বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ও কন্যার দায়

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ শুরু হচ্ছে আজ থেকে। আজ তাঁর শততম জন্মদিন। তাঁর শতবর্ষে দেশ শাসন করছেন তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনা। সূচনায় উত্তরাধিকারের বিবেচনা থাকলেও বৈরী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে প্রত্যক্ষ সংগ্রামী রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি অর্জন করেছেন তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচয়। এতে প্রজ্ঞা ও দক্ষতারও প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের গতি ও পথ খুঁজে পেয়েছে। তিনি শক্ত হাতেই হাল ধরেছেন দেশের।

বঙ্গবন্ধুর মূল রাজনৈতিক জীবন কেটেছিল বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মুক্তির পথের খোঁজে। দূরদর্শিতা, সাহস, জনদরদি মন এবং সময়োচিত রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে তিনি একসময় দেশ ও দেশবাসীর মুখ্য নেতায় উন্নীত হয়েছিলেন। ছয় দফার পথ ধরে তাঁর নেতৃত্বে জাতি স্বাধীন বাংলাদেশের গন্তব্যে পৌঁছেছিল। বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠলেন জাতীয় নেতা, তাঁকে পেয়ে জনগণ ভরসা করার মতো নিজের নেতা পেল, সব আড় ও বিভেদ ভুলে একসময় এক দেশ এক নেতার ধারণায় পৌঁছেছিল মানুষ। তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করল জনগণ। তখন স্লোগান উঠেছিল—তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা এবং এক নেতা এক দেশ—বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি তিনি, তাঁকে দেওয়া হলো জাতির পিতার আসন।

তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় অবদান বোধ হয় স্বভাবত কলহপ্রবণ, বিভেদ ও বিতণ্ডায় অভ্যস্ত এক জনগোষ্ঠীকে একটিমাত্র মহৎ লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ করতে পারা। একাত্তরের যুদ্ধদিনে বাঙালিমাত্রই তার ধর্ম-দেশ-পরিচয় ভুলে জয় বাংলার সৈনিকে রূপান্তরিত হয়েছিল। তাদের এই মহৎ জাগরণের পেছনে প্রেরণা দিয়েছে সাতই মার্চের ভাষণ এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের জাদুকরি স্পর্শ। কেবল ঐক্যবদ্ধ হওয়া নয়, সেদিন বাঙালি তার বহুকালের জড়তা-ভীরুতা ও মজ্জাগত আলস্য-দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে এক বীরের জাতিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। তেমন বীর যারা কিনা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত। বীরশ্রেষ্ঠ কিংবা ৩০ লাখ শহীদের ইতিহাসের পেছনে এমন নেতৃত্বের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বের ফসল স্বাধীন বাংলাদেশ। তারপরে কিন্তু বাঙালি তার উচ্চ আদর্শ ও উন্নত নৈতিকতাকে ধরে রাখতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু তাঁর দেশবাসীর কাছ থেকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনে যথোপযুক্ত সমর্থন-সহযোগিতা পাননি। স্বাধীনতার পরপরই ক্ষুদ্র স্বার্থ ও সংকীর্ণ চিন্তা ঐক্য, বীরত্ব ও ত্যাগের মহিমাকে ম্লান করতে শুরু করেছিল। বঙ্গবন্ধু দ্রুত একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান দিয়ে সুষ্ঠু রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নানা মহলের বিচিত্র স্বার্থের টানাপোড়েনে তাঁর উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন ব্যাহত হয়েছে। এত বাধার মধ্যেও অর্জন কম ছিল না। তিন মাসের মধ্যে বিজয়ী যৌথ বাহিনীর ভারতীয় সদস্যরা ফিরে গিয়েছিল, যা সামরিক ইতিহাসে একেবারেই অভূতপূর্ব ঘটনা। নয় মাসের মধ্যে দিলেন একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান, দেড় বছরের মাথায় নির্বাচন হলো, পৃথিবীর বড় সব দেশের স্বীকৃতি মিলল, জাতিসংঘসহ অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ পেল বাংলাদেশ, প্রথম জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ দিলেন, যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণীত হলো, পুনর্গঠন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে পরিকল্পনা প্রণয়ন হলো—এমনি আরও দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। কিন্তু বাঙালিকে আর উচ্চ আদর্শে উন্নত নৈতিকতায় মহৎ প্রেরণায় উজ্জীবিত করা যায়নি।

