পাস করা ও ফেল করা কলেজের গল্প

কয়েক দিন আগে বেসরকারি কলেজের কয়েকজন শিক্ষক এসেছিলেন প্রথম আলো কার্যালয়ে তাঁদের দুঃখ–কষ্টের কথা জানাতে। তাঁরা সবাই সরকারের এমপিওভুক্ত কলেজের নন–এমপিওভুক্ত শিক্ষক। তাঁদের সংখ্যা ৩ হাজার ৫০০। এমপিওভুক্ত হলে সরকারের বাড়তি খরচ হবে বছরে ১০৪ কোটি ৯ লাখ টাকা। ২০১৮ সালের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (স্কুল ও কলেজ) জনবলকাঠামো ও এমপিওভুক্তি নীতিমালায় তাঁদের দাবি গ্রাহ্য না হওয়ায় শিক্ষকেরা আন্দোলনে নেমেছেন। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে ছয় দিন অবস্থান ধর্মঘট পালন করেছেন। কিন্তু সরকারের শিক্ষামন্ত্রী বা উপমন্ত্রী—কারও দেখা পাননি। শিক্ষাসচিব বলেছেন, সরকার শিক্ষকদের দাবিদাওয়ার ব্যাপারে সহানুভূতিশীল। এই সহানুভূতিটুকু নিয়েই তাঁরা ঘরে ফিরে গেছেন। শিক্ষকেরা আশা করছেন, আগামী অর্থবছরে তাঁদের দাবি মেনে নেওয়া হবে।

এই শিক্ষকেরা স্নাতক সম্মান ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পাঠদান করেন। কলেজগুলো এমপিওভুক্ত হওয়ার সময় সরকার ঠিক করে দেয় কোন বিভাগে কতজন শিক্ষককে এমপিওভুক্ত করা হবে। কিন্তু তাঁদের দিয়ে কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব নয়। তাই বাড়তি শিক্ষক নিতে হয়। এঁরাই হলেন এমপিওভুক্ত কলেজের নন–এমপিওভুক্ত শিক্ষক। এখানে একই সমাজে দুটি শ্রেণি নয়, একই কলেজের শিক্ষকদের মধ্যে দুটি শ্রেণি তৈরি হয়েছে। কেউ নিয়মিত বেতন পান, কেউ পান না। সরকার বলবে, তাঁদের বেতন–ভাতা দেওয়ার দায়িত্ব কলেজ কর্তৃপক্ষের। কিন্তু দায়িত্ব যারই থাকুক না কেন, শিক্ষকেরা তো অভুক্ত থেকে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করতে পারেন না।

নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বাংলার শিক্ষার দুরবস্থা প্রসঙ্গে ‘আধা পেট খেয়ে নামতা মুখস্থ’ করার কথা বলেছিলেন। অর্থাৎ আমাদের গ্রামাঞ্চলে যারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে, তাদের বেশির ভাগই পেট ভরে খেতে পায় না। হালে গ্রামীণ অর্থনীতি কিছুটা চাঙা হলেও, শিক্ষার্থীরা ভরা পেটে নামতা মুখস্থ করতে পারলেও নিজের আয়ে চলতে পারে, এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুব বেশি নেই। কাগজে খাতা–কলমে যা–ই লেখা থাকুক না কেন, বেশির ভাগ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারের দেওয়া অর্থের বাইরে খুব বেশি আর্থিক সুবিধা শিক্ষকদের দেয় না, দিতে পারে না। এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা সরকারি খাত থেকে বেতন-ভাতার সিংহভাগ পেয়ে থাকেন (মূল বেতনের শতভাগ এবং কিছু ভাতা। বাংলাদেশে সবচেয়ে অবহেলিত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা, সেটি স্কুল কিংবা কলেজ হোক। তাঁদের অধিকাংশ নিয়মিত বেতন-ভাতা পান না। চাকরি শেষ হলে সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মতো নিয়মিত পেনশন পান না। পেনশনের নামে যে সামান্য টাকা দেওয়ার কথা, তা–ও পেতে বছরের পর বছর ঘুরতে হয়।

বর্তমানে বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৫ লাখ বলে সরকারি হিসাবে জানা গেছে। এর মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতেই আছে ২৮ লাখ। আর সরকারি ও বেসরকারি মিলিয়ে বাকি যে ১৪৬টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, তাদের শিক্ষার্থী মাত্র ৭ লাখ। সরকার প্রতি জেলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার ঘোষণা দিয়েছে। প্রতিটি উপজেলায় একটি করে কলেজ জাতীয়করণ করা হচ্ছে। নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন কিংবা নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জাতীয়করণ করায় যে বিশাল ব্যয় হবে, সেই তুলনায় ৩ হাজার ৫০০ নন–এমপিওভুক্ত শিক্ষককে এমপিওভুক্ত করার খরচ খুবই নগণ্য। বিনিয়োগ তখনই লাভজনক হয়, যখন কম ব্যয় করে বেশি মুনাফা পাওয়া যায়। এখানে মুনাফা হলো উচ্চশিক্ষিত জনবল। সরকার যদি সত্যি সত্যি উচ্চশিক্ষার উন্নয়ন চায়, তাহলে ২৮ লাখ শিক্ষার্থীকে উপেক্ষা করতে পারে না। আর শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা ভাবলে তাঁদের পাঠদানকারী শিক্ষকদের বেতন–ভাতা সমস্যারও সুরাহা করতে হবে।

২ মার্চ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তাদের অধীন কলেজগুলোর পারফর্মিং র্যাঙ্কিং বা শিক্ষা মানক্রম ঘোষণা উপলক্ষে আন্তর্জাতিক ভাষা ইনস্টিটিউটে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল, যাতে পুরস্কার পাওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানেরা উপস্থিত ছিলেন। উপস্থিত ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, শিক্ষাসচিব সোহরাব হোসাইনও। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হারুন অর রশিদ কলেজশিক্ষার মানক্রমের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘পূর্বনির্ধারিত সূচকের ভিত্তিতে অনার্স পর্যায়ের কলেজসমূহের বার্ষিক পারফরম্যান্স র্যাঙ্কিং করে জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে শীর্ষ কলেজসমূহকে আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কৃত ও সম্মাননা দেওয়া হচ্ছে।’

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ৩১টি সূচকের ভিত্তিতে এই পুরস্কার দিয়ে থাকে, যার মধ্যে আছে শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের সংখ্যা, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও এমফিল, পিএইচডিধারী শিক্ষকের সংখ্যা, প্রকাশনা, অবকাঠামোগত সুবিধা, একাডেমিক উৎকর্ষ, পরীক্ষার ফল, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অবদান ইত্যাদি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ ৭১৮টি। এর মধ্যে সরকারি ২৭৭, বেসরকারি ৪৪১। প্রতিযোগী ৩৫৪টি কলেজের মধ্যে মানক্রমে উত্তীর্ণ হয় ১৭৯টি। এর মধ্যে রাজশাহী কলেজ পরপর দুই বছর (২০১৬ ও ২০১৭) প্রথম হয়েছে ১০০ নম্বরের মধ্যে যথাক্রমে ৬৮ দশমিক ১৩ ও ৭২ নম্বর পেয়ে। দ্বিতীয় স্থান পাওয়া বরিশালের ব্রজমোহন কলেজ পেয়েছে ৬৩ দশমিক ৯৫ ও ৬৬ দশমিক ১৫ নম্বর। তৃতীয় অবস্থানে থাকা সরকারি আজিজুল হক কলেজের নম্বর ৬৩ দশমিক ৭০ ও ৬৬ দশমিক ১১। ৬৫ দশমিক ৯৬ ও ৬৪ দশমিক ৩১ নম্বর পেয়ে চতুর্থ হয়েছে পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ। পঞ্চম অবস্থানে থাকা কারমাইকেল কলেজ পেয়েছে ৬৪ দশমিক ৫ ও ৬৫ দশমিক ৭৯ নম্বর। এরপর রয়েছে আনন্দ মোহন কলেজ, খুলনা ব্রজলাল কলেজ, কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ, ঢাকা কমার্স কলেজ, সা’দত কলেজ, মধুসূদন কলেজ, কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ, দিনাজপুর সরকারি কলেজ ও ফেনী সরকারি কলেজ। মেয়েদের কলেজের মধ্যে এগিয়ে আছে লালমাটিয়া মহিলা কলেজ ও সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ। জাতীয় পর্যায়ে শীর্ষে থাকা পাঁচটি কলেজের মধ্যে চারটিই উত্তরাঞ্চলের।

তালিকায় সর্বনিম্ন ১৯ দশমিক ৬৩ নম্বর পাওয়া ১৮৯টি কলেজ স্থান পেলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেছে, যারা ৫০ নম্বর পেয়েছে, তাদেরই আমরা উত্তীর্ণ বলে ধরে নিয়েছি। যারা এর কম পেয়েছে, তারা সবাই ফেল। সে ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া ৩৫৪ কলেজের মধ্যে ৯২টি উত্তীর্ণ হয়েছে। ফেল করা কলেজের পাল্লাই ভারী।

ওই দিনের অনুষ্ঠানে বক্তারা শিক্ষার মানোন্নয়নের ওপর জোর দিয়েছেন। কেউ কেউ বলেছেন, এত দিন আমরা সংখ্যায় এগিয়েছি। এখন মানের দিকে জোর দিতে হবে। কিন্তু শিক্ষা এমন একটি বিষয়, যেখানে আগে সংখ্যা, পরে মানের কথা ভাবার কোনো সুযোগ নেই। দুটো একসঙ্গে এগোতে হয়। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর দেশের মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ নিরক্ষর। তাহলে আমরা কতটা এগোলাম? শিক্ষার ভিতটি শক্ত করতে হয় প্রাথমিক থেকে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে দুর্বল থাকলে ওপরে ঘষামাজা করলে খুব লাভ হয় না। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের অনেক শিক্ষকের কাছ থেকে এই অভিযোগ পেয়েছি।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ৭১৮টি কলেজের মধ্যে ৪৬৪টি প্রতিযোগিতায়ই অংশ নেয়নি। অর্থাৎ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার মানক্রমে যেসব নম্বর বেঁধে দিয়েছে, সেগুলো অর্জন করার সামর্থ্য তাদের নেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এই মানক্রমে দেখা যায়, পরীক্ষায় শুধু শিক্ষার্থীরা পাস বা ফেল করে না। তাদের শিক্ষাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও পাস বা ফেল করে থাকে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা কলেজগুলোকে পুরস্কৃত করেছে। আমরাও তাদের অভিনন্দন জানাই। একই সঙ্গে ফেল করা এবং প্রতিযোগিতায় না আসা কলেজগুলোর জন্য তিরস্কারের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন।

রাজশাহী কলেজ যদি পরপর দুবার সর্বোচ্চ নম্বর পেতে পারে, তাহলে অন্যরা তার ধারেকাছেও কেন আসতে পারবে না? শুধু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পুরস্কার ও তিরস্কার তথা শাস্তির ব্যবস্থা চালু করতে হবে। অন্যথায় উচ্চশিক্ষার নিম্নগতি ঠেকানো যাবে না।

সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]