শিশু অধিকার বাস্তবায়নে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে

আজ ১৭ মার্চ, জাতীয় শিশু দিবস। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনে প্রতিবছর জাতীয় শিশু দিবস পালিত হয়। সেই সূত্রে বাংলাদেশের শিশু অধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কিছু প্রসঙ্গ তুলে ধরছি।

শিশুরা জাতির ভবিষ্যৎ, তারাই ভবিষ্যতে জাতিকে নেতৃত্ব দেবে—এটা সম্ভবত সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত এমন একটা বাক্য, যার বিপরীতে আমরা খুব কম জানি, আমাদের করণীয় কী। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদে অনুস্বাক্ষর করার পর রাষ্ট্রীয়ভাবে কাঠামোগত অনেক উদ্যোগ নেওয়া হলেও সামাজিক চর্চায় শিশু অধিকারের বিষয়টি এখনো অনেকখানি উপেক্ষিত। এখনো আমাদের অধিকাংশের ধারণা, শিশুরা যেহেতু বয়সে ছোট, তাদের দাবি আদায়ের ক্ষমতা যেহেতু কম, তাদের সংগঠিত হওয়ার সুযোগ কম, অন্নবস্ত্র সবকিছু পরিমাণে তাদের কম লাগে বলে তাদের অধিকারগুলোও বোধ হয় মর্যাদায় তুলনামূলক ছোট এবং তা বাস্তবায়নে তেমন কোনো জবাবদিহি নেই। কিন্তু এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।

জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদ জাতিসংঘের গৃহীত অন্য সব প্রধান সনদের মতো সমান গুরুত্বপূর্ণ, যার জন্য প্রতিটি রাষ্ট্রকে জবাবদিহি করতে হয়। বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে এ পর্যন্ত পাঁচবার শিশু অধিকার বাস্তবায়নে অগ্রগতি সম্পর্কিত প্রতিবেদন জাতিসংঘে জমা দিয়েছে।

আমরা জানি, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের বেশি শিশু। তার মধ্যে ১৫ শতাংশের বেশি শিশু দরিদ্র। এই দরিদ্র শিশুদের মধ্যে রয়েছে শ্রমজীবী শিশু, গৃহকর্ম ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশু, প্রতিবন্ধী শিশু, পথশিশু, বাল্যবিবাহের শিকার শিশু এবং চর, পাহাড় আর দুর্গম এলাকায় বসবাসরত শিশু। আমরা যখন ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কথা বলি, তখন এই প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য কী ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করছি, তা খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কেননা, এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে কোনো রকম টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।

 শিশু অধিকার বাস্তবায়নে আসলে আমাদের করণীয় কী? এই করণীয় নির্ধারণে প্রথমে আমরা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নজর দেব। বাংলাদেশ শিশুদের সার্বিক উন্নয়নে আইনকানুন ও নীতি প্রণয়নে দক্ষিণ এশিয়ায় অনেকখানি এগিয়ে রয়েছে। আমাদের শিশুনীতি, শিশু আইন, শিশুশ্রম নিরসন নীতি, গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, পাচার প্রতিরোধসহ নানা বিষয়ে শিশুদের সুরক্ষামূলক আইন রয়েছে, যা সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু এখানে লক্ষণীয় একটি দুর্বলতা হলো, এসব প্রতিষ্ঠানের কাজের সমন্বয়ের জন্য দায়িত্বশীল কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। সেভ দ্য চিলড্রেনসহ বাংলাদেশে কর্মরত শিশু অধিকার সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে শিশুদের জন্য একটি পৃথক অধিদপ্তরের দাবি জানিয়ে আসছে, যা জাতিসংঘ শিশু অধিকার কমিটিও সুপারিশ করেছে, কিন্তু তার বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি চোখে পড়ে না। সাম্প্রতিক সময়ে শিশুর ওপর শারীরিক ও যৌন নির্যাতন যে হারে বেড়েছে, তার প্রতিকারে অনেক আইনি বিধান থাকলেও এই ধরনের কর্মকাণ্ড প্রতিরোধের জন্য আমরা বেশি কিছু করতে পারছি না। এই সমস্যার মূলে রয়েছে আমাদের জাতীয়ভাবে কোনো সমন্বিত শিশু সুরক্ষা কাঠামো না থাকা।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শিশু সুরক্ষার জন্য কার কী দায়িত্ব, তা নির্ধারণ করে দিয়ে এই দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয় ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় পরিবার, স্কুল, মিডিয়া এবং সামাজিক সংগঠনগুলো শিশু সুরক্ষার জন্য প্রতিরোধমূলক কর্মকাণ্ড ও ইতিবাচক চর্চাগুলো নিশ্চিত করে। শিশু অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে। বাংলাদেশে সমন্বিত শিশু সুরক্ষা কাঠামো গঠন এখন সময়ের দাবি।

সমন্বিত শিশু সুরক্ষা কাঠামোর মতোই সমান গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয় হলো বাজেটে শিশুদের জন্য বরাদ্দ রাখা। বাংলাদেশে এখন শিশুদের জন্য ‘শিশু বাজেট’ নামে যে চর্চাটি রয়েছে, তা শিশুদের চাহিদা পূরণে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। কেননা, এই শিশু বাজেট মূলত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে শিশুদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থের একটি সামগ্রিক চিত্র মাত্র। এতে করে প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুর চাহিদাকে মাথায় রেখে তাদের জন্য যথার্থ পরিকল্পনা ও বাজেট করা হয় না। তাই এই বাজেট প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় শিশু এবং শিশুদের নিয়ে কর্মরত বেসরকারি সংগঠনগুলোর মতামত গ্রহণ করা উচিত। এ ছাড়া বাল্যবিবাহ, শিশু নির্যাতন, শিশু পাচারসহ শিশু অধিকার লঙ্ঘনের নানা বিষয়ে আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না বলে গণমাধ্যমসহ সামাজিক সংগঠনগুলো বারবার বলে আসছে। এ বিষয়ে আইনের যথাযথ প্রয়োগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে।

তবে একই সঙ্গে পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় শিশু সুরক্ষাবিষয়ক চেতনাগত পরিবর্তন দরকার। পরিবার ও স্কুলগুলোয় এখনো শাসনের নামে শারীরিক নির্যাতনের প্রচলন রয়েছে, যা শিশুর বিকাশে বড় ধরনের বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সরকারি পরিপত্র থাকা সত্ত্বেও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনো শারীরিক শাস্তি দেওয়া হয় এবং অনেক অভিভাবক তা প্রত্যাশাও করেন। এ কারণে সমাজে শিশুর প্রতি শারীরিক নির্যাতনের একটা সংস্কৃতি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। সময় এসেছে শিশু নির্যাতন মেনে নেওয়ার বা চুপ থাকার সংস্কৃতি ভাঙার। এ জন্য দরকার সামাজিক সচেতনতা। যেখানে সংবাদমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি সংগঠনগুলো অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে।

২০২১ সালে বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশ হতে চলেছে। ওই একই বছর বাংলাদেশ জাতিসংঘে শিশু অধিকার বাস্তবায়নবিষয়ক প্রতিবেদন উপস্থাপনের কথা রয়েছে। আমরা চাই, বাংলাদেশ শুধু তার অর্থনৈতিক সূচক নয়, শিশু অধিকার রক্ষার মতো আর্থসামাজিক সূচকেও বিশ্বে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠুক। আর সে জন্য দরকার এখনই সমন্বিত পরিকল্পনা ও যথাযথ উদ্যোগ।

আবদুল্লা আল মামুন : সেভ দ্য চিলড্রেনের চাইল্ড রাইটস গভর্নেন্স ও চাইল্ড প্রোটেকশনের পরিচালক