গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব

সেবাপণ্যের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে সাধারণত সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের লোকসানের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়। কিন্তু গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানিগুলো লাভে থাকা সত্ত্বেও গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন বা বিইআরসি। স্বাভাবিক কারণেই এ প্রস্তাবের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

বিইআরসির প্রস্তাব অনুযায়ী বর্তমানে বাসাবাড়িতে এক চুলার গ্যাসের দাম ১ হাজার ৩৫০ টাকা এবং দুই চুলার দাম ১ হাজার ৪৪০ টাকা করা হবে। বর্তমানে এর দাম রয়েছে যথাক্রমে ৭৫০ টাকা ও ৮০০ টাকা। এ ছাড়া যানবাহনে ব্যবহৃত সিএনজির দাম প্রতি ইউনিট ৩২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪৮ দশমিক ১০ টাকা এবং শিল্পকারখানার বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি ইউনিট ৯ দশমিক ৬২ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮ দশমিক ০৪ টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব এসেছে সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহার করা গ্যাসের দাম। প্রতি ইউনিট ৩ দশমিক ১৬ টাকা থেকে ৯ দশমিক ৭৪ টাকা। গড়ে মূল্যবৃদ্ধির হার ১০২ দশমিক ৮৫ শতাংশ।

 পত্রিকার খবর অনুযায়ী তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির প্রেক্ষাপটে গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি অনুমিত ছিল। কিন্তু বিইআরসি দাম বৃদ্ধির যে হার প্রস্তাব করেছে, তা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। গণশুনানিতে অংশগ্রহণকারী বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রস্তাবিত হারে গ্যাসের দাম বাড়লে জনজীবনে যেমন বিরূপ প্রভাব ফেলবে, তেমনি মূল্যস্ফীতিও বাড়বে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরাই গত কয়েক বছরে সরকারের অন্যতম সাফল্য ছিল।

গ্যাস বা যেকোনো সেবাপণ্যের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বিচারে কী বা কতটুকু লাভ হচ্ছে, সেই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিচার করা প্রয়োজন। গ্যাসের দাম বাড়লে নিশ্চয়ই গ্যাস সঞ্চালন ও বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় বাড়বে। কিন্তু গ্যাসের দাম বাড়ার কারণে যে বিপুলসংখ্যক গ্রহীতা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন, দেশের শিল্পকারখানার উৎপাদন ব্যয় বহুলাংশে বেড়ে যাবে, তার ক্ষতির পরিমাণ কত সেই হিসাব-নিকাশ জরুরি। শিল্পপণ্যের উৎপাদন ব্যয় বাড়লে শেষ পর্যন্ত ভোক্তাদের ওপরই চাপ পড়বে। শিল্পোদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, তাঁদের উৎপাদন ব্যয় ইতিমধ্যে ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে উৎপাদন ব্যয় আরও বাড়বে, যা সামাল দেওয়া অনেকের পক্ষেই অসম্ভব হয়ে পড়বে।

 গ্যাসের দাম বাড়িয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যে বাড়তি আয়ের কথা ভাবছে, সিস্টেম লস কমাতে পারলে তার অনেকটাই পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। এরপরও যদি গ্যাসের দাম বাড়ানো অপরিহার্য হয়ে পড়ে, সেটি যৌক্তিক হতে হবে। দুই চুলার গ্যাসের দাম যদি ১ হাজার ৪৪০ টাকা হয়, এক চুলার দাম কোনোভাবেই ১ হাজার ৩৫০ টাকা হতে পারে না। গরিব ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষই এক চুলা ব্যবহার করে। অনেক সময় এক চুলার নাম করে দুই চুলা ব্যবহার করে বলে অভিযোগ আছে। তার প্রতিকার এক চুলার দাম অস্বাভাবিক বাড়ানো নয়, দুর্নীতি কমানো।

জ্বালানির সমস্যা দেখতে হবে সামগ্রিকভাবে। গ্যাসের মজুত কমছে। বাইরে থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস এনে সরকার বর্ধিত চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করছে। তবে এ-ও স্বীকার করতে হবে যে কয়েক বছর আগে বিদ্যুৎ-সংকট মোকাবিলায় সরকার বিপুল ভর্তুকি দিয়ে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু করেছিল, সেই ভর্তুকি কোনোভাবেই অনন্তকাল চলতে পারে না। আবার গ্যাসের বা বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে শুধু বিতরণ বা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান নয়, বৃহত্তর জনগণের স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। ফলে একটি যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য পথ ধরতে হবে।

বিইআরসির গণশুনানি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এসব গণশুনানিকে শুধু আনুষ্ঠানিকতার বিষয়ে পরিণত না করে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সত্যিকারভাবে কীভাবে জনমতের প্রতিফলন ঘটানো যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে।