ডাকসু নির্বাচনের রেশ

ডাকসু নির্বাচনের সপ্তাহখানেক পর বিভিন্ন অনিয়ম ও বিচ্যুতি সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তাতে আত্মপক্ষ সাফাইয়ের পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমকে যেভাবে দোষারোপ করা হয়েছে, তা সত্য আড়াল করার প্রয়াসমাত্র। এটি উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানো। তাঁরা বলেছেন, ‘যাঁরা ক্যাম্পাসে সহিংসতা ও বড় ধরনের অনভিপ্রেত ঘটনার জন্ম দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে তথা দেশে অশান্ত ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে হীন রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের সুযোগ খুঁজছিলেন, তাঁদের উদ্দেশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যবোধ ধারণকারী শিক্ষার্থীরা পূরণ হতে দেননি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যবোধ ধারণকারী শিক্ষার্থীরা ১১ মার্চ নির্বাচনের সময় এবং তার আগে ও পরে কী করেছেন, সেটি দেশবাসী জানে।
দেশবাসী এ-ও জানে, কোন পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২৮ বছর পর ডাকসু নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিল। নির্বাচনের দাবিতে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে মামলা হয়েছে। আন্দোলন হয়েছে। একজন ছাত্র অনশন করেছেন। সবার প্রত্যাশা ছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৩ হাজার শিক্ষার্থী যাতে নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন, কর্তৃপক্ষ সেই পরিবেশ নিশ্চিত করবে।

সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ছাত্রলীগ ছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বী সব প্রার্থী ও ছাত্রসংগঠনগুলোর তরফে কিছু দাবি উঠেছিল। এসবের মধ্যে ছিল হলগুলোর বাইরে ভোটকেন্দ্র স্থাপন, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে ভোট গ্রহণ, ভোট গ্রহণের সময় বাড়ানো ও রাতে ব্যালট ও বাক্স হলে না পাঠানো। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন থেকে আবাসিক হলগুলোর দূরত্ব কয়েক মিনিটের। তারপরও কেন রাতে ব্যালট বাক্স পাঠানো হলো কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যায় সেই প্রশ্নের উত্তর নেই। রাতে ব্যালট পেপার না পাঠালে দুটি হলে সংঘটিত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা সম্ভবত এড়ানো যেত। অন্য হলগুলোর ভোট নিয়েও প্রশ্ন ওঠার বিষয়টি এড়ানো যেত। অনেক হলে স্থানাভাবে বেশি বুথ প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। ভোট গ্রহণের সময় না বাড়ানোয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা শিক্ষার্থীদের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল, যা কর্তৃপক্ষও স্বীকার করেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ–কুয়েত মৈত্রী হলে ‘সিল মারা’ ব্যালট পেপার উদ্ধারের ঘটনায় প্রাধ্যক্ষকে অপসারণ ও ভোট গ্রহণ স্থগিত করার কৃতিত্ব দাবি করেছে। তাদের এই দাবি হয়তো অযৌক্তিক নয়। কিন্তু রোকেয়া হলের একটি কক্ষ থেকে তিনটি বাক্সভর্তি ব্যালট পেপার পাওয়ার ঘটনায় কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা কেন নেওয়া হলো না? ‘সিল মারা’ হোক আর না মারা হোক, হল কর্তৃপক্ষ সেই ব্যালট কেন শিক্ষার্থীদের দেখাতে চাইল না? কেনই–বা তাঁদের বাক্স ভেঙে ব্যালট উদ্ধার করতে হলো? আরও বিস্ময়কর হলো সেই ঘটনায় নির্বাচিত ভিপিসহ অনেক ছাত্রের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। প্রাধ্যক্ষ কোনো ছাত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করেননি বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছেন, কিন্তু কাদের প্ররোচনায় এসব মামলা হয়েছে, তা কারও অজানা নয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দাবি, তারা গঠনমূলক সমালোচনাকে স্বাগত জানায়। কিন্তু আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্ল্যাকার্ড ও ব্যানারের ভাষা পড়লে কর্তৃপক্ষ অনুধাবন করত তারা সত্যিকার মূল্যবোধ বলতে কী বুঝিয়েছেন। পুনর্নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙাতে গিয়ে কর্তৃপক্ষ অনিয়মের অভিযোগগুলো তদন্ত করার কথা বলেছে।

গত শনিবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ডাকসুর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাক্ষাৎকারের পর ধারণা করা যাচ্ছে, তাঁরা অবিলম্বে শপথও নেবেন। কিন্তু তাতে প্রমাণিত হয় না যে কর্তৃপক্ষ একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিয়েছে। ক্যাম্পাসে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হলে এখন তাদের উচিত হবে নিরপেক্ষ কমিটির মাধ্যমে পুরো বিষয়টির তদন্ত করে নির্বাচনে অনিয়ম ও বিচ্যুতির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।