হালদাকে আগে হালনাগাদ করুন

অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে হালদার পানি প্রত্যাহারের মতো আত্মঘাতী আর হঠকারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলার মতো কেউ নেই। নদী কমিশন, পরিবেশবাদী বা জলবায়ু বিশেষজ্ঞ—কেউ কি দাঁড়াবেন হালদার পক্ষে?

আমরা জানি, পার্বত্য চট্টগ্রামের বাটনাতলী পাহাড়ি এলাকা থেকে জন্ম নিয়ে ফটিকছড়ির উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে চট্টগ্রামে প্রবেশ করা হালদা নদী দেশের জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ। কালুরঘাটের কাছে এটি কর্ণফুলী নদীতে মেশার আগে নানা জনপদের বিকাশ ও সৃষ্টিতে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছে। চলার পথে হালদার মূল অববাহিকা ফটিকছড়ির বিবিরহাট, নাজিরহাট, সাত্তারঘাট, হাটহাজারী, রাউজান এবং চট্টগ্রাম শহরের চান্দগাঁওকে মানববসতির উপযুক্ততা অর্জনে যুগ যুগ ধরে সহায়তা দিয়ে আসছে। মাত্র ৮১ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই নদী এখনো সারা দেশে মাছের পোনা সরবরাহকারী প্রাকৃতিক উৎস। আমাদের নানা অবহেলায় নাব্যতা হারানোর পরও এখনো নাজিরহাট পর্যন্ত ২৯ কিলোমিটার প্রায় সারা বছরই বড় নৌকা পরিবহনের উপযোগী আছে। ছোট নৌকা আরও ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার অভ্যন্তরে, অর্থাৎ নারায়ণহাট পর্যন্ত চলাচল করতে পারে।

এবার সেই হালদা নদীর ওপর ভরসা করে ২০২০ সালের মধ্যে চট্টগ্রাম মহানগরীর পানি সমস্যার সমাধান করতে চায় ওয়াসা। এই সময়ের মধ্যে ৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত চারটি পানি শোধনাগার থেকে সরবরাহ করা হবে ৪৬ কোটি লিটার পানি। চট্টগ্রাম ওয়াসার হিসাব অনুযায়ী, ৬০ বর্গমাইলের বন্দরনগরীর চলতি পানির চাহিদা ৩৫ কোটি লিটার। ২০২০ সাল নাগাদ তা বেড়ে দাঁড়াবে ৪০ থেকে ৪২ কোটি লিটার। কিন্তু বর্তমানে ওয়াসা মোহরা প্রকল্প থেকে ৯ কোটি লিটার, পানি শোধনাগার-১ থেকে ১৪ কোটি লিটার এবং গভীর নলকূপ থেকে আরও ৪ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করছে।

চট্টগ্রাম ওয়াসা আশা করছে, আগামী বছরের মধ্যে পানি শোধনাগার-২ চালু করতে পারলে সেখান থেকে আরও ১৪ কোটি লিটার শোধিত পানি পাওয়া যাবে। আর পানি শোধনাগার-৩ চালু করতে পারলে ৯ কোটি লিটার শোধিত পানি আসবে চট্টগ্রাম ওয়াসার পাইপে আর ট্যাংকে। অঙ্কের হিসাবে ওয়াসার তখন আর পানি নিয়ে কোনো হা–হুতাশ থাকবে না।

বলা হচ্ছে, পরিবেশের কথা চিন্তা করে, দেশের ভবিষ্যতের কথা ভেবে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা কমানোর প্রবল বাসনায় হালদার পানি প্রত্যাহার অভিযান। টাকা দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক, অতএব একটার পর একটা পানি শোধনাগার বসিয়ে হালদা থেকে পানি তুলে নাও। চট্টগ্রাম ওয়াসা জানাচ্ছে, বর্তমানে নগরীতে তাদের ৫৪টি গভীর নলকূপ চালু আছে। হালদা নদীকেন্দ্রিক প্রকল্প চারটি পুরোদমে চালু হলে গভীর নলকূপগুলো পর্যায়ক্রমে বন্ধ করে দেওয়া হবে। কিন্তু প্রতিদিন নগরের নিত্যনতুন বাহারি ইমারত আর হোটেলের মালিকেরা যে গভীর নলকূপ বসিয়ে ভূগর্ভের পানি লুট করছেন আর বন্দরনগরীর বিপন্নতা বাড়িয়ে তুলছেন, তার হিসাব কি ওয়াসা বা সিটি করপোরেশনের কাছে আছে?

ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা কমানোর অজুহাতে সবটুকু চাপ আমাদের এক হালদার ঘাড়ে চাপানো কতটা নদীবান্ধব সিদ্ধান্ত, তা অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে। প্রতিদিন ৪৬ কোটি লিটার শোধিত পানির জন্য কমপক্ষে যে ৭০-৭৫ কোটি লিটার পানি দরকার পড়বে, তা দেওয়ার হাল কি হালদার আছে? সরকারি ট্রাস্টি প্রতিষ্ঠান (ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যান বা ফ্যাপজাত প্রতিষ্ঠান) ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিংকে এ বিষয়ে একটা সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। দুষ্টলোকেরা এসব কাজকে ফরমায়েশি কাজ বলে নিন্দা করে থাকেন। তবে ফরমায়েশি হোক বা উদ্ভাবনী হোক ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং বলেছে, জোয়ারের সময় পানি নিলে ক্ষতি নেই। সব জোয়ারে সমান পানি আসে না। ফাল্গুন থেকে জ্যৈষ্ঠে হালদার জোয়ারের পানিতে যে লবণাক্ততা থাকে, তা কীভাবে দূর করা হবে?

