নিউজিল্যান্ডে হামলা ও সভ্যতার সংঘাতের 'ছক'

সদ্য বলকান যুদ্ধ শেষ হয়েছে। বলকানের মানুষের গায়ে তখনো যুদ্ধের ক্ষত। মার্কিন লেখক, চলচ্চিত্রকার ও ষড়যন্ত্রতাত্ত্বিক অলিভার স্টোন একটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করলেন। পরিচালক সদ্য যুগোস্লাভিয়া ভেঙে তৈরি হওয়া সার্বিয়ার পরিচালক পেটার আন্তোনিয়েভিচ। চলচ্চিত্রটি অনেকেই দেখেছেন। আমিও বহুবার দেখেছি। নাড়া দেওয়ার মতো একটি চলচ্চিত্র। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এটি একটি যুদ্ধবিরোধী চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্রটির নাম ‘সেভিওর’। এতে মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন ডেনিস কোয়াইদ। চলচ্চিত্রে ডেনিস অভিনীত চরিত্রটির নাম জশুয়া রোজ। ১৯৯৮ সালে মুক্তি পাওয়া এই চলচ্চিত্রের শুরুতেই দেখা যায় সন্ত্রাসী হামলা দৃশ্য। জশুয়া মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তা হিসেবে প্যারিসে মার্কিন দূতাবাসে নিয়োজিত ছিল। প্যারিসের এক কফিশপে স্ত্রী ও ছেলের সঙ্গে দেখা করে জশুয়া। জশুয়া সেখান থেকে বেরিয়ে এসে মার্কিন দূতাবাসে ঢুকতে যাওয়ার সময় কফিশপে ইসলামিস্ট সন্ত্রাসীরা হামলা করে। জশুয়ার স্ত্রী ও ছেলের মৃত্যুর নিদারুণ দৃশ্য দেখা যায় চলচ্চিত্রটিতে। এরপরই জশুয়া ক্ষিপ্ত হয়ে স্ত্রী ও সন্তান হত্যার প্রতিশোধ নিতে এক মসজিদে হামলা করে নামাজরত অবস্থায় মুসল্লিদের একে একে গুলি করে হত্যা করে।


নিউজিল্যান্ডের ঘটনার সঙ্গে কি কোনো মিল পাচ্ছেন? বলা হচ্ছে, ২০১৭ সালের এপ্রিলে স্টকহোমে উজবেক যুবকের হামলার প্রতিশোধে ক্রাইস্টচার্চে হামলা করেছেন অস্ট্রেলীয় যুবক ব্রেনটন টারান্ট। ‘সেভিওর’ সিনেমার সঙ্গে আমি কেমন যেন হুবহু মিল খুঁজে পাচ্ছি। সিনেমাটি আরও একবার দেখুন। জশুয়া মসজিদের ভেতরে ঢুকে একে একে গুলি করছে। মুসল্লিরা বাঁচার তাগিদে ছোটাছুটি করছে। সবাইকে মারা হয়েছে ভেবে জশুয়া মসজিদ থেকে বের হয়ে এলে এক আহত মুসল্লি জশুয়াকে পেছন থেকে গুলি করতে উদ্যত হয়। কিন্তু জশুয়ার এক সহকর্মী তাকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর জশুয়া মার্সেনারি সৈনিক হিসেবে সার্বিয়ার পক্ষে বলকান যুদ্ধে যোগ দেয়। সেখানে গিয়ে সার্বিয়া-বসনিয়ার সীমান্তে এক বসনীয় কিশোরকে হত্যা করে। কিশোরটি ভেড়া বা ছাগল নিতে একটি ছোট্ট ব্রিজের ওপর উঠে এসেছিল। যা–ই হোক, নানা ঘটনার পর জশুয়ার মনে যুদ্ধবিরোধী মনোভাব দেখা যায়। সিনেমার শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, ক্রোয়েশিয়ান শহর স্প্লিতের কাছে অ্যাড্রিয়াটিক সাগরে জশুয়া তার অত্যাধুনিক রাইফেলটি ফেলে দেয়। এ সময় তার কোলে ছিল যুদ্ধশিশু ভেরা। ভেরার মাকে বসনিয়ান সৈনিকেরা আটকে রেখেছিল। বন্দী বিনিময়ের সুযোগে ভেরার মা ক্রোয়েশিয়াতে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে ফিরে আসে। জশুয়া অস্ত্রটি ফেলে দিয়েছে বটে কিন্তু যুদ্ধে যা হওয়ার তা হয়েছে। তামাম বলকান ততক্ষণে বধ্যভূমিতে পরিণত হয়েছে।


