গোড়া কেটে আগায় পানি ঢালা

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

কার হাত বেশি লম্বা, সেই বিতর্কে যাব না। কিন্তু দেশের একজন নাগরিক হিসেবে প্রশ্নটা আমাকে ভাবাচ্ছে। গাছের গোড়া কেটে আগায় পানি ঢালার তত্ত্বটাও টের পাচ্ছি হাড়ে হাড়ে। আর টের পাচ্ছে যশোর রোডের শতবর্ষী বৃক্ষরাজি।

যশোর রোডের যশোর-বেনাপোল অংশের প্রাচীন বৃক্ষ বাঁচিয়ে রাস্তা সম্প্রসারণের জন্য আমাদের উচ্চ আদালত রায় দিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রীও তেমন নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর সড়ক বিভাগ তা বাস্তবায়ন করছে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গেই। তারা ঠিকই এই আন্তদেশীয় মহাসড়কের দুই পাশের বৃক্ষমৃত্যু অনিবার্য করে তুলেছে। সড়ক বিভাগ এই সড়কের কোনো মহাশিরীষ নিধন করেছে, এমন অভিযোগ কোনো দুর্মুখও করতে পারবে না। কিন্তু প্রথম আলো রিপোর্ট দিচ্ছে, ‘কাটা পড়েছে শিকড়, ঝুঁকিতে ৬২০টি শতবর্ষী গাছ’ (প্রথম আলো, ১০ মার্চ ২০১৯)।

গত মাসে আমি যশোর গিয়েছিলাম। তখন আমি যশোর রোডের যশোর-বেনাপোল অংশে সড়ক উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করি। দেখি আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে এই সড়কের উন্নয়নকাজের তৎপরতা। তারা সড়ক বিভাগের নকশা মেনে সড়ক উভয় পাশে বাড়িয়ে দেওয়ার কাজ করছে। ড্রিল হ্যামার ও এক্সকাভেটর দিয়ে ৩ ফুট গভীর করে মাটি খুঁড়ছে। ফিতা মেপে উভয় পাশে ৫ ফুট করে মোট ১০ ফুট চওড়া হবে রাস্তা। দুই লেনের রাস্তা হবে চার লেন। রাস্তা গিয়ে ঠেকছে শতবর্ষী পুরোনো বৃক্ষের কলজে পর্যন্ত। কোনো কোনো গাছের গোড়া খানিক চেঁছে দিতে হচ্ছে। যন্ত্র দিয়ে মোটা মোটা শিকড় কেটে চলেছে অবলীলায়। কুড়ালের আঘাত নেই, করাতের পোচ নেই! নীরবে মোটা মোটা শিকড় কাটার মহানন্দে বিভোর কর্মিবাহিনী। আরও আনন্দিত তারা, যারা দীর্ঘকাল ধরে এসব ইতিহাস-বৃক্ষনিধনে সাধনা করে আসছিল।

প্রথম আলোর রিপোর্ট পড়লে দেশের মানুষ এবং উচ্চ আদালত পর্যন্ত এখন একমত হবেন, এই সড়কের ৬২০টি বৃক্ষের বাঁচার আশা নেই। কারণ, প্রতিটি বৃক্ষের অর্ধেকের বেশি শিকড়, যা রাস্তার দিকে ছড়িয়েছিল, তা কাটা পড়েছে। যে গভীরতায় মাটি কাটা চলছে, আর বালু, পাথরে ভরাট হওয়ার অপেক্ষায় থাকছে ৫ বাই ৩ ফুট করে জায়গা, তাতে কালবৈশাখী বা বর্ষা মৌসুমে, যেকোনো সময় যেকোনো গাছ উল্টে যেতে পারে। কাজেই এখন দুর্ঘটনা এড়াতে তাদের খতম করা ছাড়া উপায় নেই!

আমি আইনের ফাঁকফোকর না বুঝলেও এটা বুঝতে পারছি, উন্নয়নবিশারদেরা হয়তো আইনের ফোকর গলে আদালতকে বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছেন। তাঁরা কোনো গাছ কাটেননি। যদি বেকুব ঝড়–বাদল এই ৬২০ বৃক্ষের কোনো কোনোটি উপড়ে ফেলে, সে দায় আর যারই হোক এসব উন্নয়নপাগল মানুষের হতে পারে না। কলাগাছিতে দুটো গাছ এরই মধ্যে উল্টে পড়ে রাস্তার দক্ষিণ পাশের ঘরবাড়ি ভেঙেছে। ভাগ্য ভালো, কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। কিন্তু বসতবাড়ির ক্ষতি হয়েছে। বেনাপোল থেকে চাঁচড়া পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৫ কিলোমিটার রাস্তার উভর পাশে শত শত পরিবার নিয়ে জনজীবন এখন মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন।