যে জাতি বীরশ্রেষ্ঠ আর অগণিত শহীদের জন্ম দিয়েছে, এবার সেই জাতি তৈরি করল বঙ্গবন্ধুর ভাষায়—চাটার দল। কিছু মানুষের প্রত্যাশা সব সীমা ছাড়িয়ে গেল, অনেকে যুদ্ধের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতাকে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত স্বার্থোদ্ধারে সম্প্রসারিত করল। এইখানে বোধ হয় বলা দরকার ১৯৪৭-এর দেশভাগের পরে প্রথমে ভাষার প্রশ্নে পাকিস্তান সরকার ও পাকিস্তানবাদী রাজনীতির সঙ্গে বাঙালির যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়, তাতে ছাত্র ও রাজনীতিকদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা থাকলেও দেশের শিল্পী-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের সক্রিয় ভূমিকাও ছিল বিশাল। এতে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার যে স্ফুরণ ঘটে, তা রাজনীতির গণ্ডি বা ক্ষমতার লড়াই কিংবা পালাবদলে সীমাবদ্ধ ছিল না। একটি গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী সামাজিক জাগরণ ঘটেছিল। পরবর্তী কালে গণতান্ত্রিক সব সংগ্রামে এই চেতনা রাজনীতির গণ্ডি ছাপিয়ে জীবনের সব স্তরকে ছুঁয়ে পূর্ণতা পেয়েছে। সমাজের এই জাগরণ ও অংশগ্রহণের সামগ্রিকতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিল। সকল পর্যায়ের মানুষ তাঁর ওপর অগাধ আস্থা স্থাপন করেছিল, তিনিও তার যথার্থ প্রতিদান দিয়েছেন।

কিন্তু স্বাধীনতার পরে যেমন রাজনৈতিক অঙ্গনে ভাঙন ও বিচ্ছেদের সুর শোনা গেল, তেমনি শিল্প-সাহিত্যের ক্ষেত্রে জাতীয় বা স্বাদেশিক চেতনার ঐক্য বিনষ্ট হয়েছে। শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা পুনরায় সেই দেশ ও মানবপ্রেমের চেতনা ফিরিয়ে আনতে পারেননি। ফলে স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে জাতীয় ঐক্য তৈরি হয়েছিল, তা আর টেকসই হয়নি। তা ছাড়া, ঘরোয়া সমাজজীবনের পরিসরে অভ্যস্ত তরুণদের মধ্যে আকস্মিকভাবে রণাঙ্গনের গোলাবারুদ, মৃত্যু-রক্ত, ধ্বংস-বিনাশের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তার ঘোর থেকে তাদের মুক্ত করে পুনরায় স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার গুরুত্বপূর্ণ কাজটির কথা আমরা ভাবিনি—না রাজনৈতিক নেতৃত্ব, না বুদ্ধিজীবী–সমাজ। ফলে যুদ্ধ বা এর অভিজ্ঞতা অনেকের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এর ফলে সমাজজীবনে এক নতুন ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে, যা অগ্রসর বুদ্ধিজীবী–সমাজও উপলব্ধি করতে পারেনি। এর খুবই বড় মূল্য দিতে হয়েছে আমাদের সমাজকে। বলা দরকার স্বাধীনতার পর থেকে এবং বিশেষভাবে পঁচাত্তরের পর থেকে রাজনীতি ক্রমে ক্ষমতার বৃত্তে বন্দী হয়েছে এবং সমাজকে কেবল গ্রাস নয়, তার ওপর যেন চেপে বসেছে। আর তাতে সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্র—শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্পকলা, সমাজসেবা, মানবধর্ম ইত্যাদি সবই স্বকীয়তা ও সৃষ্টিশীলতা হারিয়ে বন্ধ্যত্ব ও অবক্ষয়ের শিকার হয়েছে। এ–ও সমাজের বড় খেসারতই বটে।

যারা আমাদের স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল, যারা বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদকে সন্দেহের চোখে দেখেছে, তারা এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের গণমুখী প্রগতিশীল উত্থানকে ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে উপদ্রব জ্ঞান করেছে, তারা এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছে। তাদেরই প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের সেনাবাহিনীর একটি উচ্ছৃঙ্খল দল নির্মম হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দিল।