‘সেভিওর’ মুভিটি আমি অনেকবার দেখেছি। দেখে বোঝার চেষ্টা করেছি। প্রথম দেখি ১৯৯৮ সালের দিকে। তখন মনে হয়েছিল, যুদ্ধের নির্মমতা খুবই ভালোভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই চলচ্চিত্রে। ভেরার মায়ের হত্যার দৃশ্য দেখে থমকে উঠেছিলাম। বা সার্বিয়ান সৈনিক গোরান যখন বসনিয়ান বৃদ্ধার আঙুল কেটে ফেলে, তখন তা দেখে শিউরে উঠেছিলাম। এরপর যতবার এই সিনেমা দেখেছি, ওই অংশটুকু আর দেখতে পারিনি। কিন্তু কখনোই চিন্তা করতে পারিনি ‘সেভিওর’–এর বাস্তব দৃশ্যায়ন দেখতে পাব। নির্মম হলেও সত্যি যে ‘সেভিওর’–এর দৃশ্যাবলি এখন বাস্তবেই নেমে এসেছে। হরহামেশাই এখানে সেখানে হামলা হচ্ছে। বার্লিনে ক্রিসমাসের মার্কেটে ট্রাক তুলে দিচ্ছে তো, প্যারিসের শার্লি এবদোতে হামলা হচ্ছে। সুইডেনের মালমোতে মসজিদে হামলা হচ্ছে তো স্টকহোমে ট্রাক তুলে দিচ্ছে পথচারীদের ওপর। কানাডার মসজিদে ঢুকে হামলা কোনো উগ্রপন্থী। সব মিলে এক ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এখন আর কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। সবাই সবার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায়। আমি এশিয়ান। সবাই ভাবে, আমি সন্ত্রাসী কি না। তুমি ইউরোপীয়। আমি ভাবি, তুমি উগ্র ডানপন্থী কি না।

সভ্যতার সংঘাত নামক বিষাক্ত তত্ত্বের কী বীভৎস বাস্তবায়ন!