গাছ পড়ে জানমালের ক্ষতি হতে পারে আশঙ্কা করে কলাগাছি, নবীনগরের ১০টি পরিবার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে ১০টি আরজি পাঠিয়েছে এক্ষুনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে। তিনি পড়েছেন ফ্যাসাদে। ‘মানুষের জানমালের নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ গাছগুলো অপসারণ করা দরকার। কিন্তু গাছ না কাটার ব্যাপারে উচ্চ আদালতের নির্দেশ আছে। এ জন্য মানুষের জীবন বাঁচাতে আমরা কিছুই করতে পারছি না’ (প্রথম আলো, ১০ মার্চ ২০১৯)। তিনি আঙুল তুলেছেন আদালতের প্রতিই। আমাদের কর্মবীর প্রকৌশলীদেরও ফ্যাসাদ কম নয়। দেশের উন্নয়নে ৩২৮ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করার দায় তাঁদের কাঁধে। ‘হয়তো গাছের কিছু শিকড় কাটা পড়ছে। কিন্তু কিছুই করার নেই।’ যশোর সওজ নির্বাহী প্রকৌশলীর সাফ জবাব (প্রথম আলো, ১০ মার্চ ২০১৯)।

আমরা এখন স্বর্গীয় কালীপ্রসাদ পোদ্দারকে উদ্ধার করতে পারি। উদ্ধার করতে পারি অ্যালেন গিন্সবার্গ, বব ডিলান, এমনকি নোবেল কমিটিকেও। প্রথমজন কেন উনিশ শতকের মাঝামাঝি (১৮৪২-৪৫) এই মহাশিরীষ বীথি রচনা করেছিলেন, সেই অপরাধে তাঁকে বিচারে সোপর্দ করতে পারি; মায়ের গঙ্গাস্নানের রাস্তা বানিয়ে তিনি যদি দুপাশ মহাশিরীষে সজ্জিত না করতেন তাহলে উন্নয়নবাদীদের সঙ্গে পরিবেশবাদীদের একুশ শতকে এসে কুরুক্ষেত্র হতো না। আর দ্বিতীয়জন কেন ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সরেজমিন করতে এসে রচনা করেছিলেন ভুবনজয়ী শোকগাথা, ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড?’ বব ডিলানই–বা কেন এত দরদ দিয়ে বাঙালির সেই দুঃখগাথা গেয়ে গেয়ে মার্কিন মুলুক উথালপাতাল করে দিয়েছিলেন! নোবেল কমিটিও কম অপরাধী নয়। তারাও বব ডিলানকে পুরস্কার দিয়ে একাত্তরকে মানুষের মনে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে। মৌসুমী ভৌমিক না জেনেই ফারাবির অনুবাদ কণ্ঠে তুলে নিয়ে বাঙালি হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করে কম অপরাধ করেননি। আর বাংলাদেশের পরিবেশবাদীরা? এই ‘আহাম্মক গোষ্ঠী’ উন্নয়নের আগে পরিবেশ রক্ষার বায়না ধরে ধরে দেশটাকে অন্ধকারে রাখতে চায়!

যে প্রশ্নটা সবাই সযত্নে এড়িয়ে যাচ্ছেন তা হলো, এই ৫ বাই ৫ মিলিয়ে মোট ১০ ফুট রাস্তা সম্প্রসারণ কি বিকল্পহীন ছিল? এটা না করেও কি যশোর-বেনাপোল অংশের সড়ক উন্নয়ন, অর্থাৎ চার লেন করা অসম্ভব ছিল? এই মহাসড়কের উভয় পাশে স্থানভেদে সওজের ৫৫ থেকে ৭০ ফুট করে মোট ১১০ থেকে ১৪০ ফুট করে জায়গা রয়েছে; তা কি ব্যবহার করা যেত না? তাতে কি এই সড়ক চার কেন, ছয় লেনে উন্নীত করা আরও সহজ হতো না? এই মহাপ্রাণ, আদিপ্রাণ অক্ষত রেখেই তো তা করা যেত বলে বুয়েটের সাবেক এক উপাচার্য যিনি একজন স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার এবং পদ্মা সেতু প্রকল্পের অন্যতম পরামর্শক, মনে করেন।

আমরা তথ্যপ্রমাণ দিয়ে লিখেছি, যশোর থেকে বেনাপোল পর্যন্ত (কেবল ঝিকরগাছা পারবাজার থেকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এক কিলোমিটার ছাড়া) রাস্তার দুপাশের সরকারি জমি প্রায় ১৫ বছর দখলমুক্ত অবস্থায় রয়েছে। এই বৃক্ষনিধন কর্ম সাঙ্গ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই বিপুল পরিমাণ জমি বেহাত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল হচ্ছে। মনে প্রশ্ন উঠছে, যেখানে বিকল্প ছিল, সেখানে কেন সেই বিকল্প গ্রহণ করা হয়নি? কেন আজ এই জনপদের বসতি পর্যন্ত দুর্যোগের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হলো? কার স্বার্থে?

আমিরুল আলম খান: যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান
[email protected]