এরপর তাদের প্রতিনিধি হিসেবে জেনারেল জিয়া বাংলাদেশের পাকিস্তানপন্থী যাত্রার সূচনা করেছিলেন। এই ধারা থেকে দেশকে আবার সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করেছেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা। তবে তাঁর জন্য কাজটা মোটেও সহজ ছিল না, ইতিমধ্যে দেশের রাজনীতির চরম অবক্ষয় ঘটেছে, ছাত্ররাজনীতিও ক্ষমতার বৃত্তে বাঁধা পড়ে মৌলিকত্ব হারিয়েছে, শিল্প-সাহিত্য অঙ্গনে বহু মানুষ ক্ষমতার এবং দলীয় রাজনীতির চক্করে আত্মসমর্পণ করে স্বকীয়তা ও স্বাধীন অবস্থান খুইয়ে ফেলেছেন। ভাবুক চিন্তকেরা পিছিয়ে পড়লেন, নানা ছদ্মাবরণে মোসাহেবের দল ভারী হলো। বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করেছিলেন চাটার দলের আধিক্যের আর তাঁর কন্যা দেখছেন নানা মাত্রার মোসাহেবি।

তবে এই বঙ্গের মানুষ বরাবর উদ্যোগী এবং সংগ্রামী, তাদের সত্যিই দাবায়ে রাখা যায় না। সার্বিক অবক্ষয়, ক্ষমতাকেন্দ্রিকতা, অর্থ ও ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সার্বিক ঘোলাটে পরিস্থিতিতে উচ্চাভিলাষী সুযোগসন্ধানীরা এখন রাজনীতিতে ভিড় করেছেন। বাকি সবাই যেন অর্থনৈতিক উন্নতি, উৎপাদন বৃদ্ধি বা বৈষয়িক উন্নয়নে মনোযোগ দিয়েছেন। বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নতির পথে মোড় ফিরছে। আর শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ফিরিয়ে আনার দিকে মনোযোগ দিয়েছেন, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির ব্যবস্থা করলেন। পাঠ্যবইসহ গণমাধ্যম ও অন্যান্য ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শ সংরক্ষণ ও চর্চার ধারা তৈরি করলেন। শিল্পী-সাহিত্যিক ও ছাত্র-তরুণদের মধ্যে, এমনকি রাজনৈতিক অঙ্গনেও আবার প্রগতি ও গণতান্ত্রিক চেতনার কিছু কিছু প্রকাশ দেখা যাচ্ছে। তরুণ-তরুণতর জনগোষ্ঠীর কাছ থেকে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের আলামতও জোরালো হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির ধারা একাত্তরের পরে স্তিমিত হয়েছে। তারপর ১৯৭৫ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত মাঝেমধ্যে কিছু আশার আলো সত্ত্বেও কালটা ছিল খরাগ্রস্ত। ২০০৭–এর পর থেকে ধীরে ধীরে সমাজ জেগে উঠতে শুরু করেছিল, ২০০৯–এ ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা উন্নয়নের গতি জোরদার ও রাজনীতির ধারাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে যুক্ত করতে চাইলেন। তবে এর মধ্যে বিশ্বায়ন, মুক্তবাজার অর্থনীতি, ইসলামি জঙ্গিবাদের উত্থান, সমাজে ধর্মীয় ও কিছুটা সাম্প্রদায়িক চেতনার বিস্তার এবং সমাজের বিরাজনীতিকরণ, রাজনীতি ও মানবসম্পদের অবক্ষয় ঘটার ফলে কাজটা সহজ নয়। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বাস্তবতায় পুরোনো ধারার রাজনৈতিক চেতনা ও প্রক্রিয়া হয়তো ফিরে আসবে না, কিন্তু দেশে সুশাসন, আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, বেকারত্ব ও বৈষম্য দূরীকরণের মতো চাহিদা জোরদার হবে। তার কিছু আলামত সমাজের নানা ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি। সঠিকভাবে সমাজের এসব বার্তাকে বিবেচনায় নিয়ে জাতির বৈষয়িক ও মানবিক উভয় উন্নয়ন নিশ্চিত করাই আজ শেখ হাসিনার সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।

বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষ উদ্‌যাপন সফল ও তাৎপর্যপূর্ণ হবে, যদি তাঁর কন্যা সঠিক পথে জাতিকে এগিয়ে নিতে পারেন।

আবুল মোমেন : কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক