে ভেনেজুয়েলাকে ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলার দিয়েছে রাশিয়া। ভেনেজুয়েলায় রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জ্বালানি তেলের রিজার্ভ। তেলের অনেকগুলো প্রকল্পে রাশিয়ার অংশীদারত্বও রয়েছে। যদিও এর অনেক কিছুই স্বীকার করতে চায় না মস্কো।

অন্যদিকে অভিযোগ রয়েছে, চাভেজের সময় থেকেই ভেনেজুয়েলাকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টায় লিপ্ত ওয়াশিংটন। মাদুরোবিরোধী চলমান আন্দোলনেও মার্কিন মদদ রয়েছে। গুয়াইদোকে সমর্থন দিয়ে সেটা স্পষ্ট করেছেন ট্রাম্প।

সিরিয়ায় মুখোমুখি হয়েছিল রাশিয়া–আমেরিকা। গত ডিসেম্বরে সিরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স
সিরিয়ায় মুখোমুখি হয়েছিল রাশিয়া–আমেরিকা। গত ডিসেম্বরে সিরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন ট্রাম্প। ছবি: রয়টার্স

সাম্প্রতিক লড়াই
আমেরিকার বিপক্ষে পুতিনের রাশিয়ার এমন মুখোমুখি অবস্থান নতুন নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার সঙ্গে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে ইতি ঘটে সেই স্নায়ুযুদ্ধের। তৈরি হয় এককেন্দ্রিক বিশ্ব, যার নিয়ন্ত্রণ পায় আমেরিকা। কিন্তু পুতিনের রাশিয়া সেটাই ফিরিয়ে এনেছে। গত প্রায় এক যুগে আমেরিকা ও রাশিয়ার প্রচ্ছন্ন লড়াই দেখা গেছে বেশ কিছু ইস্যুতে। ২০০৭ সালে পোল্যান্ডে আমেরিকার ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা মোতায়েনের ঘোষণা, ২০০৮ সালে জর্জিয়ায় বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সরকারের পক্ষ নিয়ে দুই দেশের অবস্থান, ২০১৩ সালে আমেরিকার গোপন নথির তথ্য ফাঁসকারী মার্কিন নাগরিক এডওয়ার্ড স্নোডেনকে রাশিয়ায় আশ্রয় দেওয়ার ইস্যুগুলোতে মস্কো-ওয়াশিংটনের পরোক্ষ লড়াই দেখা গেছে। ইউক্রেনে রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের পতনের পর ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনের সঙ্গে থাকা দ্বীপ ক্রিমিয়া দখল করে নেয় রাশিয়া। সেখানে আমেরিকার সমর্থনপুষ্ট পক্ষ হেরেছে রাশিয়ার কাছে।

এরপর ২০১৫ সালে সিরিয়া যুদ্ধে মুখোমুখি অবস্থান নেয় রাশিয়া– আমেরিকা। পুতিন সরাসরি সমর্থন দেন সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদের প্রতি। অন্যদিকে ওয়াশিংটন সমর্থন দেয় বাশারবিরোধীদের প্রতি। শেষ পর্যন্ত গত ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সিরিয়া থেকে দুই হাজার মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। সেই ঘোষণা অনুযায়ী চলতি মার্চেই সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহার হওয়ার কথা। সিরিয়া থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার পুতিনের কাছে ট্রাম্পের পরাজয়েরই নামান্তর।

ট্রাম্প অবশ্য প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরপরই পুতিনের কাছে আরেকবার হেরেছেন। অভিযোগ রয়েছে, ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার ভোটে পুতিন তথা রাশিয়া হস্তক্ষেপ করেছে। যদিও সেই অভিযোগের এখনো সুরাহা হয়নি। কিন্তু ওই অভিযোগ যে ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে কলঙ্কিত করেছে, সেটা নিশ্চিত। এরপর সিরিয়ায় পুতিনের কাছে হার; স্পষ্টতই ২–০তে পিছিয়ে থেকে ট্রাম্প ভেনেজুয়েলায় আবার পুতিনের মুখোমুখি হলেন। কে জিতবেন এই লড়াইয়ে? ফল দেখার জন্য অপেক্ষায় থাকতে হবে সবাইকে।

মাহফুজার রহমান: সাংবাদিক
[email protected]