‘সেভিওর’ সিনেমাটি দেখলে হালের সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের একটি পূর্বরূপকল্প পাওয়া যায়। যখন সিনেমাটি মুক্তি পায়, তখনো বিশ্বে আইসিস, আল–কায়দার দাপট ততটা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তালেবানরা আফগানিস্তানে জাঁকিয়ে বসতে শুরু করেছে। কিন্তু হান্টিংটন, ডোনাল্ড রামসফেল্ডরা সভ্যতার সংঘাত নিয়ে খুব মাতামাতি করছেন। নতুন ধারণা ও তত্ত্ব পেয়ে আমরাও ঝাঁপিয়ে পড়লাম। নিওকনজারভেটিভদের এই সভ্যতার সংঘাত তত্ত্বের আড়ালে কী ছিল, সেটা কেউই অনুসন্ধান করে দেখিনি। নোয়াম চমস্কির মতো কেউ কেই সমালোচনা করলেও খুব বেশি পাত্তা পাননি তখন। নাইন–ইলেভেনের পর সবাই সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে মত্ত। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সবাই জিহাদি জজবা নিয়ে নেমে পড়ে ঠিক তালেবান, আইসিসের মতোই।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ‘সেভিওর’–এর পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার কীভাবে ১৯৯৮ সালে বসে ২০১৯ সালের গল্প জেনে গেলেন। অনেকেই বলবেন, তাঁরা দূরদর্শী। কবি–সাহিত্যিকেরা অনেক কিছুই আগাম অনুধাবন করতে পারেন। তাঁদের কল্পনাশক্তি প্রবল। ১৯৯৮ সালে আঁচ করে ফেলেছিলেন ২০১৯–এ কী ঘটবে। আবার বিপরীত গল্পও আছে। বৈশ্বিক শক্তিগুলো আগামী ২০ বছর বা ৫০ বছরে কী করবে, তা আগেই ঠিক ফেলে। বিশ্বকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে, সেই পরিকল্পনা নিয়ে তারা মাঠে নামে। এই পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিতে সাংস্কৃতিক উপাদান ছড়িয়ে দিতে থাকে। এর অন্যতম হচ্ছে চলচ্চিত্র। ‘র‍্যাম্বো’ চলচ্চিত্রে দেখেছি—নায়ক একাই এক শ। আফগানিস্তান থেকে ভিয়েতনাম সর্বত্র একাই সবাইকে হারিয়ে দিচ্ছেন। ‘র‍্যাম্বো’ সিরিজের সব চলচ্চিত্রে খলনায়ক ছিল সোভিয়েতপন্থীরা। সোভিয়েতের পতনের পর খলনায়কের আসনে চলে আসে মুসলমানরা। যেমন ‘সেভিওর’-এও।

‘সেভিওর’ বা ‘র‍্যাম্বো’, সব চলচ্চিত্রে নায়ক কিন্তু একজনই। তিনি হচ্ছেন আমেরিকান। হলিউডের চলচ্চিত্রে তো মার্কিন নায়কই থাকবেন। আফগান বা ভিয়েতনামিরা হবে কী করে? কথা সত্য। কিন্তু সন্ত্রাসী তকমার ক্ষেত্রে যে কেবল একটি গোষ্ঠীই চিহ্নিত হয়েছে। হালের সন্ত্রাসীরা কতটুকু মার্কিনবিরোধী, তা নিয়েই প্রশ্ন থেকে যায়। অনেকেই সন্দেহ করে থাকেন এই সন্ত্রাসীরা মার্কিন আধিপত্য বিস্তারের অগ্রবর্তী বাহিনীই। এরা বিভিন্ন স্থানে হামলা করে মার্কিনদের প্রবেশের সুযোগ করে। তারও আগে এরা নেমে পড়ে চলচ্চিত্র, সামাজিক-রাজনৈতিক তত্ত্ব, গান, কবিতা নিয়ে। কেউ কেউ বলে থাকেন ‘সেভিওর’ যুদ্ধবিরোধী চলচ্চিত্র। আবার অনেকেই বলে থাকেন, ‘সেভিওর’ যুদ্ধকে উসকে দেওয়ার চলচ্চিত্র। সভ্যতার সংঘাতের একটি সাংস্কৃতিক রূপ হচ্ছে ‘সেভিওর’। সোভিয়েত–পরবর্তী যুদ্ধের গতি–প্রকৃতি কী হবে, তা ‘সেভিওর’–এর মাধ্যমেই মার্কিন আমাদের ২১ বছর আগে বলে দিয়েছেন। ‘সেভিওর’–এ কিন্তু সেব্রেনিতসার গণহত্যার কথা বিস্তারিত বলা হয়নি। একটি ক্রোয়েট গণহত্যার দৃশ্য দেখানো হয়েছে। বসনিয়ায় কোনো সন্ত্রাসী লড়াই ছিল না। বসনীয়দের মুক্তির লড়াই ছিল বলকানের যুদ্ধ। যদিও এই যুদ্ধ সার্ব ও পশ্চিমারাই বসনীয়দের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। সেখানে প্যারিসে সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে বসনীয় যুদ্ধকে পরিচালক কোন উদ্দেশ্যে যুক্ত করলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। বিষয়টি এমন, তুমি আমার স্ত্রী–সন্তানকে হত্যা করেছ, আমি এখন মুসলমানদের খুন করব। তা পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক। হচ্ছেও তাই। সন্ত্রাসীরা হামলা করে ইউরোপ, আমেরিকা। ট্যারেন্টরা হামলা করে ক্রাইস্টচার্চে।

