তিন এতিম কিশোরী কেন মরতে চেয়েছিল?

যখন জাতীয় আর আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে সবাই মগ্ন, তখন লালমনিরহাটের তিন কিশোরী যন্ত্রণায় নীল হয়ে কাতরাচ্ছিল রংপুর মেডিকেলের নারী ওয়ার্ডে। তারা নাকি একসঙ্গে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। সে খবর ঢাকাকে ধাক্কা দেওয়ার আগে নিউজিল্যান্ড চলে আসে শিরোনামে। তামাদি হয়ে যায় অসহায় তিন কিশোরীর বাঁচামরার খবর। লালমনিরহাটের এক সরকারি এতিমখানায় থাকত তারা। আজকাল আবার এতিমখানাকে কায়দা করে শিশু পরিবার বলে ডাকা হয়, শিশুদের জেলখানাগুলোকে বলা হচ্ছে কিশোর-কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্র। যেন নামের গুনেই একদিন এদের চরিত্র পাল্টাবে। তবে নির্দ্বিধায় বলা যায়, এখনো পাল্টায়নি এতটুকু।

প্রায় নিয়মিত ব্যবধানে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে গায়েব হয়ে যাওয়া, আত্মহত্যা, আত্মহত্যার চেষ্টা, পালিয়ে যাওয়া, নিজেদের মধ্যে খুনখারাবির খবর বেরিয়ে আসে। গভীর ঘেরাটোপ পেরিয়ে যেসব খবর আমাদের কাছে আসে, সেটাই যে সব খবর, তা হলফ করে বলা যাবে কি? সেই যে গান আছে, ‘জীবনপাতার কত খবর রয়ে যায় অগোচরে!’ এতিমখানার কর্তাদের কাছে তিন কিশোরীর এ রকম আত্মহত্যার সিদ্ধান্তের সম্ভাব্য কারণ জানতে চাইলে তাঁরা স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘দুষ্ট মেয়েরা নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করে রেগেমেগে এসব কাণ্ড ঘটিয়েছে।’ তাঁদের আর কী দোষ? সারা দিন দেশের নানা পদের কর্তাদের মুখে অজুহাতের বয়ান তাঁরা হররোজ শোনেন, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কথা বলাই স্বাভাবিক। প্রথম আলোর উত্তরাঞ্চল সংস্করণে খবরটি ছাপা হয়েছে। পরে আরও জানা গেল, ‘তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। এর প্রধান ছিলেন সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জয়শ্রী রানী রায়। তবে ডিসি সাহেব এখনো তদন্ত প্রতিবেদনটি পড়ে দেখতে পারেননি।

পদাধিকার বলে জেলার সব এতিমখানার সভাপতি খোদ জেলা প্রশাসক সংবাদে জানিয়েছিলেন, শিশুদের আত্মহত্যার চেষ্টার কারণ জানার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে দায়িত্বরত ব্যক্তিরা প্রাথমিকভাবে বলেছেন, কিশোরীরা নিজেদের মধ্য ঝগড়া করে হারপিক (টয়লেট পরিষ্কারক) পান করেছে। তারা সুস্থ হলে প্রকৃত কারণ জানা যাবে। তাদের চিকিৎসা চলছে। ঘটনার সত্যাসত্য যাচাইয়ের জন্য স্থানীয় সাংবাদিক, উন্নয়নকর্মী, অ্যাডভোকেট প্রমুখদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে জানা যায়, কর্তৃপক্ষ তিন কিশোরীর আর কোনো দায়িত্ব নেবে না। তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন উত্তরাঞ্চলের বিশিষ্ট আইনজীবী (ফেলানী মামলার আইনজীবী) আব্রাহাম লিংকন। লালমনিরহাটের সাবেক পিপি ময়েজউদ্দিন ময়েজ তাঁকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। কোনো মানবাধিকারের দৃষ্টিতে কোনো আইন বলে আমরা এই তিন কিশোরীকে আরও বেশি বিপন্নতার মুখে ঠেলে দিলাম? পাঠকেরা নিশ্চয় জানেন, টয়লেট পরিষ্কার করার জন্য ব্যবহৃত কথিত তরলটি মূলত অ্যাসিড–জাতীয় দ্রব্য দিয়ে তৈরি। কাজেই এ যাত্রায় কিশোরীরা বেঁচে গেলেও সঠিক আর দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা না পেলে খাদ্যনালির যন্ত্রণাদায়ক প্রদাহে ভুগতে ভুগতে একদিন তারা...।

মাসখানেক আগে আরেক ‘শিশু বন্দিখানার’ একটি খবরের কথা জানিয়ে রাখা দরকার। ক্লাসে পড়া দিতে ব্যর্থ হওয়ায় সুমন মিয়াকে বেত দিয়ে বেধড়ক মারধর করেন কথিত আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক আবদুল রশিদ। মারের চোটে সুমন জ্ঞান হারালে তাকে চিকিৎসা না দিয়ে একটি কক্ষে আটকে রাখা হয়। পরে সহপাঠীরা সুযোগ বুঝে গোপনে সুমনকে উদ্ধার করে কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করেন। অভিযুক্ত শিক্ষক আবদুল রশিদ স্থানীয় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘পড়ায় অমনোযোগী হওয়ায় শাসন করতে গিয়ে একটু বেশি লেগেছে মাত্র। ছাত্রদের একটু শাসন না করলে পড়তে চায় না।’ কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মকবুল হোসেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

বিচার না হলে, মারপিট বন্ধ না করা গেলে আটক শিশুদের চরম সিদ্ধান্ত নেওয়াটাকে কি আমরা কেবলই আত্মহত্যা বলে পাশ কাটিয়ে যাব? আমরা ভুলে গেলেও গোবিন্দ সরেনের মা নিশ্চয় কোনো দিন ভুলতে পারবে না তার বালক ছেলেটির মৃত্যুর কথা। গ্রিলের সঙ্গে গামছা পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় পাওয়া যায় তাকে। ২০১৭ সালের ২২ জুন সকাল ১০টার দিকের ঘটনা সেটি। একে গরিব তারপর ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অধিবাসী। কে তার পক্ষে কথা বলবে? ঘটনার আগের কথা এই: ১৪ জুন রাজশাহীর তানোর থানার একটি মিথ্যা হত্যাপ্রচেষ্টা মামলায় (নম্বর ০৬/০৭.০৬. ১৬) অভিযুক্ত বালক গোবিন্দকে যশোরের কিশোর শোধনাগারে পাঠানো হয়। ২১ জুন তাঁর মা কেন্দ্রের প্রবেশন অফিসার মো. মাসুদ বিল্লাহর মোবাইলের মাধ্যমে ছেলের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তিনি আজও বিশ্বাস করতে পারেন না তাঁর ছেলে ‘গলায় দড়ি নিয়েছে’।

গাজীপুরের কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্রের (কোনাবাড়ী) নিবাসী মনিরা বেগমের আত্মহত্যার খবর ছড়িয়ে পড়লে প্রথম আলোর মানসুরা হোসাইন একটা সরেজমিন প্রতিবেদন করেছিলেন ঘটনার ছয় মাস পর ২০১৩ সালের জুলাই মাসে। তিনি তখন জানিয়েছিলেন, তদন্ত প্রতিবেদন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন অমানবিক পরিস্থিতির কারণে মনিরা বেগম আত্মহত্যা করতে পেরেছেন। ভবিষ্যতে এ ধরনের আত্মহত্যার ঘটনা আর যাতে না ঘটে, তার জন্য তদন্ত প্রতিবেদনে বিভিন্ন সুপারিশও করা হয়েছিল। তবে পরিস্থিতির বিশেষ কোনো উন্নতি হয়নি। মানসুরার মন্তব্যের সত্যতা মেলে যখন গাজীপুরের কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্রে থাকা মেয়েরা কেন্দ্রের নিরাপত্তাপ্রহরীদের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ এনে বিক্ষোভ শুরু করেন। অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় এক নিরাপত্তাপ্রহরীকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছিলেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। ক্ষুব্ধ কিশোরীদের তাৎক্ষণিকভাবে ঠান্ডা করার জন্য দেওয়া ভ্রাম্যমাণ আদালতের এই রায় নিয়মিত আদালত বহাল রেখেছিলেন কি না, নাকি ন্যায্য ও যথাযথ শাস্তি দিয়েছিলেন, তা কি কখনো জানা যাবে?

মনিরার মৃত্যুর রেশ কাটতে না কাটতে আট–নয় মাসের মাথায় আরেকজন নিরাপদ হেফাজতি কিশোরী ২০১৪ সালের ২৮ এপ্রিল আত্মহত্যার চেষ্টা করে (শিশুটি বেঁচে যাওয়ায় তাঁর সুরক্ষা ও নিরাপত্তার স্বার্থে এখানে তাঁর নাম উল্লেখ করা হোল না)। কীভাবে আত্মহত্যার সামগ্রী (এ ক্ষেত্রে ঘুমের বড়ি) তার নাগালে চলে গেল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও কেউ জবাব দিতে পারেনি। সে সময় গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক জানিয়েছিলেন, যথাযথ তদারকি না থাকায় এসব ঘটনা ঘটছে। পরে কি তদারকি বেড়েছিল?

তদারকি বাড়লে, নিগ্রহ নির্যাতন কমলে কি তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির অনুষ্ঠানে বলতে পারতেন, ঢাকা ও সিলেট কারাগার এবং গাজীপুর নারী ও শিশু পুনর্বাসন কেন্দ্রে নারীরা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন!

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে টঙ্গীর কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে অব্যবস্থাপনার অভিযোগ এনে বেশ কিছু কিশোর নিজেদের শরীর ধারালো ব্লেড দিয়ে কেটে প্রতিবাদ জানায়। ২০১৫ সালের অক্টোবরে যশোর কেন্দ্রের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশদের সঙ্গে সংঘাত হয় কয়েকটি কিশোরের। ওই দিনেই সেখান থেকে পালিয়ে যায় দুজন। পরে নাকি তাদের রুম তল্লাশি করে কিছু দেশি অস্ত্র পাওয়া যায়। এর সপ্তাহখানেক পর আবারও পালায় ছয়জন।

এতিমখানায় যৌন নির্যাতনের শাস্তি বদলি
গত কয়েক বছরে কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, চাঁদপুরসহ অনেকগুলো এতিমখানায় দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা আর কর্মচারীদের দ্বারা নিয়মিত যৌন নির্যাতন ও হয়রানির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর কেবল অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বদলি করা হয়েছে। নির্যাতক বদলি নির্যাতনের মাত্রা, ধরন আর কৌশল পরিবর্তন আনতে পারে কিন্তু নির্যাতন বন্ধ করতে পারে না। আত্মহত্যার প্রবণতাও কমাতে পারে না। এতিমখানাগুলো নিয়মিত নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণের আওতায় আনতে হবে। সরাসরি কোনো দলীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন—এমন শিশুমনস্ক নারী-পুরুষদের নিয়ে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য জেলাভিত্তিক পরিদর্শন দল গঠন করা যেতে পারে। জেল কোডে যেমন বেসরকারি পরিদর্শকের প্রবিধান রাখা হয়েছে, সেসব শর্ত মেনেই এঁদের মনোনয়ন দেওয়া যায়। মনোনয়ন দেবেন জেলা জজ পরিদর্শকেরা। বছরে কমপক্ষে চারটা প্রতিবেদন জমা দেবেন জেলা জজ আর বিভাগীয় কমিশনারের কাছে, যিনি পদাধিকার বলে বিভাগীয় শিশুকল্যাণ বোর্ডের প্রধান। শিশু সুরক্ষা আর বন্দী শিশুদের আত্মহত্যার হাত থেকে বাঁচানোর পথ আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।

লেখক: গবেষক
[email protected]