ভূগর্ভস্থ আয়রনযুক্ত পানির বদলে কি নদীর লবণাক্ত পানির জালে বন্দী হবে নগরবাসী। পানি শোধনাগারগুলো কিন্তু লবণ মুক্তকরণের বা রিভার্সওসমোসিস প্রক্রিয়ায় পরিচালিত নয়, এখানে নদী থেকে প্রত্যাহৃত পানিকে স্বচ্ছ আর জীবাণুমুক্ত করার জন্য পানির সঙ্গে চুন, ফিটকিরি, ক্লোরিন মিশিয়ে ধাপে ধাপে পলিমুক্ত করে বালু ফিল্টারের মাধ্যমে পানযোগ্য করে তোলা হয়। এখানে লবণাক্ততা মোকাবিলার কোনো কৌশল অনুসরণের কলকবজা নেই। লবণ বিযুক্ত করার কৌশল যুক্ত করা হলেও শুকনো মৌসুমে (শীতের শুরু থেকে বর্ষা নামার আগ পর্যন্ত) হালদার পানি একতরফা প্রত্যাহার চলতে থাকলে নাব্যতা হারিয়ে হালদা এক নর্দমায় পরিণত হবে। বিশ্বের বিস্ময় জোয়ার-ভাটার নদীতে মিঠাপানির মাছের প্রাকৃতিক কিন্তু অলৌকিক এক প্রজননক্ষেত্র হারিয়ে যাবে চিরতরে।

হালদা হত্যার এই প্রক্রিয়া আরও গতিশীল করেছে সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রীর সেচখাল আনিস খাল। সাত্তারঘাট থেকে তিনটি ইউনিয়নে সেচ-সুবিধার আওতায় আনার জন্য হালদার পানি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে সেচখালে। কখন কতটুকু পানি নিলে হালদার কষ্ট কম হবে, তার জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সংকট সৃষ্টি হবে না বা সংকটের সংকেত পাওয়া গেলে কী করতে হবে, তার কোনো নিকাশ নেওয়া হয়নি বলে জানালেন হালদা রক্ষা আন্দোলনের শরিক অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া।

হালদায় হাত না দিয়ে বন্দরনগরীর পানির সংকট কি দূর করা সম্ভব?

এটা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কোন মুনি চেয়ারের কোন দিকে কখন বসছেন, তার ওপরই নির্ভর করছে তাঁদের ব্যাখ্যা। ভূগর্ভস্থ পানি নিঃশেষ হওয়ার আগেই একটা সহজ বিকল্প হিসেবে এসেছে নদীর পানি কম দূষিত হওয়ায় কাছের নদী হালদাতেই তাই সবার নজর। হালদার সাংবাৎসরিক নাব্যতা বজায় রেখে মাছ আর অন্যান্য জলজ প্রাণীর জন্য প্রয়োজনীয় মানসম্পন্ন পানি রেখে তারপর ঠিক করতে হবে কোথায় কতটুকু পানি প্রত্যাহার করা যাবে। বৃষ্টির পানি ধরে রেখেও নগরীর পানির চাহিদা মেটানো সম্ভব। পানের পানি আর টয়লেটে ফ্ল্যাশ করার পানির মান এক রাখার কোনো মানে হয় না। পানি ব্যবহারে একটু সাশ্রয়ী হলে প্রায় ৪০ শতাংশ পানির জান বাঁচানো সম্ভব। নগরীর প্রতিটি উঁচু ইমারতে বৃষ্টির পানি ধরে রেখে ব্যবহার করা সম্ভব। এতে বড়জোর নির্মাণ ব্যয়ের ১ শতাংশ অতিরিক্ত খরচ হবে; কিন্তু সাশ্রয় হবে মহামূল্যবান পানি।

বর্তমান পরিস্থিতিতে পরিবেশবাদীদের এগিয়ে আসার কোনো বিকল্প নেই। হালদা রক্ষার জন্য হালদা বাঁচাও আন্দোলনের পক্ষ থেকে গত বছরের জুন মাসে যে ১১ দফা দাবি দেওয়া হয়েছিল, সেখানে একতরফা পানি প্রত্যাহারের বিষয়ে কিছুই বলা হয়নি। পানি প্রত্যাহারের পূর্বশর্ত হবে হালদাকে হালনাগাদ করা। হালদার পানির উৎস ছড়া আর খালগুলোকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে না আনলে শুকনো মৌসুমে হালদার পানির পরিমাণ এবং গুণগত মান রক্ষা করা সম্ভব হবে না।

গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক
[email protected]