‘সেভিওর’ চলচ্চিত্রটিকে ঘিরেই সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের ছক অনুধাবনের কসরত চলতে পারে। ‘সেভিওর’ দেখিয়ে দিয়েছে, ভবিষ্যদের সন্ত্রাসবিরোধী লড়াই কেমন হবে। এতে কে কোন পক্ষে থাকবে। চলচ্চিত্রে দেখানোই হয়েছে সন্ত্রাসীরা হামলা করবে। এরপর মসজিদেও হামলা হবে। দাঙ্গা–ফ্যাসাদ শেষে জশুয়াদের মধ্যে মানবিক বোধের উদয় হবে। এ কারণেই বেইভ্রিককে মানসিক রোগী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মার্কিন মুলুকে স্কুল–কলেজে হামলাকারীও মানসিকভাবে অসুস্থ। অসম্ভব কিছু না। দেখা যাবে, ব্রেইভিক সুস্থ হওয়ায় তাঁর ব্যবহৃত অস্ত্রটি উত্তর মহাসাগরে ফেলে দিচ্ছেন। কিন্তু তত দিনে সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তান যুদ্ধে ছারখার। লাখো সিরিয়ান ইউরোপে উদ্বাস্তু। হাজারো মানুষ পঙ্গু। কেবল মুসলমানরাই পরিপূর্ণভাবে ‘সুস্থ’। এবং সন্ত্রাসী তকমা তাদেরই প্রাপ্য। ফিলিস্তিনের পাথর ছুড়ে মারা যুবকেরা সন্ত্রাসী। আইসিস থেকে কাশ্মীরি—সবাই এককাতারে।

আজকের গ্রেট রিপ্লেসমেন্টে অনুপ্রাণিত হয়ে টারান্টের মেনিফেস্টো ‘সেভিওর’–এরই ধারাবাহিকতা। যে উদ্দেশ্য নিয়ে মার্কিনরা ‘সেভিওর’, ‘র‍্যাম্বো’ বাজায়ে ছড়িয়ে দিয়েছিল, তা সফল। চারদিকে মার্কিনদের জয়জয়কার। সেখানে খুশি, সেখানে ঢুকে যাচ্ছে সন্ত্রাস দমনের নামে। দখল করে নিচ্ছে দেশ–জনপদ। ভয়–বিদ্বেষ জারি হয়ে আছে সর্বত্র। সব জায়গাতেই বিভাজন। মারা পড়ছে মায়ের সঙ্গে প্যারিসে ঘুরতে বের হওয়া শিশু সন্ত্রাসীর ট্রাকচাপায়। অথবা ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে নামাজরত অবস্থায় সাধারণ মুসল্লি। তাই এই সন্ত্রাসবাদবিরোধী লড়াইয়ে আগপাছ বুঝতে হবে। এর গভীরে যেতে হবে। বুঝতে হবে এই সন্ত্রাসবাদ লড়াইয়ের আড়ালে আছে সমাজকে, বিশ্বকে বিভাজিত করার হীন উদ্দেশ্য। দেশ দখলের সুপ্ত বাসনা।

তাই ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে হামলায় আমরা আহত হয়েছি বটে অবাক হয়নি। অন্তত যারা ‘সেভিওর’ চলচ্চিত্রটি দেখেছিলাম। কী ঘটবে, তা মার্কিনরা ১৯৯৮ সালেই চলচ্চিত্র নির্মাণ করে বলে দিয়েছে তাদের এজেন্ডা সেটিং পরিকল্পনার আওতায়।

ড. মারুফ মল্লিক, ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব ওরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন