কৌতুক করিয়া উত্তর বা উত্তর কোরিয়া কৌতুক

ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে। আচ্ছা, আপনারা কি ছোটবেলায় ‘মাইর’ খেয়েছেন! বাসায় আম্মার মারার অস্ত্রের মধ্যে ছিল হাতপাখার ডাঁটা, স্যান্ডেল। স্কুলে শিক্ষকদের অস্ত্রের মধ্যে ছিল গাছের ডাল ভেঙে বানানো বেত, ডাস্টার এবং কখনো কখনো চক। আজহার স্যার চড় মারতেন দুই হাত দিয়ে, দুই গালে, একসঙ্গে। মারার সঙ্গে সঙ্গে তিনি দিতেন তাঁর সেই উপদেশ, যা আমি চিরকাল মান্য করে আসার চেষ্টা করেছি, অতিরিক্ত কথা এবং কাজ বিপদ ডাকিয়া আনে।
আচ্ছা, ডাস্টার দিয়ে মারা যায় কীভাবে, এটা তো সবাই কল্পনা করতে পারছেন। চক দিয়ে কীভাবে মারা যাবে, নিশ্চয়ই ভাবছেন। আমি নিশ্চিত আমাদের কালের সবাই এই অভিজ্ঞতা স্মরণ করতে পারেন, কিন্তু আজকালকার বাচ্চাদের এই অভিজ্ঞতা থাকবে না। কারণ, এখন স্কুলে শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ। চক দিয়ে মারার পদ্ধতি ছিল উত্তর কোরিয়ার পদ্ধতি। মানে ক্ষেপণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো চক। মানে স্যাররা কোনো ছাত্রের ওপর রেগে গেলে চক ছুড়ে মারতেন তার দিকে। ডাস্টার না মেরে চক যে ছুড়ে মারতেন, এর দ্বারা বোঝা যায়, সেকালের শিক্ষকেরা সুবিবেচক ছিলেন। বিবেচক কথাটার মধ্যেই চক কথাটা লুকিয়ে আছে কি না!
তবে আমাদের আম্মা মার দেওয়ার পরে একটা সামরিক শাসন জারি করতেন। কল্পনা করুন দৃশ্যটা। আম্মার এক হাতে স্যান্ডেল। তিনি মার দিচ্ছেন ধরা যাক আমার ছোট ভাইকে। ছোট ভাই তো মার খাওয়ার আগেই চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল। তখন আম্মা স্যান্ডেল বাগিয়ে বলতে লাগলেন, কাঁদবি না। কাঁদলে মার খাবি। সে এক জটিল পরিস্থিতি। কাঁদলে মার খাব। আর যদি না কাঁদি তাহলে তো মার খাবই। করবটা কী! তো ধরা যাক, আমার ছোট ভাই কেঁদেই ফেলল। তখন আম্মা দিলেন এক বাড়ি। সে আরও জোরে কেঁদে উঠল। এবার আম্মার উদ্যত স্যান্ডেল এবং হুংকার, কানবি না, কানবি না, থাম, থাম...কানলেই আরেকটা বাড়ি খাবি। ওই দৃশ্যটা দেখার মতো। ছোট ভাই কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। একটা বাড়ি খাওয়ার পর তার কান্নাটা অকৃত্রিম হয়ে পড়েছে। এটা থামানোর মতো ব্রেক তার হাতে নাই। কিন্তু পরের মাইরটাও তো খাঁটি জিনিস, সেটার কবল থেকে বাঁচতে হলে থামতেই হবে। ওই সময় আমি নিজে খুব সংকটে পড়তাম। আমার ছোট ভাইয়ের এখন কি কাঁদা উচিত, নাকি থামা উচিত। আমি সিদ্ধান্ত নিতে পারতাম না।
উত্তর কোরিয়ার কথা যখন এলই, তখন বলি—উত্তর কোরিয়ার কতগুলো কৌতুক পেয়েছি।
১. বিদ্যুৎ চমকালে আমরা কেন আলো আগে দেখি, শব্দ পরে শুনি?
কারণ, আমাদের চোখ কানের সামনে।
২. এক লোক বিক্রি করছে আঙুর। সে হাঁক ছাড়ছে, বড় আঙুরে আছে ছোট বিচি, ছোট আঙুরে বিচি নাই। তার সব আঙুর বিক্রি হয়ে গেল। একজন বিক্রি করছে চিনাবাদাম। সে–ও দেখাদেখি হাঁক ছাড়ল, বড় বাদামে আছে ছোট বিচি, ছোট বাদামে বিচি নাই। তার বাদাম আর বিক্রি হলো না।
৩. একজন ভদ্রলোক ওজন কমাতে রোজ ব্যায়াম করেন। তিনি ঘোড়া চালান। ৩ মাসে ৩০ কেজি ওজন কমেছে ঘোড়াটার।
এরপরেরটা কৌতুক না। খবর। এটা পেলাম মানবজমিন পত্রিকায়। উত্তর কোরিয়ার নির্বাচনের খবর।
সরকারের সমর্থনে উল্লাস প্রকাশ করা উত্তর কোরীয়দের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। নির্বাচনের দিনে ১৭ বছর বয়সের ওপরে সব নাগরিককে ভোট দিতে যেতে হয়। আনুগত্যের প্রমাণ হিসেবে আপনাকে খুব ভোরে নির্বাচনকেন্দ্রে হাজির হতে হবে—এ কথা বলেছেন উত্তর কোরিয়াবিষয়ক
একজন বিশেষজ্ঞ ফিয়োদর টার্টিস্কি। তিনি আরও বলেন, এর মানে হলো সবাই একসঙ্গে হাজির হওয়ার পর ভোটকেন্দ্রে লম্বা লাইন।
এরপর ভোটার যখন ভোটকেন্দ্রে ঢুকবেন, তখন তাঁর হাতে একটি ব্যালট পেপার দেওয়া হবে। ব্যালট পেপারে একটাই নাম থাকবে। সেখানে কোনো কিছু লিখতে হবে না। কোনো বাক্সে টিক চিহ্ন থাকবে না। ভোটার শুধু ব্যালট পেপারটি নিয়ে একটি বাক্সে ভরে দেবেন। ভোটের বাক্সটিও সাধারণত খোলা অবস্থায় রাখা হয়। নির্বাচনকেন্দ্রে ভোটের বুথ থাকে। কিন্তু কেউ সেখানে যায় না—বলছেন বিশ্লেষকেরা। কারণ, সেটা করা হলে সেই ভোটারের আনুগত্য নিয়ে সন্দেহ তৈরি হতে পারে।
মি. টার্টিস্কি বলেছেন, আপনি চাইলে ব্যালট পেপারের নামটিও কেটে দিতে পারেন। কিন্তু সেটা করলে নিশ্চিতভাবেই সরকারের গোপন পুলিশ আপনার সম্পর্কে খোঁজখবর শুরু করবে। এ ধরনের কাজ যারা করেছে, তাদের মধ্যে কয়েকজনকে পাগল আখ্যা দেওয়া হয়েছে। ভোট দেওয়া শেষ হয়ে গেলে ভোটাররা নির্বাচনকেন্দ্রের বাইরে যাবেন এবং সেখানে উপস্থিত অন্যান্য ভোটারের সঙ্গে মিলে আনন্দ প্রকাশ করবেন, এই কারণে যে দেশের সুযোগ্য নেতাদের প্রতি সমর্থন জানাতে পেরে আপনি খুবই খুশি। (মানবজমিন, ১১ মার্চ ২০১৯)
আমার আম্মার উদ্যত পাখার ডাঁটার সামনে যেমন কাঁদা নিষেধ ছিল, উত্তর কোরিয়ায় তেমনি হাসা বাধ্যতামূলক।
উত্তর কোরিয়া আর আমেরিকার মধ্যে যখন রণহুংকার চলছিল, তখন ট্রাম্প তাঁর ভাষণে বলেন, ‘আমাকে কিম জং-উন বড় বড় চিঠি লিখেছেন। আমি জবাব দিই। চিঠি চালাচালি করতে করতে আমরা প্রেমে পড়ে গেছি।’
উত্তর কোরিয়ার বিশেষজ্ঞরা ট্রাম্পের এই কথা পরীক্ষা করে বলেন, এটা একটা কৌতুক! আসলে প্রেম হয়নি।
আম্মাকে নিয়ে লেখা আমার একটা কবিতার শেষ ক’টা লাইন দিয়ে লেখাটা শেষ করি:

কাঁসার গেলাসে পানি ঢেলে আম্মা হাতে ধরে আছেন
মুখের ভাতটা শেষ হলে যদি আমি পানি চেয়ে বসি

সেই পানি না খেয়েই ফের যদি ঢাকা চলে আসি আমি
আম্মা গ্লাস হাতে দাঁড়িয়েই থাকবেন দাঁড়িয়েই থাকবেন তিনি যেন বায়েজিদ বোস্তামি।

আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক